Click the image to explore all Offers

গল্প।। বিকৃতি।। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়।। কথাকাহিনি ২৬; ১লা এপ্রিল ২০২১;




         

অন্ধকার রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা ঝোপ সেদিকে  অস্ফূট একটা গোঙানির
শব্দ শুনে ওরা ছুটে গেলো।ওরা বলতে তিনজন বিশু,শুভ আর জিতু।বিশু কয়েকবছর হলো
হাইস্কুলে শিক্ষকতা করে,শুভ বি.এ. পাশ করে বাবার সঙ্গে ব্যবসায় লেগেছে,তাদের পরিবার
বেশ ধনী,আর জিতুর বাবা অকালে মারা যাওয়ায় সে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেই প্রাইভেট
টিউশান করে সংসারের চালায়। তবে সে খুবই মেধাবী উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেও সে
উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীদের পড়ায় এবং এতে তার যথেষ্ট সুনাম আছে। এই তিনজনকে
গ্রামের যুবদলের নেতা বলা যায় এদের কথা সবাই শোনে।

ওরা ঝোপের পাশে গিয়ে দেখে অন্ধকারে একটা বাচ্চা কাতরাচ্ছে।মোবাইলটর্চের আলোয়
তাকে চিনলো জিতু - এতো কালীপদদার মেয়ে মিন্টু ও বাড়ি থেকে এতদূরে এখানে পড়ে কেন?
আঁতকে ওঠে ওরা।ছোট্টমেয়েটির নিম্নাঙ্গে ক্ষতচিহ্ন আর তার জ্ঞান নেই।এক অদ্ভুত ক্ষোভ
ঘৃণা হতাশা আর ক্রোধের মিশেল তাদের হতভম্ব করে দিলেও নিমেষে তাকে দুহাতে
তুলে নিলো বিশু।আশেপাশে আলো ফেলে তার ইজেরটা দেখতে পেলো শুভ।ওদের মুখ
লোহার মতো কঠিন।

এই গ্রামে তারা সাফাই অভিযান করে,সচেতনতা শিবির,থ্যালাসিমিয়া সেমিনার,
রক্তদান শিবিরসহ আরো কত অনুষ্ঠান করে ব্যাপক সাড়াও পায়।যুব ও কিশোরদল
ওদের কথায় একপায়ে খাড়া। বড়োরাও তাদের সমীহ করেন।আজ ওরা একী দেখলো?
এখন টিভির খবর থেকে খবরের কাগজ খুললেই শুধু নারীনির্যাতন, ধর্ষণ, শিশুনিগ্রহ,
বিকৃত কামনাবাসনার যা সব খবর দেখে তাতে মানুষ নিকৃষ্টতম পশু হিসাবে নিজেকে
প্রতিষ্ঠার শেষ স্তরে পৌঁছাতে চলেছে। ঘৃণ্য সেই অপরাধীদের তীব্র ধিক্কার দেয় তারা,
অথচ এযে তাদের ঘরের ভেতর ঘা দিয়ে সব লণ্ডভণ্ড করে দিলো!! এ আঘাত সহ্য করা
অসম্ভব।অজ্ঞাত সেই অপরাধীর প্রতি পুঞ্জিভূত ঘৃণার বিলাপ নিক্ষেপ করতে করতে
তিনজন বাজারে যখন এলো তখন রীতিমতো একটা জটলা চলছে।কালীপদর মেয়েকে
পাওয়া যাচ্ছেনা। কোথায় যেতে পারে মেয়েটা? পুকুরে ডুবে গেছে? ছেলেধরা এসেছিলো?
কিডনি চক্র? অথবা অজানা কোনো বিপদ? উৎকণ্ঠাকণ্টকিত সবাই।তিনমূর্তিকে
আসতে দেখে বিশেষ করে বিশুর কোলে মেয়েটিকে দেখে সবাই একরকম ছুটেই এলো।
বিশু প্রায় অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলে,এই নাও কালীপদদা তোমার মেয়ে।অনেকগুলো প্রশ্নবাণ
থামিয়ে শুভ জানায় কোথায় তারা মিন্টুকে পেয়েছে।বুকফাটা কান্নার রব উঠলো
মা এবং মহিলাদের ভেতর থেকে এবং বিলাপ।তাদের কিছুটা নিবৃত্ত করে শিশুটিকে
বাজারেই ভজন ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হলো।যৌননির্যাতনের চিহ্ন প্রকট।
কোনো বিকৃতকাম মানুষের কুকীর্তির কথা সবাই জানলো। হতভাগ্য পিতামাতাকে আশ্বস্ত
করেন ডাক্তার শীঘ্রই জ্ঞান ফিরবে।চোখে কয়েকবার জলের ঝাপটা দিতেই ছোট্টমেয়েটি
চোখ মেললো আর কেঁদে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরলো।মায়ের বুকভাঙা কান্না আর থামে না।
পরের দিন গাড়ি নিয়ে থানায়,সেখান থেকে সরকারি হাসপাতাল,পরীক্ষা-চিকিৎসা সবই
হলো।আজ আর মিন্টু কোনো কথাই বলেনি একদম চুপ হয়ে গেছে।কালীপদদার মুখের
দিকে তাকানো যাচ্ছেনা।
কাঁসাইডি গ্রামের স্বচ্ছ দেহকে কে যে এমন কলঙ্কের চাদর দিয়ে ঢেকে দিল সেই কথা
ভেবে তিনজনের মুখে ব্যর্থ আক্রোশের জটিল আঁকিবুঁকি।

যথারীতি পুলিস এসেছিলো।সাধারণ তদন্ত,পর্যবেক্ষণ,  জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি সেরে তারাও
চলে গেছে।গ্রামের জীবনটাও যেন থমকে আছে আর যেটুকু আলোচনা তাও এই মহা
ন্যক্কারজনক ঘটনা নিয়ে।তাদের মধ্যেই তাহলে এমন কেউ না কেউ আছে যে এমন একটা
জঘন্য কাজ করতে পারে! এই অস্বস্তির কাঁটায় বুক জ্বলে যাচ্ছে।লজ্জা সংকোচে আলোচনা
হচ্ছে কেবলমাত্র সমবয়সীদের মধ্যেই।সবারই এক জিজ্ঞাসা কে সেই অপরাধী?
ওই তিনবন্ধু ঘুমোতে পারছেনা। কে সেই নরপশু? সে কি ধরা পড়বে না?শাস্তি পাবেনা?
জিতু বলে,পশু বলিস না পশুরাও পরিকল্পনা করে পাপ করেনা, করে মানুষ।
বিকেলে খেলারমাঠে শুভ বললো,জানিস ছোটোবৌদি একজনকে সন্দেহ করছে।
কাকে? কে সে? দুজনে চিৎকার করে ওঠে।
গলা নামিয়ে উত্তর, দখিনপাড়ার রতিকান্তদা মানে রতিদাকে।
ওরা ভাবতে লাগলো রতিদার আচরণ নিয়ে।লোকটা কারুর সঙ্গে তেমন মেশে না।
তবে তেমন কিছু......
বিশু জানায় কে ভালো আর কে মন্দ তা মেয়েরাই ভালো বোঝে,ওদের সেন্স প্রখর।
ছোটোবৌদি কি কিছু জানে? প্রশ্ন তার।
শোন রতিদার বউ ওকে ছেড়ে বাপেরবাড়িতে থাকে জানিস তো! সে ছোটোবৌদির সয়লার সই।খুব ভাব দুজনে।সেই বলেছে মানুষটার বিকৃত প্রবৃত্তির কথা।এমন কাজ সে আগেও করেছে।
বলিস কী? বিশু ও জিতু উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
শোন ব্যাপারটা,বছর খানেক আগে ঐ বৌদি যখন বাপেরবাড়ি চলে যায় তার
ঠিক আগেই একদিন রায়পাড়ার একটি মেয়ে ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ে ওদের
দোকানে সাজের জিনিস আনতে গিয়েছিল। পছন্দ করতে করতেই হঠাৎ লাইন অফ,
আর কেও ছিলোনা চিন্তাও ছিলোনা,  রতিদা যে পাড়ার কাকা অথচ ওই জঘন্য লোকটা
মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে।কোনোক্রমে সে নিজেকে মুক্ত করে অন্ধকারেই জোরে ছুটতে
থাকে।রতিদার স্ত্রী কলে জল আনতে গিয়েছিলো সজোরে ধাক্কা লাগে তারই সাথে কলশি
গড়িয়ে পড়ে।তখন কারেন্ট এসে গেছে।মেয়েটির বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে সস্নেহে বৌদি
জানতে চায় কী হয়েছে? শুনশান রাস্তায় মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে তাকে সব বলে দেয়।
সেই রাত্রেই স্বামীর কুচরিত্রের জন্য তাকে ছেড়ে চলে যাবার সিধান্ত নেয় ওই সে।তবে যাবার
আগে প্রাণের বান্ধবীকে ঝরঝর কান্নার সঙ্গে সবকিছু বলে যায়।ছোটোবৌদি এতদিন
কাউকেই এই লজ্জার কথা বলতে পারেনি আমার অবস্থা দেখে না বলে থাকতে পারেনি।
মেয়েটি কে? এর উত্তরে শুভ জানায় তার নাম ছোটোবৌদি বলেনি।এই মহাপাপীকে
উপযুক্ত শাস্তি দেবার শপথ নেয় তিনজন।পরিকল্পনা মতো পরের দিন মিন্টুকে নিয়ে
লজেন্স কেনার নাম করে রতিকান্তর দোকানে গেলো ওরা।ওদের দেখে কেমন যেন
চমকে উঠলো সে আর মিন্টু বিশুকে কী এক আতঙ্কে যেন জড়িয়ে ধরে।ছয় চোখে
বিদ্যুৎঝিলিক খেলে যায়।সেদিন রাত দশটা নাগাদ অর্থাৎ দোকান বন্ধের ঠিক আগে
ওরা কাজে নেমে পড়ে।
রতিদা বাইরে এসো তোমার সঙ্গে দরকার আছে। বলে তাকিয়ে দেখে তার মুখ শুখিয়ে গেছে।
ক-কথা-কী কথা আমতা আমতা করে বলে সে।আসলে এদের সততা ও ব্যক্তিত্বকে সে খুব ভয় পায়।
সে অন্য কথা।তুমি বাইরে এসো।
ভয়ে ভয়ে অভিযুক্ত বাইরে আসে।খানিক দূরে একটা ফাঁকা জায়গায় বসে বিশু বলে,
মিন্টু তোমার মেয়ের মতো তুমি তার সঙ্গে এমন করতে পারলে রতিদা?! তার গলায় দৃঢ় প্রত্যয়।
আতঙ্কে নীল হয়ে যায় অপরাধী। তবু অস্বীকার করতে মুখ খোলে,না-আমি-আমি জানি না কে......
তাকে থামিয়ে দিয়ে স্বর আরো কঠিন হয়, বৌদি তোমাকে ছেড়ে কেন চলে গেছে
আমরা জানি।রায়পাড়ার মেয়েটাকে......
আর কিছু বলতে হয় না,রতি দুহাত জোড় করে বলে,আমার ভুল হয়ে গেছে,
আমাকে ক্ষমা করো..... আমি অপরাধ স্বীকার করছি।আর হবেনা...... ইত্যাদি প্রলাপ
যা তারা শোনে না।
থানায় ফোন করার এক ঘণ্টার মধ্যেই সেকেণ্ড অফিসার দলবল নিয়ে এসে পড়েন।
তাঁকে ভয়েস রেকর্ডিং শুনিয়ে দিতেই অপরাধী সব মেনে নেয়।তার বয়ান রেকর্ড করে
তাকে পরেরদিন কোর্টে চালান করা হয়।বিচার শুরু।

গ্রামের লোকেদের ঘোর কাটার আগেই পরেরদিন আটচালায় এক জরুরি সভা
ডাকা হয় এবং তার সিদ্ধান্ত  অনুযায়ী সাতদিন পরই বিশিষ্ট সমাজকর্মীদের নিয়ে
একটি সচেতনতা শিবির অনুষ্ঠিত হলো যার শিরোনাম 'মনোবিকৃতি এবং যৌন অপরাধ
প্রতিরোধের উপায়'।

--ছবিঋণ- ইন্টারনেট । ---------------------- 

গোপেশ্বরপল্লি,বিষ্ণুপুর,বাঁকুড়া-৭২২১২২
কথা-৭০০১৪৫৬৭২১/৯৭৩২২৩৭৬০৮
ই মেল- chattopadhyayjayanta59@gmail.com



   

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.