Click the image to explore all Offers

গল্প।। জয়ী ।। রীতা রায় ।। কথাকাহিনি ২৬; ১লা এপ্রিল ২০২১;



 


   

রৈখিক মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল -- তুমি আর আসবে না মা? রিনি ছেলের মাথার চুল নাড়তে নাড়তে বলল..
   --- এই তো কিছুদিনের ব্যাপার, ছুটি পেলেই এসে তোকে দেখে যাবো। ভালো চাকরি তো, তাই তোকে ছেড়ে যাচ্ছি। নইলে কি........
   --- তুমিও বাবার মতো...
   --- না বাবা, ওরকম বলে না — ।
   --- আমি তো বলেইছি, আর একটু বড় হয়ে নিই তারপর..
   --- তারপর কি? ১৮ বছর হয়ে গেলেই তো ওরা তোকে দাবি করবে। তুই চলে যাবি আমাকে ছেড়ে তাই তো?
   --- তুমি কি ভাবছো, আমি অত বোকা! আমি ওদের বোকা বানাতেই যাবো। ওরা নিয়ে গেলে আমি যাবো। তারপর সুযোগ বুঝে ওরা যখন বাড়িতে থাকবে না তখন তোমার সমস্ত জিনিসপত্র.. খাট, আলমারী, ড্রেসিংটেবিল, ফ্রিজ, গয়না, শাড়ি সমস্ত কিছু একটা ট্রাকে বোঝাই করে নিয়ে পালিয়ে আসবো।
   --- থাক সেসব জিনিসে আমার আর লোভ নেই। তুই আমার কাছে আছিস.. এর থেকে আর বেশি কি পাওয়ার আছে? আমার সব পাওয়া হয়ে গেছে।
   --- তাহলে যে দিদা সবসময় বলে, ওরা সব নিয়ে নিয়েছে।
   --- সেগুলো দাদু-দিদারা দিয়েছিলেন তো তাই তাদের খারাপ লাগে।
   --- তাহলে তুমি যাচ্ছো কেন?
   --- আমায় যে জিততেই হবে বাবা। নইলে আমি হেরে যাবো।

রিনি শ্বাসরুদ্ধ কন্ঠে কথাকটা আওড়ালো। তারপর সে ভাবনার গভীরে ডুব দিয়ে ঠিক বেঠিকের হিসেবটা মিলিয়ে নিল।
মাধ্যমিক পাশ করার পরই বাবা মা বিয়ে দিল। মতামত নেবারও প্রয়োজন মনে করে নি। বলেছিল, এমন বড়ঘর, একমাত্র ছেলে, রাজপুত্রের মতো চেহারা — কপাল গুণেই মেলে। বিয়ের পর সবাই বলেছিল একেবারে রাজযোটক! সোনায়-সোহাগা। দুধে-আলতায় মিশে গেলো। ছেলেটাও এলো কোল আলো করে। আত্মীয়পরিজন, প্রতিবেশী সকলকে দু-দুবার মিষ্টি মুখ করানো হলো.. একবার দিদিমার তরফ থেকে আর একবার ঠাকুরমার তরফ থেকে। কিন্তু ধাতে সইলো না। বিয়ের পাঁচবছরের মধ্যেই চিড়,. যা বাড়তে বাড়তে বিশাল ফাটল, শেষকালে ভেঙেই পড়ল। দীর্ঘ আট বছরের টানা হ্যাঁচড়া.. লম্বা কেশ.. পুলিশ থানা, কোর্ট, জেরা, কেলেঙ্কারি, লজ্জা.. বাড়ি থেকে বেরোনোই দায়! আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখানো দায়। সেবার যখন এজলাসে বিচার চলছিলো.. তার বিরুদ্ধে আজেবাজে দোষারোপ ছুঁড়ে দিচ্ছিলো.. তখন রিনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেছিলো, "জজ সাহেব জানেন আজ আমার ছেলের জন্মদিন। ও নাকি বাবা, ছেলের অধিকার চাইছে! কই একবারও তো ছেলেকে আদর করলো না, একবারও তো ছেলেকে কোলে তুলে নিলো না?"
জজ সাহেব ক্ষুব্ধ কন্ঠে ছেলের বাবার দিকে রুষ্টভাবে বলেছিলো, "আপনি কি মানুষ? "

পাঁচবছর ছেলেকে আগলে রেখেছে। ভালো স্কুলে পড়াচ্ছে। কোনো অভাব রাখেনি, নিজে চাকরি করছে, কতো অবমাননা সহ্য করতে হয়েছে। লোকের কটূক্তি, দৃষ্টিকাতরতা সব সহ্য করেছে। তার মধ্যেই নিজের পড়াশোনাও চালিয়ে গেছে, জীবনকে থেমে থাকতে দেয় নি। প্রাইভেটে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে ভর্তি হয়েছে। কম্পিউটার শিখেছে। একটার পর একটা চাকরি ছেড়েছে.. আবার নতুন চাকরি যোগাড় করেছে। বাবা-মার বোঝা হয়ে থাকেনি । তা সত্ত্বেও বাবা-মা থেকে বাইরের লোক কেউই রেহাই দেয়নি। একা একা থাকা মেয়েদের অপরাধ.. সকলে বারবার করে মনে করিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া, প্রতিটা ক্ষনে কাঁটার মতো বিঁধে আছে সেই সংবাদ — ডিভোর্সের পরই ও আবার বিয়ে করেছে। ছেলেরা যা পারে মেয়েরা তা পারে না কেন? কেন তাকে বিবশ হয়ে থাকতে হবে? মেয়ে বলে! না —তাকে তো জিততেই হবে। ছেলের ভবিষ্যৎ গড়ে দিতেই এই সিদ্ধান্ত। বাবা মায়ের ইচ্ছায় এ বিয়েতে মত দিতে হলো। না.. বরপক্ষ ছেলের ভার নেবে না। তাদের নিজের বংশজ চাই, তাই তো.. রৈখিককে দত্তক হিসাবে গ্রহণ করলো ওর দাদু-দিদা। তাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম। তাদের সমস্ত সম্পত্তির রক্ষক ও  উত্তরাধিকারী। সৎবাবা কিংবা সৎমা এর সংসারে গলগ্রহ হবার চেয়ে এই ঢের ভালো।

বারো বছরের রৈখিক সব বোঝে। সে চুপিচুপি সব শুনেছে। সে জানে তার মায়ের বিয়ে। তার বাবারও বিয়ে হয়ে গেছে। সে এখন থেকে একা। দাদু-দিদার আদরে-শাসনে তাকে থাকতে হবে। হয় তো তাকে হস্টেলেও থাকতে হতে পারে। কোনো এক অজানা আশঙ্কায় চুপিচুপি বললো, "মা, তুমি আর আসবে না? তুমিও ভুলে যাবে বাবার মতো? ফোন করবে তো রোজ?" রিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললো - "তুই যখন বড় হবি তখন সব বুঝতে পারবি। তোকে তো আমি কোনোদিন সুখের জীবন দিতে পারবো না। আমি তোর কাঁধে আমার স্যাকরিফাইসের বোঝা চাপিয়ে তোকে আধমরা করে বাঁচিয়ে রাখতে চাই না। জানি, প্রথম প্রথম কষ্ট হবে, পরে যখন তুই পড়াশোনার মধ্যে ডুবে যাবি তখন সব ভুলে যাবি। বিধাতার বিধান বুঝি এই। এতেই সবার মঙ্গল। তুইও বাঁচবি, আমিও বাঁচবো আর তোর দাদু-দিদাও তাদের উত্তরাধিকারী পেয়ে বাঁচবে। তারা আমার জন্য যে অবমাননা, যে কষ্ট, যে অপচয় সহ্য করেছে এখন তা পরিশোধ করার সময় এসেছে। তাদের বৃদ্ধবয়সের নির্ভরতার স্তম্ভ হওয়ার জন্যই বোধহয় বিধাতা তোকে সৃষ্টি করেছেন।"।

দুপুরে রেজিস্ট্রি বিয়ে। সন্ধ্যায় সামান্য আচার অনুষ্ঠান, খাওয়া-দাওয়া.. শাঁখ বাজলো, উলুও পড়লো। সবাই বললো বাহ্! বরটা ভারি স্মার্ট! একাই এসেছে বিয়ে করতে, আবার মেয়েকেও একাই নিয়ে যাবে। কেউ বললো মডার্ন ছেলে মেয়ে, এতে ভাববার কি আছে? কেউ বললো ছেলেটি বেশ, একেবারে ইঞ্জিনিয়ার! সব জেনেশুনে একটা ডিভোর্সী মেয়েকে বিয়ে করলো। আবার কেউ বললো নিশ্চয় কোনো খুঁত আছে। হ্যাঁ, এই ভেজালের যুগে ভালো হওয়াটাই তো খুঁত!

রৈখিকের শিশুমনে কোনও দাগ নেই, মোবাইলের ক্যামেরায় ছবি তুলে তার মাকে দেখিয়ে বলে উঠলো — "মা দেখো সিঁদুর পরে তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে। একেবারে মা দুর্গার মতো"। রিনির চোখে মুখে প্রস্ফুটিত আত্মবিশ্বাসী জয়। আজ সে সত্যিই জয়ী !
 
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।

-------------------------------------------------------
©রীতা রায়
মালদা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত  

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.