খেলার সাথী
বদরুদ্দোজা শেখু
আবুজান একটি সরকারী দপ্তরে কাজ করতো। দূর শহরে। দীর্ঘ তিরিশ বছর পর
সে অবসর পেয়েছে। সে মফঃস্বল গাঁয়ের ছেলে। বাপ এরফানের ছোটখাটো চাষবাস ছিলো।কিন্তু বাপের চাষের কাজে কষ্টের তেমন ফসল মিলতো না। প্রাইমারী পড়া মানুষ। হঠাৎ এরফানের বাপ মারা যাওয়াই এরফানকে সংসারের হাল ধরতে হয়। আর লেখাপড়া হয়নি।সেই থেকে তার সন্তানদেরকে লেখাপড়া শেখানোর ঝোঁক এরফানের জীবনের একটা ব্রত ব'লে সে ধ'রে নিয়েছিলো। তাই আবুজান ও তার দিদি ও অন্যান্য ভাই বোনদের স্কুল পাঠাতে ছাড়েনি। এতে অনেকসময় তাকে
পাড়া- পড়শীর আত্মীয়স্বজনের কটু মন্তব্য শুনতে হয়েছে। তবু সে তাকে আমল দ্যায়নি
কষ্টেসৃষ্টে মেয়েদের বিয়েশাদি দিয়েছে সাধ্যমতো গ্রাম্য রেওয়াজ মেনে ,তবে অন্ততঃ প্রাইমারী পাশ ছেলের সাথে।
আবুজান এখন শহরের শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করেছে। তারও ছেলে মেয়ে হয়েছে।
অনেকদিন হলো সে গ্রামের বাড়িতে যেতে পারেনি। কারণ শহরে সংসার গুছানো খুব সহজ নয়। তারপর বাচ্চাদের বড়ো করা , তাদের স্কুল লেখাপড়া চিকিৎসা , সর্বোপরি অফিসের চাপ সামলাতে হিমসিম খাওয়া।
এখন সে অবসর পেয়েছে। তাই একবার পূজোর ছুটির সময়ে গাঁয়ের বাড়ি গিয়ে
আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখাসাক্ষাৎ ক'রে আসার মনস্থ করলো।
সে ছোট থেকে শুনতো , তার দাদি নাকি
রাহিলার জন্মের সময়ে ব'লে রেখেছিলো,আবুর বিয়ে সে তার এই লাতিনের (নাতনির) সাথে দিবে। সেকালে এরকম রীতি-প্রথার নাকি রেওয়াজ ছিলো,
দাদিদাদু নানা-নানি এরা তার ছেলেমেয়ের সন্তানের জন্মের সময়ে আত্মীয়স্বজনের
মধ্যে কা'র সাথে কা'র বিয়ে দিবে তা ব"লে রাখতো এবং সেইসব ছেলেমেয়েরা দু'চার বছরের হলেই তাদের কথা মতো বাল্যবিবাহ সেরে ফেলতো।যাদের বিয়ে দেওয়া হতো
তারা বিয়ে কী তাও হয়তো বুঝতো না, পরস্পরকে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে কবুল করার কথাও তেমন হয়তো বুঝতো না। কারো নানা-নানি কারো দাদু -দাদি কবুল ক'রে দিতো। ভবিষ্যতে তারাই স্বামী-স্ত্রী হ'য়ে ঘর-সংসার করতো।যখন তারা ধীরে ধীরে বড়ো হ'য়ে উঠতো, তাদের মধ্যে বর-বধূর একটা ধারণা ধীরে ধীরে মানসিকভাবে গড়ে উঠতো। এই রেওয়াজের অন্যথাও যে হতো না তা নয় , তবে অনেকটাই এমনভাবে হত।
রাহিলা তার ছোট চাচার মেয়ে। ছোট বেলার খেলার সাথী। সর্বক্ষণ ওঠাবসা খেলাধূলা খাওয়াদাওয়া সবকিছু একসাথেই হতো।
ওদের দাদী নানা সময়ে ওদের বিয়ে দেওয়ার কথা ব'লে ওদের মধ্যে একটা বরবধূ হওয়ার বোধ হাসিঠাঠ্ঠার ছলে ঢেলে দিতো। তারপর ওদের বাপেরা ভিন্ন হ'য়ে গেলে তারা একই পাড়ার অন্য বাড়িতে উঠে যায় । তবু আবু স্কুলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত চু-কিতকিত লুকোচুরি কানামাছি পুতুলের ঘরকন্না সব খেলা একসাথেই হতো। আবুর বাপ তার ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠালেও রাহিলার বাপ তার মেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি তেমন আগ্রহী ছিল না। দশ বারো বছর বয়স হ'লেই বিয়ে দিয়ে দিতে হবে , তাদের আর বেশী পড়িয়ে কী দরকার , তার চেয়ে বরং সংসারের কাজকর্ম করতে শিখুক , তাতেই তাদের ভালো হবে ,এই ছিলো তার চাচার মনোভাব।
আবুজান নবম-দশম শ্রেণীতে যখন দূরের গাঁয়ের স্কুলে পড়তো , কখনো কখনো বাড়ি এলে রাহিলার সাথে তার দেখা হতো, টুকিটাকি কথা হতো। কিশোরী রাহিলার তখন সবে শরীর স্বাস্থ্য পুষ্ট হ'য়ে উঠছে , দেখে আবু শরীরে মনে একটা আলোড়ন অনুভব করতো। কেমন শিরশিরানি উন্মনা ভাব, কল্পনা বোনার আকুতি। রাহিলাও লাজুক চোখে ধরা দিতো আবার চ'লেও যেতো। আড়ালে আবডালে তাকে ডেকে দু'চার বার কথাও বলতো।বয়ঃসন্ধির সময়কালে তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্নও
দেখেছে ,কাছে পেতে বুকে পেতেও চেয়েছে।কারণ দাদির প্রতিশ্রুতির কথাই তাদের মনে এক প্রকার ভালবাসার বন্ধন তৈরী ক'রে দিয়েছিলো হয়তো মনের অজান্তেই । এক ধরণের বাল্যপ্রেমে তারা আচ্ছন্ন ছিলো। রাহিলার যখন বিয়ে হয় তখন তার দাদি আবুজানের সাথে তার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলো , কিন্তু আবুর বাপ ওই প্রায়-নিরক্ষর মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেওয়া নাকচ ক'রে দ্যায়। তার বিরুদ্ধে আবুর মুখ খোলার সাহস হয়নি। তবু আবু রাহিলার প্রতি একটা প্রেমের টান অনুভব করতো। হৃদয়ের টান, শরীরের টান , স্বপ্নের টান ।
* * * *
দশমাইল দূরে চাঁদপাড়া গ্রামে আবুর এক দিদির বিয়ে হ'য়েছিল। দেখাশুনা ক'রে ওই গাঁয়ের এক চাষী পরিবারের তিন নম্বর ছেলের সাথে রাহিলার বিয়ে হ'য়ে গেলো ।
আবু বিমর্ষ হ'লেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি। সে শুনেছে, এখন সে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সুখেই আছে।,
অনেক বছর পর সেই চাঁদপাড়া গ্রামে তার অসুস্থ দিদিকে দেখতে আবু একটা ছোট গাড়ি ভাড়া ক'রে সপরিবারে শহর থেকে ওখানে গেলো। ভাগ্নে বলেছে , এখন ওদের গাঁয়ের রাস্তাঘাট সব পাকা হয়েছে।বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি চ'লে যাবে, তাই চিন্তার কোনো কারণ নাই।তার মনে অন্য একটা সূপ্ত বাসনাও কাজ ক'রে চলেছে।সে ওখানে যখন যাচ্ছে তখন তার চাচাতো বোন রাহিলাকেও দেখে আসবে। আর যাই হোক, সে তো তার বাল্যপ্রেম ছিলো , খেলার সাথী ছিলো। তাই ওখানে গিয়ে ওর বাড়ি না যাওয়া ঠিক হবেনা। সে ভাবে, তার সাথে যদি রাহিলার বিয়ে হতো ,তবে হয়তো শহরের এই আরামের জীবন সে পেতো না।
তবু বাল্যকালের সুখস্মৃতিগুলোও তাকে অনেক সময় পীড়িত করে।
দিদির বাড়ি পৌঁছানোর খবরে , পাড়া বেপাড়ার অনেকেই আবুজানের সাথে দেখা করতে এলো,পরিচয় হলো ।সংসারের খবরাখবর নেওয়া হলো । কিন্তু বিকেল গড়িয়ে গেল , রাহিলার দেখা পাওয়া গেল না।মনটা উসখুস করছিলো , তাই একসময় ভাগ্নেকে ডেকে বললো, চলো ভাগ্নে , একবার তোমার রাহিলা খালাকে দেখে আসি। বেলা প'ড়ে আসছে। এসেছি যখন , একবার রাহিলাকেও দেখে যাই।
-----কা'র কথা জিজ্ঞাসা করছেন মামা? রাহিলা খালার ?
রাহিলা খালা তো চার/পাঁচ বছর আগেই মারা গেছে ! খালুও মারা গেছে অনেকদিন আগেই। ছেলেমেয়েদেরও সব বিয়েশাদি হ'য়ে গেছে । সবাই খাটাখুটি ক'রে খায়, কে কোথায় আছে তার ঠিক নাই।ওরা কেউ আপনাকে চিনতেও পারবে না। ও বাড়িতে গিয়ে কী করবেন মামা , যাওয়ার দরকার নাই।
আবুজান শুনে হতবাক হ'য়ে ভাগ্নের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সম্বিৎ ফিরে ব'লে উঠলো, রাহিলা মারা গেছে !? স্বপ্নেও ভাবিনি , আর দেখা হবেনা ! আমরা বাল্যখেলার সাথী ছিলাম।কেউ আমাকে একবার খবর দেওয়ার কথাও ভাবেনি !
ভাগ্নে বললো আপনি তো কোনো কিছুতে আসতে পারেন না মামা তাই হয়তো - - -
আবুর মুখ বিষণ্ণ হ'য়ে উঠলো।
* * * *
সন্ধ্যা নেমে আসছে।বাড়ি ফিরতে হবে। গিন্নী তাগাদা দিলো, তোমার চাচাতো বোনের বাড়ি যাবে বলছিলে , যাবে না?
নাগো, সেখানে যাওয়ার আর দরকার হবে না। সে বহুদিন মারা গেছে, আবু বললো। পাশে দিদি শুকনো মুখে বসেছিলো ,বললো, হায়,হায়, রাহিলা তো মারা গেছে ভাই ,মেলা দিন হলো। মকিদ মারা যাওয়ার পর রোগে শোকে অবহেলায় খুব খারাপ হ'য়ে গেছিলো । আমার থেকেও ছোট ছিলো। তুমি শুনোনি ভাই? - - - আর তোমার সাথে তো যোগাযোগই তো নাই। আবুর গিন্নী পাশে দাঁড়িয়ে চুপ ক'রে রইলো।
ফেরার পথে চুপচাপ আবু তার বাল্য খেলার সাথীর কথা রোমন্থন ক'রে চললো।গাঁয়ের বাইরে রাস্তার পাশে কবরডাঙা পড়লো।সেখানে সে খুঁজলো, রাহিলার কবর কোনটা হ'তে পারে? সে কি চেনা যায় ? চোখের কোণায় কি অশ্রু ছলোছল হলো ? সে হাত দিয়ে চোখদুটো মুছলো। তার গিন্নী ছোট ননদের কাছে শুনেছিল , আবুর সাথে রাহিলার বিয়ে দেওয়ার কথা নাকি দিয়েছিলো তার দাদিমা। সে কি কিছু বুঝলো? মেয়ে জিজ্ঞাসা করলো, বাবা, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে ? নিরুত্তর আবু ধ্বসে-যাওয়া কবরগুলোর মাঝে তার বাল্যপ্রেমীকে খুঁজে চলেছে । গাড়ি স্পীড নিলো- - -
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
-------------------------------------------
লেখকের নাম-- বদরুদ্দোজা শেখু
ঠিকানা-- 18 নিরুপমা দেবী রোড , বাইলেন 12 ,
শহর+পোঃ- বহরমপুর , জেলা--মুর্শিদাবাদ,
PIN -742101
----------------------------------------------------
লেখক মূলতঃ কবিতা লিখেন। অল্পস্বল্প গল্পও লিখেন।