পূর্বকথন
অখিলবাবুর মৃত্যুর দ্বিতীয় বার্ষিকী। তাঁর ছবিতে মালা লাগায় পুঁটির মা। মানদা মননকে বলেন তিনি নাকি রোজ সকালে অখিলবাবুর সঙ্গে চা খান অফিস ঘরে। মনন বোঝায়, কেউ চলে গেলে আর আসে না। কিন্তু মানদা এই একটা ব্যাপারে অনমনীয়। এরপর ...
মনন ভাবতে থাকে মা যদি এইভাবে রোজ বিশ্বাস করতে থাকে যে বাবা তার সঙ্গে চা খায়, তাতে কারোর তো কোন ক্ষতি হচ্ছে না। তাহলে সে এ ব্যাপারটা নিয়ে এত বিচলিত হচ্ছে কেন। ভাবে ঠিকই, কিন্তু তার মন মানে না। যতই হোক এটাতো কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। একজন মানুষ মারা গেলেন। তার পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন। মারা যাবার কিছুদিন পর থেকে তাঁর স্ত্রী হঠাৎ রোজ সকালে নাকি তাঁর প্রয়াত স্বামীকে দেখতে পাচ্ছেন, কথা বলছেন আর চাও খাচ্ছেন। মননের মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে। তারপরই আর কালবিলম্ব না করে ফোনটা তোলে।
মননের বাল্যবন্ধু সুমন তাদের স্কুলের ফার্স্ট বয় ছিল। পরবর্তীকালে সে ডাক্তারী পাশ করে। তবে সুমন একটু অন্য ধরনের চিকিৎসা শাস্ত্রে নিজেকে নিয়োজিত করে। সে কলকাতার অন্যতম নামকরা মানসিক রোগের চিকিৎসক। আমাদের দেশে মানসিক রোগটাকে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা করে দস্তুর। সাধারণ বাড়িতে শরীরের চিকিৎসায় যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, মনের অসুখে ঘটে তার উল্টো। সুমন নিষ্ঠার সঙ্গে শুধু চিকিৎসাই করে না, মানুষের মধ্যে এ ব্যাপারে বিভিন্ন ভাবে সচেতনতার প্রসারও ঘটাতে চেষ্টা করে সে। ইদানীং শহরের নামী কাগজগুলোয় স্বাস্থ্য বিষয়ক পাতায় মানসিক রোগের চিকিৎসাও কিছুটা স্থান দখল করেছে। আর সেসব কলমের বেশিরভাগ প্রতিবেদনের লেখকই ড. সুমন মৈত্র।
মন স্থির করে ফেলে মনন। সুমনের সঙ্গেই মায়ের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ফোনটা বার দুয়েক রিং হয়ে কেটে যায়। মনন একবার ভাবে খুব ব্যস্ত মানুষ তো, থাক বিরক্ত করব না, হয়ত রোগী দেখছে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে দেখি আরেকবার ডায়াল করে। এইবার কিন্তু ওপার থেকে একটি পুরুষ কন্ঠ বলে ওঠেন - নমস্কার। "মনের খোঁজে মানসিক ক্লিনিক" থেকে ধীমান বলছি। বলুন স্যার আপনার জন্য কি করতে পারি।
মনন মার্জিতভাবে জিজ্ঞেস করে - আমি কি একটু ডক্টর সুমন মৈত্রের সঙ্গে কথা বলতে পারি। ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠটি সবিনয়ে বলেন - স্যার অ্যাপয়নমেন্ট ছাড়া কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলেন না। আপনার কি এপয়েন্টমেন্ট করা আছে?
মনন জানায় সুমন তার স্কুলমেট। ছেলেটি বিনয়ের সঙ্গে বলে - স্যার আপনি যদি একটু আপনার নামটা জানান। মনন তার পরিচয় দেয়। ছেলেটি বলে,স্যার আপনি লাইনে থাকুন। এরপরই মিউজিক শুরু হয়। মনন আন্দাজ করে ছেলেটি তার বসের সঙ্গে কথা বলছে।তার একটু পরেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে সুমনের গমগম গলা।
কি ব্যাপার রে মন। সেই কবে লাস্ট আমাদের মধ্যে দেখা বা কথা হয়েছিল মনেই নেই। তা হঠাৎ আমাকে কি মনে করে? কোথা থেকে পেলি আমার ফোন নাম্বার?
সুমন হাসতে হাসতে বলে - দাঁড়া দাঁড়া, একসাথে এত প্রশ্নের উত্তর দেবো কি করে। শোন আমার কথা পরে বলছি। আগে একটাই কথা বল, তোর সাথে কি একটু দেখা করা যাবে?
সুমন একটুখানি ভেবে নিয়ে বলে, হ্যাঁ মানছি আমার সময়ের একটু সমস্যা আছে। কিন্তু তাই বলে আমার বাল্যবন্ধু সুমনের সঙ্গে দেখা করার সময় পাবো না এতটা অধঃপতন আমার হয় নি। বল কখন আসছিস? তবে হ্যাঁ আমাকে একটু আগে জানিয়ে দিবি না হলে আমি অন্য কাজে ব্যস্ত ব্যস্ত হয়ে যেতে পারি।
মনন বলে, না না অত তাড়াতাড়ি করার কিছু দরকার নেই। আজকেই দেখা করতে হবে এইরকম ব্যাপারটা নয়। তবে হ্যাঁ কাল পরশুর মধ্যে যদি একবার দেখা করা যায় খুব ভালো হয়। তুই যদি সময়টা বলিস তাহলে একটু আড্ডা মারা যাবে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তোর সঙ্গে আলোচনা করবো।
সুমন সম্ভবত তার সেক্রেটারিকে বলে, ঘোষ একটু দেখুন তো কাল বা পরশু আমার কোন স্লটটা ফাঁকা আছে?
ওপাশ থেকে একটি তরুণকণ্ঠ উত্তর দেয় - স্যার কাল বিকেল পাঁচটা থেকে সাতটা আপনার কোনো অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নেই।
সুমন এবার মননকে বলে, ঠিক আছে তুই কাল পাঁচটার সময় চলে আয়। কোথায় আসবি বল তো? এতদিন পর আসছিস, তুই আমার বাড়িতেই চলে আয়।
মনন জিজ্ঞেস করে - তুই কি সেই বেহালা চৌরাস্তার বাড়িতেই থাকিস?
সুমন হেসে বলে, না বস। সে বাড়ি এখন নেই, প্রমোটারের হাতে পরে রাজলক্সমি হাউসিং। বাবা-মা দুজনেই গত হবার পর আমি ওখান থেকে শিফট করি। আমার ছোট ভাই সুখেনকে তো চিনিস, ও ওর বউ বাচ্ছা নিয়ে ওই হাউসিং-এই থাকে। ওখানে আমরা দু ভাই ফ্ল্যাট পেয়েছি। আমারটাও ওই দেখাশোনা করে। আমি এখন নিউ টাউন-এ গ্রীন ভিউ-এর চোদ্দতলার বাসিন্দা।
মনন গ্রীন ভিউ চেনে, খুব অভিজাত আবাসন। সে বলে - ঠিক আছে, আমি চিনি। কাল ঠিক পাঁচটায় হাজির হচ্ছি।
সুমন হেসে বলে, আয় আয়, ছোটবেলার মত জমিয়ে আড্ডা হবে। আজ ছাড়ি, কেমন।
ফোন রেখে মনন মনে মনে গুছিয়ে নেয়, ঠিক কি আলোচনা করবে সে বন্ধুর সঙ্গে।
ক্রমশঃ ...