তখনো ভালো করে সকালের আলো ফোটেনি। গ্রামের গগনের বউ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাক দেয়- এই বউ শহরে যাবি নে! তাড়াতাড়ি নে, উঠ...
ঘুম জড়ানো গলায় রাখালের বউ বলে- হ্যাঁ যাচ্ছি দিদি।
মানুষটা সুস্থ থাকলে কি তাকে আজ এই ভোরবেলা উঠে রাজ্যের মোঠ মাথায় ছুটতে হয়?
বেশ কিছু বছর আগে রাখাল রিকশা চালাতো, কিন্তু হঠাৎ এক ভয়ংকর দুর্ঘটনায় তার একটা পা কাটা পড়ে সেই যে মানুষটা পঙ্গু হয়ে গেল, তারপর থেকে বুকে পাথর বেঁধে সেই তো সংসারটা আগলে রেখেছে। রাখালের বউ লক্ষীকে শহরে সবজি ফেরি করতে হয়, এ কি কম দুঃখের কথা!
পলাশ পুর গ্রামে ছোট্ট মাটির কুঁড়েঘরে স্বামী, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তার ভরা সংসার ছিল একদিন। সংসারে অভাব থাকলেও সুখের অভাব তাদের কোনদিন ছিল না। উনি দিন রাত এক করে মুখে রক্ত তুলে খেটেছে, তবু একদিনের তরে ছেলে মেয়েদের কষ্ট বুঝতে দেয় নি কো।
গগনের বউ ও তার সাথে সকালের ট্রেনে শহরে যায়। যাওয়ার সময় ছেলেমেয়েদের বলে যায় সে-বাপরে দেখিস।
অন্যান্য দিনের মতো আজও লক্ষী বেরোবে এমন সময়, বড় মেয়ে রানী জিজ্ঞেস করে- কি রান্না হবে মা? ঘরে তো চাল-ডাল কিছু নেই।
আজ লক্ষ্মীর মন মেজাজ বোধ হয় ভালো ছিল না। খেঁকিয়ে উঠে সে- যা দেখি, জালাসনে আমার, মর গে যা।
মায়ের কথায় রানীর চোখে জল আসে। সেও মনের দুঃখে বাকি ভাই বোনদের নিয়ে চলে যায়।
সারাদিন লক্ষ্মীর ছেলেমেয়েরা চেয়ে চিন্তে খাবার জোগাড় করতে পারে না, অবশেষে হতাশ হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফিরে তারা এক প্রকার হতবাক হয়ে যায়, দেখে বাপ মাটিতে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
অমনি রানী চেঁচিয়ে বলে- বাবা ও বাবা কষ্ট হচ্ছে?
রাখাল বলে- পঙ্গুটা যে কবে মরবে! কি শাস্তি, চোখেও দেখে না ভগবান!
রানী বলে- বাবা তুমি চুপ করো। দাঁড়াও, দেখি কোথাও কিছু পাই কিনা! অমনি রানী ছুটতে ছুটতে চলে যায় হাটের দিকে। মুদির দোকানে গিয়ে বলে- দাও গো দাদা একটু মুড়ি, তোমার কাছে ভিক্ষে চাইছি যে- বাপটা খিদের জ্বালায় মরে যাবে গো।
মুদিওয়ালা হা হা করে হেসে পান চিবোতে চিবোতে বলে- দেখে গে যা পঙ্গুটা মোলো নাকি।
রানী আবার হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে, মনে ভাবে অনেক তো রাত হল মা যে এখনো এলো না। সে এবার আস্তে আস্তে লম্পো খানা জ্বালিয়ে মাটিতে ঠেস দিয়ে বসে, ওমনি ভাই ও বোন বলে- খেতে দে দিদি। রানী চুপ করে থাকে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে, তারপর খিদের জ্বালায় কাদ্দে কাদ্দে ঘুমিয়ে পড়ে ভাই বোন। সে ও যে কখন ঘুমিয়ে পড়ে টেরও পায় না। রাতের আঁধার কেটে ভোর হয়ে গেল, বাপ হাঁপাতে হাঁপাতে চোখের সামনে মারা গেল। মাও হারিয়ে গেল ফিরে এল না।
এইভাবে বেশ কিছু মাস কেটে গেল, রানী ভাইবোনদের নিয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়ায় কাজের আশায় । হঠাৎ দেখে কেউ একজন যেন রাস্তার পাড়ে বসে " গো ...গো "শব্দ করছে । রানী আস্তে আস্তে তার কাছে গিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, দেখে তার মা পাগলী হয়ে শুয়ে " গো গো" করছে।
সে সাতপাঁচ না ভেবে তার মাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসে। সেখানকার কিছু গ্রামবাসীকে দেখে মায়ের অবস্থার কথা জানায়।
তারা বুঝতে পারে এটা শয়তান গগন ও তার বউ এর কাজ। সবাই মিলে গগনের বাড়িতে চড়াও হয়। রানী চিৎকার করে- ও গগন দা , ও গগন দা।
প্রথমে গগন ও তার বউ তারা দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘাপটি মেরে থাকে, পরে গ্রামবাসীর চাপে বেরিয়ে আসে। তারা একের পর এক প্রশ্ন করে- কি ব্যাপার গগন, লক্ষ্মীর এই অবস্থা হলো কি করে? গগন ও তার বউ তারা সবকিছু অস্বীকার করে। তারপর মারের ভয়ে আমতা আমতা করে বলে - লক্ষ্মী কে চলন্ত গাড়ি ধাক্কা মারে । এতে ও মাথায় চোট পায়। আমরা ভেবেছিল কি মারা গেছে, সেজন্য চলে এসেছি। গ্রামবাসী ও তার বউকে ধমক দেয় - চুপ শালা, লক্ষ্মীকে মারার চক্রান্ত করে আবার গলাবাজি আমরা তোদের চিনিনা? গগন ও তার বউ এর যথাযথ শাস্তি হয়।
গ্রামবাসী পঞ্চায়েতের সাহায্য নিয়ে লক্ষ্মীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। এতে লক্ষী কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি কখনই।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।