গল্প ।। অশনি সঙ্কেত ।। অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায়
অশনি সঙ্কেত
অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায়
সুজানপুর গ্রামটা একটা ব্যতিক্রমী গ্রাম বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না । কবির ভাষায় বলতে গেলে , " ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় , ছোট ছোট গ্রামগুলি ।" সে রকমই একটা গ্রাম যে এখনও আছে ভাবলে অবাক হতে হয় । গ্রামের জনসংখ্যা দুশোর বেশি কোনমতেই নয় । সব সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে এই সুজানপুর গ্রামে । পারিবারিক বিবাদ থাকলেও , জাত , ধর্ম নিয়ে এতটুকু বিবাদ নেই । এত মিলমিশ , এত আত্মীয়তা সমস্ত পরিবারের মধ্যে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন । সকলেই গরিব । দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ । থাকার মধ্যে আছে একটা প্রাথমিক বিদ্যাপীঠ আর একটা অবৈতনিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র । দোকান পাট তেমন কিছু নেই । প্রতি শনিবার হাট বসে । যা কিছু কেনা কাটা সব হাট থেকেই । গ্র্রামের শেষে ছোট নদী । সারা বছর হাঁটু জল । শুধু বর্ষায় তার ভয়ঙ্কর রূপ দেখা যায় । দুকূল প্লাবিত করে ঢুকে পড়ে চাষের জমিতে ।
আর পাঁচটা গ্রামের মত সুজানপুরেও দিন শুরু হয় পাখির ডাকে । পুব আকাশ লাল হবার আগেই । কৃষকেরা লাঙল কাঁধে চলে চাষের জমিতে । তাদের আগে আগে চলে বলদের দল । বাড়ির মেয়ে - বউরা কোমরে কাপড় গুঁজে লেগে পরে ঘরের কাজে । কাজ কি আর একটু -আধটু । বিস্তর কাজ । স্কুল খোলা থাকলে কচি কাঁচারা দল বেঁধে যায় স্কুলে । মেঠো পথ । । বর্ষায় জল কাদা আর শীতে ধুলো । এতে অবশ্য কোনো অসুবিধা হয় না । বরঞ্চ , রাস্তায় জমা জলে ভিজতে দারুন মজা ওদের । টালির চাল আর দরমার বেড়া দেওয়া স্কুল । চারিদিক খোলা । গরু চড়ে বেড়ায় । ছাগল চড়ে বেড়ায় । স্কুলের সামনের ফাঁকা মাঠে দুস্টুমীতে মেতে ওঠে শিশুর দল । এই ভাবেই দিন যায় , মাস যায় , বছর যায় ।
এখন স্কুলে গরমের ছুটি । বাতাস আমের মুকুলের গন্ধে ভরপুর । কচি কচি আমে ভরা গাছ । আম বাগানে এক এক জায়গায় জড়ো করা শুকনো পাতার ঢিবি । বাড়িতে জ্বালানির কাজে লাগে । প্রত্যেকটা গাছের গোড়ায় ঘিন ঘিনে আম পোকার বিরক্তিকর জ্বালাতন । তবুও সকাল হলেই খেলতে আসে ছেলের দল । আজকে এখনও সবাই আসে নি । শুধু আকবর আর ইব্রাহিম এসেছে । একজনের বয়স সাত আর এক জনের বয়স আট । ছোটদের কত রকমের খেলা ।
আকবর বলল , সুড়ঙ্গ , সুড়ঙ্গ খেলবি ?
ইব্রাহিম বলল , খুব ভালো । তুই একদিক দিয়ে বানাবি আর আমি আর এক দিক দিয়ে ।
সুড়ঙ্গের ভেতরে কী রাখবো ?
লাল্টু বলছিল ওদের বাড়িতে কুকুরের বাচ্চাগুলো শেয়ালে নাকি রোজ চুরি করে নিয়ে যায় । এই সুড়ঙ্গের ভেতরে কুকুরের বাচ্চাগুলোকে লুকিয়ে রাখবো । শেয়াল আর খুঁজে পাবে না ।
ঠিক বলেছিস । খুব মজা হবে । জব্দ হবে শেয়াল পন্ডিত ।
কিন্তু , লাল্টু কি বাচ্চাগুলো আনতে দেবে ? তাছাড়া , ওর কুকুরটা যদি উল্টে আমাদেরই কামড়ে দেয় , তাহলে ?
দূর বোকা , কামড়াবে কেন ? আমরা তো লাল্টুকে বলবো । লাল্টুকে তো আর ওর কুকুর কামড়াবে না । লাল্টু হাতে করে নিয়ে আসবে ।
ঠিক বলেছিস , কুকুরটাও দেখে যাবে যে ওর বাচ্চারা ভালো জায়গায় আছে । কুকুরটা বাইরে পাহারা দেবে । আমরা ওকে খাবার দেব ।
বাচ্চাগুলোকে খাবার দিবি না ?
তুই কি রে , ওরা তো মার দুধ খায় ।
চল , আগে সুড়ঙ্গটা বানিয়ে ফেলি । তারপর লাল্টুকে গিয়ে বললেই হবে ।
কিন্তু , গর্ত করবো কী দিয়ে ?
দাঁড়া , আমি বাড়ি থেকে দুটো ছোট লোহার শিক নিয়ে আসি ।
ইব্রাহিম ছুটলো বাড়িতে । একটু বাদেই দুটো শিক নিয়ে হাজির । দুজনে দু দিক থেকে গর্ত করা শুরু করলো । আকবর একটু গর্ত করে দেখে প্লাস্টিকের বলের মত কি একটা যেন রয়েছে । কিন্তু শক্ত । বল এত শক্ত হবে কেন ? জেদ চেপে গেল আকবরের । জোরে জোরে বার কতক ঘা দিতেই প্রচন্ড শব্দে ফেটে গেল বলটা । কেঁপে উঠলো সারা গ্রাম । ধোঁয়ায় আর বারুদের গন্ধে আকাশ বাতাস ছেয়ে গেল । ছুটে এল গ্রামের সবাই । দেখে রক্ত মাংসের দলা হয়ে আকবরের ছিন্ন ভিন্ন শরীর । একটু দূরে রক্তাত অবস্থায় পরে আছে ইব্রাহিম । কান্নায় ভেঙে পড়লো পুরো গ্রাম । এক জন নিয়ে এল একটা রিকশা ভ্যান । ছুটলো সবাই খেয়া ঘাটের দিকে । নদী পেরিয়ে মাইল দুয়েক দূরে হাসপাতাল । গ্রামের নারী পুরুষ সবাই চলেছে কাঁদতে কাঁদতে । কেউই বিশ্বাস করতে পারছে না যে এরকম ভয়ঙ্কর ঘটনা সুজানপুরে ঘটতে পারে । তাদের শত্রু কে ? তারা তো কারো কোনো অনিষ্ট করে নি । দুটো শিশুর মৃত্যু - ভাবতে পারছে না কেউ । কথা বলার শক্তি নেই কারোর ।
ঘটনাস্থলেই মারা গেছে আকবর । সাংঘাতিক ভাবে আহত ইব্রাহিম । জ্ঞান নেই । এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না । বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম । থানা থেকে পুলিশ এল । খোঁজ খবর নেওয়া শুরু । পুলিশ জানতে চায় কে বা কারা ওখানে বোমা লুকিয়ে রেখে ছিল । পুলিশের কাজ খুঁজে বের করা । কে রেখেছিল ? কেন রেখে ছিল ? কবে রেখেছিল ? একের পর এক প্রশ্ন । হয়তো একদিন এই সব প্রশ্নের সমাধান হয়ে যাবে । কিন্তু দুটো নিষ্পাপ শিশুর এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুর দায় কে নেবে ? কি দিয়ে মোছাবে বাবার চোখের জল ? কী দিয়ে পূরণ করবে মায়ের শূন্য কোল ?
সুজানপুর আর ব্যতিক্রমী গ্রাম থাকলো না । এ কিসের অশনি সঙ্কেত ?
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট ।
-----------------
ASHIM KUMAR CHATTOPADHYAY
MANGALDEEP APARTMENT
144 / 5 BANERJEE PARA ROAD
POST . TALPUKUR
BARRACKPORE
KOLKATA - 700123
গল্পটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। ভাল লাগল। ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন