সংসারে স্বাচ্ছলতা না থাকলে ও দুটি বেলা দুটো প্রাণের পেট পুরে খাওয়াটা হয়ে যায়।হেমাঙ্গীনি দেবীর বয়স ৬৭ বছর। এক মাত্র সন্তান সিন্টু। চওড়া খালের ধারে ঘন জঙ্গলে ঘেরা গ্রাম শীতলচক। হেমাঙ্গীনি দেবীর স্বামী গত হয় ১৮ বছর আগে। নিযুক্ত ভাবে স্বামী কোন কাজে যুক্ত ছিল না। দিনমজুরি কাজ করে যাইহোক সংসার টা চালিয়ে দিত। কাজ না থাকলে খালে বিলে মাছ ধরে তা বিক্রি করে পেট চালাতো । এতেও সংসারে সুখ ছিল।
হেমাঙ্গীনি দেবী একান্ত অসহায় হয়ে পড়ে স্বামী মারা যাওয়ার পর। এক মাত্র সন্তান সিন্টু কে কি ভাবে দু বেলা দু মুঠো খাইয়ে মানুষ করে তুলবে তা নিয়ে দু: চিন্তার শেষ ছিল না। বাবা যখন মারা যান তখন সিন্টু র বয়স মাত্র আট বছর। হেমাঙ্গীনি সাত পাঁচ না ভেবে ছেলেকে মানুষ করার লক্ষ্যে বাড়িতে বাসন মাজার কাজ শুরু করে। যা পায় তাতে চলে যেত। ছেলেটা বিশেষ লেখা পড়া শিখতে পারে না। এইট টা কোন রকমে পাশ করে। বর্তমানে ছেলে সাবালক। এখনো বিয়ে করে উঠতে পারেনি। বরং মায়ের শ্রম লাঘব করে মা কে বাড়ি বাড়ি বাসন মাজার কাজ হতে অব্যাহতি দিয়ে নিজে ই সংসার চালায়।
সিন্টু র রাত ডিউটি, সপ্তাহে তিন বা চার দিন কাজে বের হয়। দিনের বেলায় ঘুম দিয়ে শরীর কে বিশ্রাম দেয়। সব কিছু ঠিক ঠাক চলছিল। হঠাৎ একদিন সিন্টু র খুব জ্বর এল ।মা দোকান থেকে ঔষধ কিনে আনলো। দুই দিন ঔষধ খাওয়ার পর ও শরীর সারলো না । মা চিন্তা করতে লাগল ছেলে র শরীর কি ভাবে সারানো যায়। ভাবলো কাল সকাল হলেই ছেলে কে ট্রলি ভ্যান করে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। তাই হল, ডাক্তার বাবু দেখে ঔষধ দিলেন। আস্তে আস্তে শরীরের উন্নতি হতে লাগল। সিন্টু র তিন চার দিন ডিউটি কামাই হল। এখনো শরীরের দুর্বলতা আছে। আরো তিন চার দিন বিশ্রামের পর সিন্টু র শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ হল।
সে দিন বিকেলে গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে , সিন্টু র ঘুম তখন ও ভাঙে না । হঠাৎ সিন্টু র ফোন টা বেজে উঠল। মা ফোন টা ধরলো। ফোনে র কারুকাজ হেমাঙ্গীনি দেবী তেমন কিছু বোঝে না। কোন রকমে ফোন এলে ধরতে পারে, ব্যাস এইটুকু। কাউকে নিজে র থেকে কোন দিন ফোন করতে পারে নাই। ফোন টা কানে ঠেকাতে ওপার থেকে ভেসে এল কিরে সিন্টু এবার শরীর ঠিক হয়ে গেছে তো , তাহলে যেমনটা কথা হয়েছে সেই মতো সেই জায়গা য় আমরা একসাথে মিলিত হচ্ছি আজ রাতে। শুনতে শুনতে মা কি বলবে বুঝতে পারছে না ,কে বা কাকেই ফোন করেছে ? পুনরায় ভেসে এল, আজ একটা বড় দাঁও এসেছে। গৌর পুরের রায় বাড়ি র সাত বছরের একটা কন্যা কে পাচার করতে পারলেই হাতে হাতে এক লক্ষ টাকা ইনাম পাওয়া যাবে। নিজের কানে এই কথা শুনে হেমাঙ্গীনি দেবী চমকে উঠলো। শরীরে আর প্রাণ নেই। কে বাবা তুমি ফোনে কথা বলছো ? যেই না শোনা অপর প্রান্ত থেকে ফোন টা কেটে গেল।
নানা প্রশ্ন হেমাঙ্গীনি দেবীকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ছেলে কি কাজ করে ? কেই বা ছেলেকে ফোন করে ছিল ? নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছে না। ছেলে ঘুম থেকে উঠলো, আজ সে ডিউটি যাবে। মা'কে বলল, মা তাড়াতাড়ি খাবার তৈরি করো,আজ ডিউটি যাবো। মালিকের সাথে কথা হয়ে আছে। মা বলল না আজ তুই ডিউটি যাবি না । আরো ক ' দিন বিশ্রাম নিয়ে নে, শরীর একেবারে সুস্থ হয়ে উঠুক, বাধা দেব না। মা বলল খোকা একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? তুই কিসের কাজ করিস বাবা? খোকা বলল মা, তুমি এসব বুঝবে না মা । বল না বা বা আমি ঠিক বুঝবো। মা কেন তুমি ছেলে মান্ সি করছো। আমি রোজকার করে সংসার চালাই এটাই তো ভালো। মা বোঝার চেষ্টা করো ।মাথা গরম করো না। ক দিন শরীর খারাপের জন্য ডিউটি যাই না, সংসার কিভাবে চলবে ? ঠিক চলবে বাবা, মা বলল । কে যেন ফোনে কি সব বলছিল ? তুমি ভুল শুনেছ মা । তাই কি হয় ? আমি নিজে কানে শুনলাম। ছেলে মায়ের উপর চটে গেল এবার। তুমি তাড়াতাড়ি খাবার তৈরি না করলে আমি এখন ই চলে যাচ্ছি । না বাবা অমন করতে নেই। মা আমি আর ছোট নেই, বলেই পোষাক পরে না খেয়ে মায়ের কথা কে গুরুত্ব না দিয়ে ডিউটি যেতে উদ্য়ত হল। জোর করে মা ছেলের ডান হাত টা চেপে ধরলো। ছেলে মায়ের হাত ছিনিয়ে বের হতে গেল, মা বয়সের ভার না নিতে পেরে মাটিতে পড়ে গেল এবং মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরলো। পিছন ফিরে ছেলের দেখার সময় নেই। তখন ও কাঁদতে কাঁদতে মায়ের শেষ কথা গুলো বাতাস পৌঁছে দিচ্ছে ," আয় বাবা ফিরে আয় । যাস না । আমি আবার বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে সংসার চালাবো । তুই পাপের পথ ধরিস না" ।
কপালে র ঘাম ঝুনে ফেলার মতোই সেই কথা গুলো ফেলে ছেলে দ্রুত পায়ে চলে গেল ।দলের সর্দারের কথা শুনতেই হবে নইলে চাকরি থেকে বরখাস্ত হতে হবে। এই ভাবনা সিন্টু র মনে বদ্ধমূল হয়ে ছিল। মায়ের কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে শক্ত হয়ে এগিয়ে চললো সর্দারের ফর্মুলা মতো। লক্ষ্য পূরণ করতেই হবে। মানসিক ভাবে প্রস্তুত গৌর পুরের রায় বাড়ি র সাত বছরের কন্যা সন্তানকে হরণ করে সর্দারের হাতে তুলে দেওয়া। তাহলে ই লক্ষ্য পূরণ। ভাবনা কি , বেশ কিছুদিন চলে যাবে নিশ্চিন্তে। গভীর রাতে সকলে এক জায়গায় মিলিত হল । এবার অপারেশন শুরু। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সিন্টু পাঁচিল টপকে রায় বাড়ি চত্বরে পা রাখলো ।সর্দার এবং আরো দুজন পাঁচিলে র বাহিরে মই ঠিকিয়ে ধরে ছিল। আর একজন মই দিয়ে উঠে পাঁচিল টপকাতে যাবে কি হঠাৎ বাহিরে থেকে এক দল কুকুরের আচম্বিত ঘেউঘেউ চিৎকার , রায় বাড়ি র লোকজনের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। গোটা বাড়ি জেগে গেল। টর্চ জ্বেলে রায় কর্তা বাহিরে বেরিয়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকে। হঠাৎ দেখে ভিতরে পাঁচিলের গায়ে টগর গাছের গোড়ায় কেউ যেন ঘাপটি মেরে বসে আছে। বুঝতে অসুবিধা হল না কেউ অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে পাঁচিলটপকে বাড়ি র ভিতরে ঢুকেছে। ডাকাডাকি, হৈচৈ আর রাতে র আকাশ ফাটানো কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দে গোটা পাড়া জেগে ওঠে। যে পাঁচিল টপকাবে বলে ঠিক করেছিল সে তড়াং করে এক লাফে দে ছুট, সাথে সাথে বেগতিক দেখে সর্দার ও বাকিরা পগার পার হলেও সিন্টু র সে সুযোগ ছিল না। যেহেতু সিন্টু একা পাঁচিলের ভিতরে তাই সে ধরা পড়ল। পাড়ার লোকদের হাতে উত্তম মধ্যম খেয়ে সিন্টু একেবারে বেহুঁশ হয়ে গেল। নাক মুখ দিয়ে গল্ গল্ করে রক্ত বের হতে লাগল। থানায় খবর দেওয়া হল । থানা থেকে পুলিশ এল । সিন্টু কে থানা র গাড়ি তে করে নিয়ে গিয়ে বাকি রাত টুকু থানার লক আপে রাখা হল। পর দিন বেলা দশটার সময় মেডিকেল চেক আপ করে জেলে পাঠানো হল ।
জেলের একটি কোঠরে একা সিন্টু কে রাখা হল। বেহুঁশ অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ল। বেলা ১২ টার সময় কারা রক্ষী সিন্টু কে ডাকল। হাতে ভাতের থালা, আর তাতে ডাল সবজি দুটি আধপোড়া রুটি। সিন্টু র সারা শরীরে ব্যথা, মাথা টন টন করছে। যন্ত্রনা য় চোখ যেন ঠিকরে বের হয়ে আসছে। যে যেমন পেরেছে প্রহার করেছে । অনিচ্ছার সত্বেও সিন্টু কোন রকমে চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে রক্ষীর হাত থেকে ভাতের থালা টা ধরে নিয়ে সামনে রাখলো। খেতে ইচ্ছা করছে না। ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে ঝর ঝর করে অশ্রু বিগলিত হচ্ছে আর তখন ও সিন্টু র কানে বাজছে, "আয় বাবা ফিরে আয়। যাস না। আমি আবার বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে সংসার চালাবো। তুই পাপের পথ ধরিস না"। কয়েক ফোঁটা অশ্রু পড়লো ভাতের থালায় আর সিন্টু মা কে মনে মনে প্রণাম জানিয়ে বিড় বিড় করে বললো , 'মা , আমার মা , তুমি শুধু ই মা , তোমার অবাধ্য সন্তান কে ক্ষমা করো মা ' । সিন্টু র অনুভূতি র পরশ চোখের জলে মিশে গিয়ে যেন সমস্ত পাপ সাফ হয়ে গেল।
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট ।
-------------------------------
(সাহাচক ,আমতা, হাওড়া )
মোবাইল 9830378864