গল্প।। ফিরে দেখা।। রণেশ রায়
ভদ্রলোকের নাম রূপক। বয়স পঁচাত্তর ঊর্ধ্ব। পুরো নাম রূপক সুর। এই পল্লী অঞ্চলে বাস প্রায় চল্লিশ বছর। অবসরের বেশ কিছুদিন আগেই এখানে ঘর বেঁধেছে। ইচ্ছে ছিল ছিমছাম শহর থেকে দূরে এখানে পরিবার নিয়ে থাকবে। পরিবার বলতে স্ত্রী এক মেয়ে আর এক ছেলে। সঙ্গে বাবা মা থাকতেন। আজ তাঁরা আর নেই। ছেলে মেয়ে দুজনেই প্রবাসী। তাই পরিবারটা বহরে কমতে কমতে দু'য়ে দাঁড়িয়েছে। দুজনেই এত বড় বাড়িতে। তার মধ্যে বছরে কিছুদিন ছেলে মেয়ের ওখানে। এখানে এখন এক একাকীত্বের জীবন।
রূপকবাবু ছিমছাম মিশুকে আড্ডাবাজ মানুষ। সরেস চরিত্রের। এককালে বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাড়ি মাতিয়ে রাখত। আর অত্যাচার সহ্য করতে হত স্ত্রীকে। তিনি সেটা চিরকাল হাসিমুখে মানিয়ে নিতেন। এখন বয়স হয়েছে। বন্ধুবান্ধব অনেকে বিদায় নিয়েছে। কেউ কেউ আর বেরোতে পারে না। আড্ডাটা আর সেরকম নেই। কেউ কখনও আসে। রূপকবাবুও এর তার বাড়ি মাঝে মধ্যে যায়। তবে একান্তই অনিয়মিত। ফোনেই কাজ সারে। লেখালেখি নিয়ে সময় কাটে। তাও হাতে অঢেল সময়। তাই সময় কাটে না। এ ধরণের আড্ডাবাজ মানুষের জীবনে আড্ডার সংস্থানটা উঠে গেলে একাকীত্ব বোধটা যেন আরও চেপে বসে। মনটাও খিঁচড়ে থাকে। আর স্ত্রীর সঙ্গে কত আর কথা? সবটাই যেন একঘেয়ে হয়ে ওঠে। কখনও সখনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বন্ধু এলে ভালো লাগে সময় কেটে যায়। স্ত্রীও সেটাতে আনন্দ পায়।
এই বয়সে সবাইকে বোধহয় অতীতটা টানে। অতীতের স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে যেন মানুষ নিজেকে ফিরে পেতে চায়। রূপকবাবুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কেন হবে। সেও মধ্যে মধ্যে অতীতচারিতায় মগ্ন হয়ে পড়ে। বিস্মৃতির সমুদ্রের অতলে যেন তলিয়ে যায়। খুঁজে ফেরে সমুদ্রের অতলের রত্ন ভান্ডার। আর ওর ঘটনাবহুল জীবনে আজ অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও স্মৃতির বৈঠা বেয়ে যতটুকু হাজির হয় তা নেহাৎ কম নয় বরং বৈচিত্রে ভরপুর যেন এক মহাভারত। টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন। বিস্মৃতির অন্ধকার ঠেলে অনেক কিছু পরস্পর পরম্পরায় আলোয় আসতে পারে না বলে ঘটনাগুলো যা ভেসে ওঠে মনসাগরের ওপরের স্তরে সেগুলো ছিন্ন ভিন্ন । পরস্পরকে একটা গ্রন্থিতে বাঁধা যায় না। তাই সেগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে ওঠে। এরই মধ্যে কিছু স্মৃতি পরস্পর পরম্পরায় মনোজগতে ভেসে ওঠে, স্নায়ুর প্রাঙ্গনে খেলা করে। সেগুলো নিয়ে সময় কাটে ভালো।
স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ কৌশিকের সাথে। সেটা কর্মজীবনে দুজনের কর্মক্ষেত্র আলাদা হওয়ায় কিছুদিনের জন্য শিথিল হয়ে পড়েছিল। আজ এই শেষ বয়সে আবার ভালো করে ঝালিয়ে নেওয়া গেছে। অন্যদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ। এছাড়া আছে বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজের বন্ধু। পাড়ার ছেলে বুড়োরা। তবে আজকাল বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোন হয় না বলে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হতে বসেছে। এটা হয়েছে আরও প্রযুক্তিতে অনুরাগ থেকে যা মাদকতা বা addiction এর জন্ম দেয়। আজ সামাজিক সম্পর্কে বিচ্ছিন্নতা এনে প্রযুক্তির কল্যাণে হোয়াটস আপ এ যোগাযোগ কথপোকথন আড্ডা। তাই মনে হয় প্রযুক্তি দিয়েছে যত কেড়েছে তার থেকে বেশি। যেন রূপকবাবুর মত মানুষের মননটাই একটা ভিন্ন স্রোতে প্রবাহিত হয় এখন। আর গত প্রায় দেড় বছর করনাকালে এটা এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। সমাজের গঠন প্রক্রিয়াটাই যেন বদলে যাচ্ছে। রক্ত মাংসের প্রাণ স্পন্দনের জায়গায় গেড়ে বসতে চলেছে যন্ত্রের কম্পন, যেন এক নতুন স্পন্দন যেখানে প্রানের স্পন্দনটা আগের মত অনুভূত হয় না। তবে নেশার আচ্ছন্নতা জীবনকে ধোঁয়াশা করে তুলেছে। মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে নয় যন্ত্রের মুখোমুখি হয়ে তার সঙ্গে নির্বাক আলাপেই যেন জীবন অতিবাহিত হয়। মানুষের সঙ্গে মুখোমুখিতে যে প্রানের স্পন্দন এতদিন সে অনুভব করত সে সম্পর্কে রূপকবাবুর অনুভূতিটা:
বয়ে চলে বুকের অলিন্দে
স্রোতস্বিনী নদী
থৈ থৈ তার কলতানে
সুখের ডিঙা বেয়ে।
তাঁর আরও মনে হয়:
সেই নদী শ্রোতহারা আজ
একাকিত্বের পলি জমে
হালে পানি পায় না আর
পাল হারা সে ক্রমে।
হৃদয়ে আমার গভীর ক্ষত
রক্ত ঝরে তাতে
রক্তের নদী বয়ে চলে
তুফান ওঠে প্রাতে।
এই যে যন্ত্র নিয়ে এই মাদকতা আজ করোনা কালে, যে সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে সেটাই যেন রূপকবাবুর ওপর চেপে বসতে সাহায্য করেছে। সে অনুভব করে যেন অজানা এক আতংক সবাইকে তাড়া করে বেড়ায়। কেউ আর চায় না একজন আরেকজনের বাড়িতে আসুক পাছে করোনা সঙ্গে আসে। সে আরও বোঝে এখন যেটা মানুষ ভয়ে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য করছে সে তাকে অন্য একটা জীবনে অভ্যস্ত করে দেবে। যন্ত্র নিয়ে বসে থাকা মাদক গ্রস্ত মানুষ অন্তর্মুখী হয়ে পড়বে বেরোতে চাইবে না। সামাজিক বিচ্ছিন্নতাটাই তার কাম্য হয়ে উঠবে। এই লক্ষণ রূপকবাবু নিজের মধ্যেই দেখছেন। যেমন ওঁদের একমাত্র স্নেহের বোন যে মাত্র পাঁচ ছ কিল মিটার দূরে থাকে আজ প্রায় একবছর ওর সঙ্গে দেখা হয় না। বা রূপকবাবুর খুব স্নেহের পাত্রী শালী খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও সে তাকে দেখতে হাসপাতালে যেতে পারে নি। কাছে থাকা সত্ত্বেও তার ছেলে বারণ করার জন্য বাড়িতেও যাওয়া হয় নি। ছেলের দুটি বাচ্চা আছে। তার ভয় কেউ গেলে যদি করনা ঢোকে। তাই মায়ের বেশি কথা বলা উচিত নয় সে যুক্তিতে আত্মীয়স্বজনের প্রবেশও যেন নিষিদ্ধ। আর এই তো সেদিন মেয়ের বাড়ির এপার্টমেন্টে একজনের অনুরোধে রূপকবাবু তাঁর সঙ্গে পরিচিত একজনের ফ্ল্যাটে যায়। দরজা থেকে উনি স্ত্রী অসুস্থ অজুহাতে তাদের বিদায় করেন। রূপকবাবু এটা অনুমান করেছিল ভদ্রলোকের সাম্প্রতিক চলন বলনে। কিন্ত প্রতিবেশীর অনুরোধে যেতে হয়। তাতে তাঁর অনুমানটা সত্য বলে প্রমাণ হয়। ভদ্র সমাজে মানুষের চালচলন আঁচার ব্যবহারে এই যে পরিবর্তন তার জন্য ব্যক্তিবিশেষে কাউকে দায়ী করা যায় না। এ এক সামাজিক মনস্তত্বের পরিবর্তন যা প্রাত্যহিক জীবনে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কি জানি এটাই হয়তো নিয়ম হতে চলেছে। সে একটা রোবট চালিত জীবন যেটা নিয়ে পশ্চিমি জগত আজ উত্তাল। সমাজের যে পরিবর্তন যেটা সমাজ জীবনের যান্ত্রিকরনের ফলে নীরবে ঘটে চলেছিল সেটা করোনা আক্রমণে সরব হয়ে ওঠে ত্বরান্বিত হয় আজ ভারতের মত দেশেও। নিন্দুকরা বলে এর পেছনে একটা কায়েমী স্বার্থ কাজ করে।
যাই হোক আজ এটা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। প্রসঙ্গক্রমে উঠে এল। পাঠকরা হয়তো একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। আমরা আমাদের গল্পে ফিরে আসি। সারাদিন কম্পিউটারে মোবাইলে লেখালেখি কিছুটা পড়াশুনার পর রাতে বিছানা নিলে রূপকবাবুর অতীতটা তাঁর স্নায়ুর জগতে হানা দেয়। শৈশবের খেলাঘর থেকে কৈশোর জীবনে বিচরণ তার। কত কথা মনে পড়ে। খেলার মাঠ থেকে লেখাপড়া প্রেম বাদবিবাদ সব কিছু নিয়ে সে যেন এক উপন্যাস। তার মধ্যে জড়িয়ে থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোট ছোট টুকরো টুকরো গল্প। এ রকমই একটা গল্প রূপকবাবুর কৈশোরের প্রেম নিয়ে সেটাই যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। স্পষ্ট ভেসে ওঠে সেই কিশোরীর মুখ। তার নাম গোত্র সবই মনে আছে। মনের বাসরে আজও তার যাতায়াত। ভুলতে চেষ্টা করলেও ভোলা যায় না। বঙ্কিম চাটুজ্জের ভাষায় 'বাল্যপ্রণয়ে অভিসম্পাত আছে'। সেটা বাস্তবায়িত হয় না। সবার জীবনে কথাটা সত্য না হলেও রূপকের জীবনে সত্য। আর তা নিয়ে যেন এক অব্যক্ত যন্ত্রনা। হারিয়ে গেল সে। রূপক খুঁজে আনতে পারল না। সেটা যেন তার ব্যর্থতা। কেমন যেন একটা হেরো হেরো মনোভাব। একটা হীনমন্য মানসিকতা। হারটাকে আজও মেনে নিতে পারে নি রূপক। আর সেজন্যই বোধ হয় আজও রূপকের মানসে মেয়েটি এত সুন্দরী, আজও ভরা যৌবন তার রূপকের কল্পলোকে। তার দেহের গন্ধ যেন আজও রূপককে আবিষ্ট করে। রূপকের অনুশোচনা যে মেয়েটির সঙ্গে কোনোদিন তেমন ঝগড়া ঝাটি মনোমালিন্য হয় নি তাও বিচ্ছেদ। তার নীরবে আসা নীরবে হারিয়ে যাওয়া। মেনে নেওয়া যায় না। তাও মেনে নিতে হয় বাল্য প্রণয়ে অভিসম্পাত থাকায়। তবে রূপক ব্যর্থ প্রেমিক হলেও দেবদাস হয়ে যায় নি। পরে বিয়ে করেছে সংসার করেছে। হয় তো রবি ঠাকুরের শেষের কবিতার বন্যা ভেবেই রূপক তাকে গ্রহণ করেছে যে তার হৃদসাগরে এক সাগর যে জলে সে আজও সে সাঁতার করে। আর ঘরণী তার স্ত্রী যে ঘরার জল, তাঁর রোজের তৃষ্ণা মেটায়।
শুধু যে প্রেম কাহিনী তা নয় শৈশবের স্মৃতি বালক বেলার গুলি লাট্টু ঘুড়ি আজও রূপককে যেন ইশারায় ডাকে। ফুটবল ক্রিকেট মাঠ। মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি আবার ওদের নিয়ে কত না দুষ্টুমি। মা বাবার দৃষ্টি এড়িয়ে পড়াশুনা ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়ানো। আর আছে দেশ থেকে উচ্ছেদ হয়ে কলকাতায় কোন এক ফ্ল্যাটে বাবা মা জ্যাঠতুতো খুড়তুতো পিসতুতো ভাই বোনদের নিয়ে জনা বিশেকের যৌথ পরিবার। দাদা দিদিদের কোলে পিঠে বড় হওয়া। সে এক কোলাহল মুখর জীবন যা আজ স্মৃতি। এ ছাড়া আছে তার যৌবনের স্মৃতিকথা। রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়া। নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন রূপকএর জীবনকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। আত্মস্বার্থে নিজের রোজগেরে জীবন নয় পরার্থে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। তাকে নিয়ে গেছে জীবনের অন্য এক প্রাঙ্গণে যেখানে তার কাছে পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। খুব কাছ থেকে সে অত্যন্ত সাধারণ মানুষ তার জীবন যাপন দৈনিক জীবনের টান পোড়েন দেখেছে। তাদের স্বপ্ন স্বার্থক না হলেও তার সেদিনের সেই যৌবন তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে অনেক। সেই জন্য একই সঙ্গে সে কৃতজ্ঞ সেই জীবনের কাছে যাকে তার সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবন বলা চলে। সময়ের দিক থেকে সেটা সংক্ষিপ্ত হলেও গভীরতার দিক থেকে তা যেন অতল সমুদ্র। এই জীবনের আয়নায় সে তার নিজের জীবনের দুটো সত্তার সন্ধান পায়। তার ভেতরের সত্তা যা তার মননে তার চেতনায় এক আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠার তাগিদ অনুভব করতে শেখায়। অপরদিকে ব্যবহার জীবনে আত্মস্বার্থে মগ্ন আরেকটা সত্তা যে নিজেকে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দকে বেশী বোঝে। এ এক দ্বৈত সত্তার একই মানুষ।
সারাদিনের পর আধা ঘুমে আধা জেগে থাকা রূপকের রাত কাটে স্মৃতিচারণে। সকালে আজকাল উঠতে দেরী হয়। পায়ের জোর কমে যাওয়ায় হাটাহাটিতে অনীহা।কোষ্ঠ কাঠিন্যের এক অদ্ভুত কঠিন জীবন। সকালে উঠেই যন্ত্রের মাদকতা তাকে আকৃষ্ট করে। কেউ যদি আসেও তার সঙ্গে কথা বলার চেয়ে মোবাইল বা ট্যাবে রূপক বাবুর উৎসাহ বেশি। স্ত্রী তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে সে অসামাজিক হয়ে গেছে। যেন আত্মস্বার্থের আমিটা জেগে ওঠে রাতে যে ঘুমিয়ে ছিল। এই ভাবে তার নিজেকে নিয়ে চলে। এ জীবনে না আছে ভাড়ার ঘরে চুরি হওয়ার ভয় আবার না আছে ভাড়ারে কিছু জমা পড়ার সম্ভাবনা। এক নিস্তরঙ্গ জীবন। যেন স্রোতহীন এক মজা নদী।
রূপক সকালে যথারীতি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ মোবাইল জানান দেয় কে তাকে ডাকছে। সে মোবাইলে লেখা বন্ধ করে সে ডাকে সাড়া দেয়। ওপাড় থেকে কার কণ্ঠস্বর। রূপক চিনতে পারে না। আজকাল ও ভয়ে শিটকে থাকে। কি জানি আবার কোন জালিয়াত জাল পাতে নি তো। এই সেদিন ফাঁদে পড়ে তাকে কিছু গুনাকার দিতে হয়েছে। এটা আজ রোজের ঘটনা। সে লাইন কেঁটে দেবে ভাবতে ভাবতে ও পার থেকে জানান দেয় তার স্কুলের বন্ধু কুণাল তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। এক বন্ধুর কাছ থেকে ওর নম্বরটা পেয়ে ফোন করেছে। কুণাল মানে কুণাল মিত্র। ও পড়াশুনা শেষ করে সেই প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর হলো অন্য প্রদেশে চাকরি নিয়ে চলে গেছে। বোধহয় রায়পুর না কোথায়। তারপর থেকে যোগাযোগ নেই। ওর ফোন পেয়ে রূপক উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ওরা স্কুল টিমে একসঙ্গে খেলত। মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া সব কথা। কুণালের বাবা মা রূপককে খুব ভালোবাসতো। ওর এক বোন ছিল। রূপকের সঙ্গে ভালো পরিচয় ছিল। ওকে নিয়ে বন্ধুবান্ধব অনেকের উৎসাহ থাকলেও রূপক যেন ওর অভিবাবক ছিল। ও ডানপিটে ছিল বলে বন্ধুবান্ধব ওকে সমীহ করত। রূপক ওর অভিবাবক তথা দাদা হয়ে একটা আত্মসন্তুষ্টিতে থাকত। ওকে আগলে রাখত। এরকম একজন পাহারাদার পাওয়ায় কুণালের বাবা মাও নিশ্চিন্ত। আর টুম্পাও ওকে ভরসা করত। রূপক এই পবিত্র সম্পর্কে প্রেমের কালিমা যেন না লাগে তার চৌকিদার হয়ে উঠেছিল। তারপর কিছুদিন রূপকের সেই কৈশোর প্রেমকাহিনী যার পত্রবাহক ছিল টুম্পা। যাই হোক উত্তেজিত রূপক মোবাইলে কুণালকে নেমন্তন্ন করে। করোনার বিধিনিষেধে কিছুটা ইতি টানা হয়। কুণালও আসতে ইচ্ছে প্রকাশ করে। একটা দিন স্থির হয় যেদিন কুণাল আসবে ওর স্ত্রীকে নিয়ে। রূপক কৌশিককেও সেদিন আসতে বলবে বলে স্থির হয়।
রোববার উপস্থিত। কুণাল কৌশিকরা এসেছে। সঙ্গে ওদের স্ত্রীরা। কৌশিকের স্ত্রীকে রূপক আর রূপকের স্ত্রী চেনে। কিন্তু কুণালের স্ত্রীর সঙ্গে ওদের এই প্রথম পরিচয় হয়। রূপকের আর কৌশিকের স্ত্রীর সাথে কুণালের পরিচয় হয়। কুনাল স্কুলের বন্ধু হলেও অনেকদিন পরে স্মৃতির অন্তরালে চলে যায়। এখন চেহারায় চলন বলনে সবারই পরিবর্তন এসেছে। তাই প্রথম দর্শনেই চিনেছে একে অপরকে তা বলা যায় না। সবাই ছোটবেলার বন্ধুকে সেই ছোটবেলার আদলে চিনতে চায়। কিন্তু সময় সেটা হতে দেয় না। তাই মনের মধ্যে উথাল পাতাল সত্বেও সেভাবে নিজের করে নিতে একটু সময় লাগে। মহিলারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে যেমন একটা গ্রন্থি গড়ে তুলতে ব্যস্ত তেমনি পুরোনো বন্ধুরা স্মৃতির অলিন্দ ধরে পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের দিনগুলো ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয় বিভিন্ন ঘটনা ধরে। আস্তে আস্তে আড্ডা জমে ওঠে। আজ ওরা সবাই একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করবে। কুণাল স্ত্রীকে নিয়ে রূপকের মুখোমুখি। স্ত্রীর নাম কি ওর বাপের বাড়ি কোথায় ওদের বিয়ের বিষয় সব বিষয় আলোচনায় ওঠে। সবাই খুব অল্প সময়ে একে অপরের আন্তরিক হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে ঠাট্টা ইয়ার্কি। ছোটবেলায় কে কেমন ছিল এসব আলোচনা উঠে আসে। কুণাল রূপকের শৈশবের প্রেম নিয়ে ঠাট্টা করে। সে কুণালের সেই প্রেমিকাকে চিনত না তবে ব্যাপারটা জানত। এ ছাড়া সবার ছেলে মেয়ে নাতি নাতনীদের নিয়ে আলোচনা জমে ওঠে।
প্রথম পর্বের আড্ডার পর খাওয়া দাওয়ার পালা। সবাই একসঙ্গে বসে। মহিলারা সবাই পরিবেশন হাত লাগায়। মাছ মাংস মিলিয়ে জমাটি ব্যবস্থা। রান্না রূপকের স্ত্রীর হাতের। সঙ্গে পরিচালিকা। সবাই রান্নার বিশেষ প্রশংসা করে। কুণাল জানায় ওর স্ত্রীও ভালো উত্তর ভারতীয় খাবার রান্না করে। ও থাকতে থাকতে ওরা যদি কুণালের ওখানে যায় তবে একদিন আবার আড্ডাটা বসতে পারে কুণালের ওখানে মানে কুণালের পৈতৃক বাড়িতে যেখানে কুণালের দাদার পরিবার থাকে। দাদার বউ তাদের ছেলে আর ছেলের বউ। কুনাল জানায় কোন অসুবিধে নেই এ ব্যাপারে। ওর দাদা আর বৌদি ওদের বন্ধুর মত। সবাই রাজি হয়। খাওয়াদাওয়ার মধ্যেই রূপক লক্ষ্য করে কুণালের স্ত্রী যেন ওর ওপর একটু বেশি দৃষ্টি দিচ্ছে। রূপক যতটা পারে নীরব দর্শক। নিজেকে প্রকাশ করে না। ও সাবধান ওর প্রকাশে যেন কোন কৌতূহল না থাকে। আর কৌতূহল থাকবেই বা কেন ? ও তো আগে ওকে দেখে নি। ভাবতে ভাবতে ও একটু অন্যমনস্ক হয়ে ওঠে। খাওয়া পর্ব শেষ হয়। রূপকের অস্বস্তিটা কেউ তেমন টের পায় না। তবে হাব ভাবে বোঝা যায় রূপকের স্ত্রী যেন কিছু একটা ইঙ্গিত পেয়েছে। কি জানি বুড়ো বয়সে আবার ভীমরতি না কি!
খাওয়া দাওয়ার পর মহিলারা একটা ঘরে চলে যায় বিশ্রাম নিতে। রূপক কৌশিক আর কুনাল বসে বসার ঘরে। ওদের স্মৃতিচারণ আবার শুরু হয়। সেই স্কুল,, স্কুল প্রাঙ্গণ। স্কুলের শিক্ষকরা। বালিগঞ্জের তেমন নামম না জানা স্কুল। যাই হোক সে তো নিজেদের স্কুল। সেটা যেমন আনুষ্ঠানিক শিক্ষার উপাসনাগার তেমনি সেটা বাল্য ও কৈশোরের উপবন। একটা সমাজিকরণের প্রতিষ্ঠান যেখানে সমবয়সীদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের বন্ধন তৈরি হয়। পরিবারের বাইরের অভিভাবকদেরও চিনিয়ে দেয়। তাদের স্নেহে শুধু পাঠাভ্যাস নয়, জীবনের মূল্যবোধও তৈরী হয়। এ ব্যাপারে কোন শিক্ষক কেমন ছিলেন তা নিয়ে যে যার মত দেয়। পরিবারের মধ্যেকার বজ্রকঠিন বাঁধুনি স্কুলে বন্ধুদের সান্নিধ্যে অনেকটা আলগা হয়। তাছাড়া এই সময়ে সিগারেট খাওয়া আড্ডা দেওয়ার কু অভ্যাসগুলো তৈরি হয়। আপাত কুঅভ্যাসগুলো জীবনে যে প্রাণশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে সেটা কথায় কথায় ওঠে । আজকের শিশুদের মত পড়ার চাপ তখন ছিল না। প্রথম দ্বিতীয় হওয়ার পরস্পর প্রতিযোগিতা ছিল না। যতটুকু পড়াশুনা সেটা স্বেচ্ছা কল্প। বাধ্যতামূলক নয়। পাশ করা নিয়ে কথা। তাই একইসঙ্গে খেলাধুলার সঙ্গেও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠত। স্কুলে উঠোনে গুলি খেলার রীতি ছিল। টিফিনে সেটাতে বারণ ছিল না। পড়াশুনায় প্রথম দ্বিতীয় হওয়ার প্রতিযোগিতা না থাকলেও দুষ্টুমিতে প্রতিযোগিতা ছিল। কে কত বেশি দুষ্টু হতে পারে। আর দুষ্টুমির জন্য মাষ্টারমশাইদের ঠিক করে দেওয়া এক এক ধরণের শাস্তি উপহার হিসেবে পাওনা ছিল। হাতে বা পিঠে বেত্রাঘাত, নিলডাউন, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ইত্যাদি। আবার কোন কোন শিক্ষকের কথা মনে পড়ে যারা দুষ্টুমির জন্য নয় শাস্তি দিয়ে আনন্দ পেতেন বলে শাস্তি দিতেন। যারা দুষ্টুমি করার জন্য শাস্তি দিতেন তাদের ওপর রাগটা স্থায়ী হত না। ওটা প্রাপ্য বলে ছাত্ররা মেনে নিত। কিন্তু যারা আনন্দ পাবার জন্য শাস্তি দিত তাদের ওপর রাগটা স্থায়িত্ব পায়। রূপকদের স্কুল পড়াশুনায় সামনের সারিতে না থাকলেও খেলাধুলায় প্রথম সারিতে থাকত। বিশেষ করে ক্রিকেটে বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। স্কুল থেকে ভালো ভালো খেলোয়াড় উঠে এসেছে যারা রাজ্যের হয়ে এমনকি দেশের হয়েও খেলেছে। নানা বিষয়ে অতীতচারিতায় সময় কেটে যায়। চা আসে। সবাই চা নিয়ে বসে। স্ত্রীরাও যোগ দেয়। চা খেয়ে এবার ফেরার পালা। ফিরতে না চাইলেও সবাইকে ফিরতে হয়। এর পর কুণালের বাড়িতে দেখা হবে আশা করে যে যার বিদায় নেয়।
সবাই চলে যাওয়ার পর রূপকের স্ত্রী রূপককে নিয়ে ঠাট্টা শুরু করে। জানায় সে লক্ষ্য করেছে কুণালের স্ত্রীর বিশেষ নজর ছিল ওর ওপর। আর কুণালের চোখেও এক বিস্ফোরণ। কি ব্যাপার বুড়োবয়সে পরস্ত্রীকাতরতা। কুনাল ঠাট্টা করে বলে বিবাহ বহির্ভূত এই সম্পর্ক অস্বাভাবিক কি? ওর ভেতর একটা পৌরুষ আছে বলেই তো ওর প্রতি মহিলাদের আকর্ষণ। এটা তো নতুন কিছু না। রূপক এটাও জানায় যে কুণালের স্ত্রীর সঙ্গে আগে ওর পরিচয় ছিল না । এই প্রথম। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে তার কৈশোর প্রেম সম্পর্কে রূপক নিজেই তার স্ত্রীকে জানিয়েছিল। সেটা তুলে খোঁটা দিতে মিতা তাকে ছাড়ে না।
রূপকের এই আড্ডার পর কেমন যেন পরিবর্তন আসে। সে যেন তার পুরোনো সত্তাটা ফেরত পায়। দুদিন মোবাইলে কোন কাজ করে না। পাড়ার পুরোনো ভাঙা আড্ডাটায় বেলার দিকে যায়। আবার সেই পুরোনো পরিবেশে আগের সবাক রূপক। যেন মৌনব্রত ভঙ্গ করে। একাকীত্বের স্তব্ধতার শ্মশান থেকে উঠে দাঁড়াতে চায়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের নীচে নিজেকে পেতে চায়। করোনা আক্রমণের ভয়ে গুটিয়ে থাকতে চায় না। কিন্তু ও চাইলেই তো হবে না। সামাজিক পরিবেশ তার সহায়ক নয়। তাও সবকিছুতে আরও আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে চাইছে। তার এই চেষ্টার দিন তিনেক পর এক সন্ধ্যায় কুণাল এসে হাজির। ও একাই এসেছে। রূপক খুব খুশি হয়। জানতে চায় কুণালের স্ত্রী আসে নি কেন। কুণাল জানায় ও আসতে পারে নি। তবে একটা চিঠি পাঠিয়েছে রূপকের উদ্দেশ্যে। চিঠিটা ও রূপকের হাতে দেয়। রূপক অবাক হয়ে চিঠিটা খুলে পড়তে থাকে:
প্রিয় রূপক
কাল বোধ হয় আমাকে চিনতে পারো নি। বয়স হয়েছে। বদলে গেছি। তাই না চেনা স্বাভাবিক। তবে আমি তোমায় দেখেই চিনেছি। সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তের জন্য ফিরে গেলাম সেই আমিতে। সেদিনের চিত্রা। আমাদের বিচ্ছেদের প্রায় দশ বছর পর কুণালের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। আর বিয়েতে ঘটকালি করে তোমার স্নেহধন্যা টুম্পা, কুণালের বোন। টুম্পাকে চিনলেও কুণালকে আমি চিনতাম না। কুণালও আমাকে চিনত না। টুম্পা আমাদের বিয়ের খবরটা গোপন রেখেছিল তোমাকে বলে নি তুমি আঘাত পাবে বলে। যাই হোক তারপর প্রায় চল্লিশ বছর কেটে গেছে। আমরা মানিয়ে নিয়েছি। ছেলে মেয়েকে নিয়ে সংসার করছি। তুমিও তাই। যে কোন কারণে আমাদের বিয়েটা হয় নি। আর সেজন্যই বোধ হয় টানটা বেড়েছে। তাই দেখেই চিনেছি। তবে জানান দিই নি। জানি না তুমি বোধ হয় আমাকে চেন নি বা চিনতে চাও নি। ভালোবাসা জেনো
ইতি
টুম্পা
চিঠিটা পড়ে রূপক মাথা তুলে কুণালের দিকে তাকাল। কুণাল জানতে চাইলো রূপক কি বুঝলো। রূপক হেসে উত্তর দিল:
হ্যাঁ অনেকদিনের ব্যাপার তো। একটু ঝালিয়ে নিলাম।
কুণাল বলল, "চিত্রা আমাকে সব বলেছে। তুই আর সংকোচ করিস না। সেদিন ওকে তুই চিনতে চাস নি"।
রূপক জানায় সেও চিত্রাকে চিনতে ভুল করে নি। তবে হ্যাঁ চিনতে চায় নি।
রূপক কুণালের কাছ থেকে টুম্পার ফোন নম্বরটা চেয়ে নেয়। কুনাল চলে গেলে মোবাইলে টুম্পাকে ফোন করে। সে বলে:
''টুম্পা তুমি তোমার দাদার সঙ্গে চিত্রার বিয়েতে ঘটকালি করেছ অথচ আমাকে জানাও নি। একেবারে হাইজাক করে ওকে নিয়ে গেলে !''
টুম্পা ওপাস থেকে জানায়:
"কোথায় হাইজাক করলাম। তোমাদের বিচ্ছেদ তো আগেই হয়ে গেছে। তুমি তো তখন নিজের জন্য গুছিয়ে নিয়েছ। তোমার বিয়ের বেশ কিছু পর ওদের বিয়ে হয়েছে। অসুবিধে কোথায়? চিত্রাদি নিজের জীবন গুছিয়ে নিক সেটা তুমি নিশ্চয় চেয়েছিলে কারণ ওকে তুমি ভালোবাসো। তোমাকে জানানোটা দরকার ছিল না। দাদাকেও তোমাদের সম্পর্কের কথা জানাই নি।" রূপক আর কোন কথা বলে না।