গল্প।।ডাইনি ।। রতন চক্রবর্তী
ডাইনী
রতন চক্রবর্তী
এক,
কলাতলিতে বাসটা এসে যখন থামলো, তখন রাত একটা বেজে দশ। চারদিক নিরব আর নির্জন। একটা দোকানপাটও খোলা নেই। এখন কী করবে তাই ভেবে পাচ্ছেনা অনিকেত। পিচ ঢালা রাস্তাটার এ মাথা থেকে ও মাথা একবার চোখ বুলালো সে। একটা কুকুরও নোই রাস্তায়। হাতের ডান দিকে একটা ইট বিছানো রাস্তা নোমে গেছে। চলে গেছে নিশিন্দা পুর। ওখানে অনিকেতের বাড়ি।হঠাৎ অফিস তিন দিনের ছুটি পড়ে গেলো। তাই সে আর দেরি করেনি। সোজা বাড়ি। তার বাড়ি কোলকাতা থেকে অনেকটাই দূর। তার উপর, রাস্তায় দীর্ঘ জ্যামোর কারণে আজ এই ভোগান্তি।
এই রাস্তা হাতের তালুর মতো চেনা, অনিকেতের। পথ চলতেও সমস্যা নেই আজ। আকাশে পূর্ণ চাঁদ আছে। চার পাশে থৈ থৈ জোৎস্না।
দুই,
সামনে একটা বড় আর মোটা চালতা গাছ আছে। এই গাছটা, একটা কালভার্ড পাড় হলেই। কালভার্ডটা পেরিয়ে এসে, একটু হাঁটতেই থমকে দাঁড়ালো অনিকেত। চালতা গাছের একটা ডাল থেকে একটা মেয়ের লাশ ঝুলছে! বুকের ভেতর কলজেটা লাফিয়ে উঠলো অনিকেতের। মেরুদন্ড বেয়ে একটা, ভয়ের শীতল স্রোত নিচের দিকে নেমে গেলো তার। ওটা মানুষ না অন্য কিছু!
হঠাৎ সে খেয়াল করলো,ফাঁসের দড়িতে ঝুলন্ত মেয়েটা ঝাঁকি খাচ্ছে। তার মানে মেয়েটা এখনো মরেনি! হয়তো কোন কারণে আত্মহত্যা করতে এসেছে। মনের সব ভয় চলে গেলো অনিকেতের। দৌড়ে গেলো সে, গাছটার নিচে। দ্রুত গাছ বেয়ে উঠে গেল উপরে। যে দড়িটায় মেয়েটা ঝুলছে, সেটার বাঁধন খুলে দিলো। ধুপ করে মেয়েটা রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো। গাছ থেকে নেমে এলো অনিকেত।
মেয়েটা যেখানে পড়ে আছে, সেখানে, মেয়েটার মাথার কাছে বসলো সে। মেয়েটার গলার দড়িটা খুলে দিলো। পিঠের ব্যাগ থেকে জলের বোতল টা নিয়ে, মেয়েটার মুখে ঢেলে দিলো সে। সেয়েটা জল খাচ্ছে। যাক বাঁচানো গেলো তাকে।
তিন,
মেয়েটা উঠে বসলো। অনিকেতের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। অনিকেত জিজ্ঞেস করলো, 'বাড়ি কোথায়?'
আঙুলি নির্দেশ করে মেয়েটা যে দিকটা দেখালো, সে দিকে, একটা নদী আছে। সে নদীর পাশে আছে একটা জঙ্গল। ওখানে কোন বসতি আছে বলে অনিকেতের জানা নেই। সে মেয়েটিকে আবার জিজ্ঞেস করলো, 'এভাবে মরতে এলে কোন দুঃখে? '
মেয়েটা কী বললো বুঝা গেলোনা। মেয়েটাকে ধরে দাঁড় করালো সে। বললো, 'চলো তোমাকে বাড়ি ছেড়ে আসি।'
মেয়েটা অনিকেতের সাথে হাঁটতে লাগলো। অনিকেতকে নিয়ে মেয়েটা রাস্তা ছেড়ে চষা ক্ষেতে নেমে এলো। হাঁটতে লাগলো নদীর দিকের জঙ্গল বরাবর।
মেয়েটা যখন অনিকেতের চোখে চোখ রেখে ম্লান হেসে ছিলো, তখনই অনিকেতের যেনো কী হয়ে গেছে।
সে কিছু ভাবনা চিন্তা না করেই মেয়েটার পিছু নিয়েছে। মেয়েটাকে এখন স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। অনিকেত বিহ্বলের মতো হাঁটতে লাগলো। ধীরে ধীরে সে নদীর কাছের জঙ্গলটার ধারে চলে এলো। মেয়েটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলো, একেবারে জঙ্গলের কিনারা ঘেঁষে।
চার,
অনিকেতের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো মেয়েটা। মোহনীয় ভঙ্গিতে হাসলো। তার রূপের ছটায় আবারও বিমোহিত হয়ে গেলো অনিকেত। তার হাত পা অবশ হয়ে গেলো। তার মনে হলো, এই বিশ্ব চরাচরে এই মেয়েই যেনো তার জীবনের সব কিছু।
মেয়েটার পিছু নিয়ে সে জঙ্গলের ভেতর প্রবেশ করলো। জঙ্গলের গাছ-পালার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে চাঁদের আলো মাটিতে ঝালর কাটছে। হঠাৎ বনের ভেতর হুটোপুটি শুরু হয়ে গেলো। চারপাশের গাছের উপর থেকে, কারা যেনো, ধুপ্ ধাপ্ করে মাটিতে লাফিয়ে পড়তে লাগলো!
ঠিক তখনই সম্মোহন ভেঙে গেলো, অনিকেতের। সে যেনো বাস্তবে ফিরে এলো।
দেখলো, তার চারপাশে যারা গাছ থেকে লাফিয়ে পড়েছে, তারা সব ক'টাই মেয়ে। ঠিক সে মেয়েটার মতো, যাকে সে আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচিয়েছে! যার পিছু পিছু সে এখানে এসেছে। হঠাৎ তার পিলে চমকে দিয়ে আর রাতের স্তব্ধতা খান খান করে দিয়ে, সব ক'টা মেয়ে খিল খিল করে হেসে উঠলো।
আর ঠিক তখনই অনিকেতের মনে পড়লো, এই জঙ্গলকেই লোকে ডাইনীর জঙ্গল বলে!
★★★★
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট ।
---------------------------------------------------
রতন চক্রবর্তী,
বিবেকানন্দ রোড,
(সাহারা বিল্ডিঙের পাশের গলি)
চাঁপাডালি মোড়, বারাসাত,
কোলকাতা-৭০০১২৪।
মোবাইলঃ ৯০৭৩২১৬২৩৭