বিকাশ বর
বাজার সেরে ফিরছি । হেলেদুলে চলেছি। আমি কাঠ বেকার মানুষ। তাড়া নেই। তড়িঘড়ি নেই। কাজ বলতে নিত্যকার বাজার করা আর সংসারের ফাইফর্মাস খাটা। কাজ না থাকলে বাজারঘাট অলিগলি টো টো করে ঘুরে বেড়াই। প্রত্যহ লাঞ্ছনা গঞ্জনা জোটে। বাবা ,দাদা এমনকি মার কাছ থেকেও!
চিরদিন কেউ বেকার থাকে নাকি ! চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। নিজের উপর বিশ্বাস আছে একদিন ঠিক একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলব।
সামনে হরকবিরাজ কাকুর বাড়ির সামনে মানুষের জটলা। হরকাকুর বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে বাজার যেতে হয়। যাওয়ার সময় কাউকে তো দেখিনি। এর মধ্যে আবার কী হল ! ঝামেলাটামেলা হয়েছে নাকি ! দ্রুত পা চালিয়ে এগোলাম। হর কবিরাজকাকু নির্বিবাদ মানুষ। পরোপকার ছাড়া কিছুই বোঝেন না। শহরতলীর আমাদের এই ছোট্ট শহরটায় অনেক পাশকরা ডাক্তার আছেন। বেশ ক'একজন হাতুড়ে ডাক্তারও আছেন। এঁদের মধ্যে হর কবিরাজ শহরের একমাত্র কবিরাজ। গরিব দুখীদের বিধান রায়। বিনাপয়সায় অব্যর্থ ওষুধ। শেকড়বাকড় জড়িবুটির একেবারে অব্যর্থ দাওয়াই। পাড়া বেপাড়ার লোকজন ধন্বন্তরী বলেন। এমন সজ্জন মানুষ আবার কী ঝামেলায় জড়িয়ে গেলেন ! ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। খবরটা শোনার পর সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে গেল। মিনিট দশেক আগে হরকাকু আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। বয়স হয়েছিল। তা বলে এমন কিছু অসুস্থ ছিলেন না যে পাততাড়ি গুটোতে হল! বুকের ভিতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। চাপা কান্না বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমার পায়ের বুড়ো আঙুলে নখকুনি হয়েছিল। সেপটিক হয়ে পুরো পা ফুলে ভীমের গদা। পাশকরা ডাক্তার দেখিয়ে, ওষুধ ইঞ্জেকশন নিয়েও কিছুতেই সারছিল না। শেষে হরকবিরাজকাকুকে দেখাই। একেবারে মিরাক্যেল ! সাতদিনে পা শুকিয়ে, যন্ত্রণা কমে পুরো ফিট। বাবা চিকিৎসার খরচের কথা তুলতে একেবারে হা হা করে উঠলেন। অনেক পীড়াপিড়ীর পর একশো টাকা নিলেন। সেসব কথা আমি জীবনে ভুলব না। সেই ধন্বন্তরী মানুষটা বলা নেই কওয়া নেই চলে গেলেন ! হরকাকুর এক ছেলে। বিদেশে থাকে। শুনলাম আসতে পারবে না। হর কাকীমা বছর পাঁচেক আগে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। বাড়িতে তেমন কেউ নেই যে হাত-পা ছড়িয়ে কান্নাকাটি করবে। বাইরে আমরা যারা আছি সবাই কেমন চুপচাপ। কান্নাকাটির আওয়াজ নেই বলেই শোকের আবহটা তেমন নেই।
একছুটে বাড়িতে বাজারের থলেটা রেখে কাউকে কিছু না জানিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে হরকাকুর বাড়ি। ডেডবডি অকারণ বাড়িতে ফেলে রেখে লাভ নেই। মৃতসৎকারের গাড়ি এসে গেছে। সবাই হরকাকুকে ধরাধরি করে বাইরে আনল। পাড়ার দেবুকাকুকে চুপিচুপি বললাম , আমি শ্মশানে যাব। দেবুকাকু এককথায় রাজি হয়ে গেল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। অন্তত হরকাকুর প্রতি কিছুটা হলেও কৃতজ্ঞতার ঋণ স্বীকার করা গেল।
গঙ্গার পাড়ে শ্মশানঘাট। চুল্লিতে দেহ সৎকার হবে। তার আগে অনেক ফর্মালিটি আছে। অনেক কাজ। শ্মশানফিস, পৌরসভারফিস, ট্যাক্স--অনেক হ্যাপা। নরম্যাল ডেথরিপোর্ট দেখিয়ে তবেই সব কাজ হবে। আমি কোনো কাজের লোক না হলেও সব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। সবসময় দেবুকাকুর পাশে পাশে আছি। যদি কোনো কাজে আসি।
বাইরে শ্মশান চাতালে আরো তিনটে ডেডবডি এসেছে। খোল করতাল বাজিয়ে হরিনাম হচ্ছে। দেদার খই পয়সা ছড়ানো হচ্ছে। তিনটে হাড়জিরজিরে বাচ্চা পয়সাগুলো কুড়িয়ে পকেটে ভরছে। বাচ্চাগুলোর বয়স ছয় থেকে আটবছর হবে। গায় খড়িওঠা রুক্ষচুলের রুগ্ন শরীর। কাদের বাচ্চা এরা ! শ্মশান চাতালে নিমগাছের নীচে দু'জন উদোম গায়ে গামছা পরে বসে। তাদেরকে বাচ্চাগুলোর কথা জিজ্ঞেস করলাম। তারা বেশ প্রাণ খুলে হাসল। বলল, --আমাগো ছেলেপুলে বাবু। শ্মশানঘাটে ডোমেদের ছেলে ছাড়া আর কার হবে ! দেবুকাকুরা অফিসের কাজকর্ম সারছেন। হরকাকুর সৎকারের সময় কখন হবে আমার জানা নেই। দাহ করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাবে নিশ্চয়ই। মোবাইলটা বাড়িতে ফেলে এসেছি। যদিও বাড়ির সবাই আমার কীর্তিকলাপ জানে তবুও একটা দুশ্চিন্তা তো হবেই। মনে মনে ভাবলাম, এতক্ষণে ওরা সব জেনে গেছে নিশ্চয়ই।
বললাম, - ছেলেদের স্কুলে পাঠাও না ? এখন তো স্কুলে পেটপুরে খেতে দেয়।
ওরা আমায় জুলুজুলু চোখে দেখছে। বলল, -বাপ-ঠাকুরদার কাজ, বংশ, বংশ ধরে চলে আসছে । আমাগো ছেলেপুলে সেডাই করবে। ওই ইসকুল- টিসকুল আমাগো পেটে ভাত দেবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। মোক্ষম বুঝেছে। হায়রে আমার সর্বশিক্ষা অভিযান ! এদেরকে বোধহয় কেউ হিসেবের মধ্যে ধরে না।
দেবুকাকুর মুখে শুনলাম, একজনের পর হরকাকু দাহ হবে। তারমানে এখনোও ঘন্টাদুয়েক। একজায়গায় বসে এই শোকরাজ্যে ডুবে থেকে মনের বোঝা আর বাড়াতে চাই না। বরং একটু এদিক ওদিক ঘুরে আসি। শ্মশানচাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম।
বড়রাস্তার গা ঘেঁষে শ্মশানটা। রাস্তায় এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। একটু মেঘ মেঘ করেছে। বসন্তে মেঘ একেবারে অস্বাভাবিক নয়। তবু কেন যেন মনে হল, হরকাকুর জন্য তো কেউ কাঁদল না হয়তো আকাশটা কাঁদবে। রাস্তার বাঁকে এসে থমকে গেলাম। পা দুটো স্থির হয়ে গেল। যেন ফেভি কুইক দিয়ে কেউ এঁটে দিয়েছে। একটা বছর কুড়ি-বাইশের মেয়ে হাত পেতে বসে। কোলে একটা বছর তিনেকের বাচ্চা। পাটকাঠির মত জীর্ণ শরীর। পরনে শতছিন্ন তেলচিটে শাড়ি। ফর্সা রং তেলময়লায় কালি পড়ে গেছে। নিজের শরীরের ভার নিজেই বইতে পারছে না। থর থর করে কাঁপছে। পিছনে বাড়ির দেওয়ালে হেলান দিয়ে আছে। "সবার পেটে অন্ন" কথাটার অর্থ বুঝতে পারলাম না। কতদিন খায়নি মেয়েটা ! বাজার করে কুড়িটাকা বেঁচেছিল। মেয়েটার পাতাহাতে রাখলাম। মেয়েটা আমাকে দেখছে। এক দৃষ্টে। মানুষ না ভূত দেখছে কেজানে ! এগিয়ে গিয়ে বললাম, --নাম কী ? উত্তর এল, --ফুলমতী। --তোমার বর কী করে ? মেয়েটা আবার আমায় দেখছে। এরকম প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না বোধহয়। কেমন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে যেন উত্তর দিল, --পালিয়ে গেছে। বউ ছেলে ছেড়ে ভেগেছে। বুঝতে পারলাম, ভিক্ষাই এর জীবিকা। বললাম, --কাজ করবে ?
--কে কাজ দেবে ?
--আমি ঠিক করে দেব। জিজ্ঞেস করলাম, --থাক কোথায় ?
--ওই গঙ্গার পাড়ে ঝুপড়িতে।
বললাম তো বটে, কাজ কোথায় পাব ! নিজের কোনো কাজ নেই, আবার অন্যের কাজ ! মনে পড়ে গেল ভোলাদার কথা। বাজারে ভোলাদার ভাতের হোটেল আছে। চালু হোটেল। সস্তায় মাছভাত, ডিমভাত। বাস লরির ড্রাইভার ,কন্ডাকটর ,কুলি মজুর-- অনেক দোকানদার ভোলাদার হোটেলে খায়। সবাই তো বলে, পরিষ্কার পরিছন্ন ভাল খাবার। একবার ভোলাদাকে বলে দেখব। দরকার হলে হাতে ধরে রিকোয়েস্ট করব। ফুলমতীর একটা কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। সে যেভাবেই হোক !
ভালোয় ভালোয় সবদাহ হয়ে গেল। বিকেল গড়িয়ে বাড়ি ফিরলাম। বুকটা কেমন খালি খালি লাগছে।
পরের দিন ভোলাদার হোটেলে গেলাম। ভোলাদা আমায় দেখে এগিয়ে এল, বলল, --বীরেশ্বর যে, পথভুলে এদিকে--
ভোলাদার হাত ধরলাম। পাশে বসালাম। ফুলমতীর কথা যতটা পারি গুছিয়ে বললাম। বললাম, --একটা কাজের ব্যবস্থা করে দাও ভোলাদা। খুব অভাবি মেয়ে। যা হোক মাইনে পাবে, আবার পেটপুরে খেতেও পাবে।
ভোলাদা মাথা চুলকে বলল, --একটা কাজের মেয়ের দরকার আছে বটে। তুই বলছিস যখন মেয়েটাকে কাজে লাগিয়ে দে। হাজারের বেশি মাইনে দিতে পারবো না। দু'বেলা পেটপুরে খেতে পাবে। মাসের পয়লায় কাজে লাগিয়ে দে। যুদ্ধ জয়ের আনন্দে একেবারে লাফিয়ে উঠলাম। বিজয়োল্লাসে ভোলাদাকে জড়িয়ে ধরলাম।
দু'দিন পর শ্মশানঘাটে গেলাম। শ'তিনেক টাকা সঙ্গে নিয়ে গেছি। ফুলমতীর জন্য একটা শাড়ি কিনবো বলে। রাস্তার বাঁকে যেখানে ফুলমতী বসেছিল সেখানে গেলাম। ফুলমতী নেই। আজ কী এখানে বসেনি ! নাকি সবদিন বসে না। আমার যে আজ যে ভাবেই হোক ফুলমতীর সঙ্গে দেখা করতেই হবে। গঙ্গার পাড়ে বস্তিটায় গেলাম। যাদের সঙ্গে দেখা হল, তাদেরকে ফুলমতীর কথা জিজ্ঞেস করলাম। কেউ ঠিক বলতে পারল না।
সামনের দিকে আরো এগোলাম। একটা বয়স্ক মহিলা বসে ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। বুড়ি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। ---ফুলমতীর কথা বলচো, সে তো কাল মইরে গেচে। পোড়ারমুখী খুপ অভাগী ছেল কিনা। কঠিন অসুখে ভুগ চিল। ভিক মেগে আর কতদিন চলে ! মরে বেঁইচে গেচে অভাগী। হাত-পা অবশ হয়ে গেল। ধক করে খানিকটা বুকের রক্ত চলকে পড়ল যেন। ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়লাম। ফুলমতী নেই ! খানিকটা সামলে নিয়ে বললাম, --ফুলমতীর বাচ্চাটা ?
---আমার কাচে। দিনভোর কেদে কেদে
ঘুমিয়ে নেতিয়ে গেচে।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হল। ফুলমতীদের জন্য আমাদের কী কিছুই করার নেই ! "সর্ব শিক্ষা" আর "সবার পেটে অন্ন" করে আমরা কী শুধু শুধুই হেঁদিয়ে মরছি !
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট
----------------------------------------
বিকাশ বর
রায়পাড়া বাইলেন
সিঁথি(দমদম)
কলকাতা:-৫০
ফো: 9038263360