ছোটগল্প ।। প্রকৃতির দান ।। চন্দন চক্রবর্তী
প্রকৃতির দান
চন্দন চক্রবর্তী
প্রকৃতি হল মায়েরও মা ।
বাংলার মাস্টার মশাই বলেছিলেন কথাটা । কথাটা যে কত দূর সত্যি !
বিকেল চারটেয় চাপরামারী অভয় অরণ্যের বাংলায় এসে পৌঁছেছি । সবে দু আড়াই ঘন্টা হয়েছে এর মধ্যে এত দূর !
বনবাংলোর বারান্দায় চা খেতে খেতে চমকে উঠলাম গান শুনে ! হ্যা একটা গান শুনে !
"আজ জ্যোস্না রাতে সবাই গেছে বনে"
এখন আমার কি যে হচ্ছে কি বলি ।
আজ পূর্ণিমা । আকাশে থালার মত চাঁদ । জ্যোৎস্না বনভূমির মাথার ওপর পড়ে উছলে উঠছে নদীর বুকে জোয়ার উথলে ওঠার মত । থেকে থেকে হরেক জানোয়ারের ডাক ভেসে আসছে,ভেসে আসছে অসংখ্য পোকা মাকড়ের ঐকতান;কটকট,টিকটিক,আরো কত রকমের । তারই মধ্যে চেনা গলায় গানটা শুনে চমকে উঠলাম !
এবার দেখতে পাচ্ছি । বাংলোর সামনে বেশ খানিকটা জমির পরেই একটা খাদ সরাসরি নীচে নেবে গেছে । গলা শুনে বুঝি,খাদের ধারে বসে আমার বোন নমিতা গান গাইছে ! আর পাশে দাঁড়িয়ে যে আমার সহকর্মী শুভম আমি নিশ্চিত । এই মখমল জ্যোৎস্নায় এত দূর থেকে ওদের ছায়া ছায়া আভাস পাচ্ছি ।
ভাবছেন তাতে চমকে ওঠার কি আছে ! আছে তো বটেই ।
তবে শুনুন । এখানে এবারে আমাদের আসা বেড়ানোর অভিলাষে নয় ।
দাদা বলে বলছি না,আমার বোন অসামান্যা সুন্দরী । আমার থেকে তার বয়সের ফারাক অনেক । ছোট বেলায় মাকে হারিয়ে সে আমার কাছেই মানুষ । সেই বোনের মুখে প্রায় দু বছর হাসি ফুরিয়েছে,সে কান্না ভুলেছে । সে হাসে না,কাঁদে না,কথা বলে না ।
তার হৃদয় বিদারী কাহিনী যে শুনবে চোখের জলে ভাসবে । আর আমি তো এক কথায় এখন তার দাদা,মা,বাবা,সব । বিয়ের পর যে অত্যাচার তাকে সহ্য করতে হয়েছে ভাবলে আমি রাগে দুঃখে অধীর হয়ে যাই ।
প্রথম যৌবনেই তার বিয়ে হয়েছিল এক পুরুষত্বহীন,বিকারগ্রস্তের সঙ্গে । বিয়েটা তড়িঘড়ি করে দিতে হয়েছিল বাবার ইচ্ছেয় । বাবার তখন ভারী অসুখ । এই যায় কি সেই যায় । আমি একা ছোটাছুটি করে সব দিক সামলে উঠতে পারিনি । ভালো করে খোঁজ খবর নেওয়া হয়ে ওঠেনি । ওর বিয়ে হয়ে যাবার পর বাবা আর বাঁচেন নি । কিন্তু বিয়েটা ওর জীবনটাকে ধূলিসাৎ করে দিল ।
ডাক্তারদের ধারণা,তাই বা কেন ;আমারও ধারনা,আমার বোনের ওপর পাশবিক অত্যাচারের কারণ ছেলেটির অক্ষমতা । ওদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে । কিন্তু অমানুষিক দৈহিক,মানসিক অত্যাচার,কোর্ট কাঁচারী,গালিগালাজ,বাবার মৃত্যু,এত কম বয়সে এত কিছু ও আর সহ্য করতে পারেনি ।
ডাক্তারদের মতে,হওয়া বদল করলে উপকার পাওয়া যেতে পারে,তাই এখানে আসা ।
এবার শুভমের কথা বলি । শুভম আমার ছাত্র । আগে আমার বাড়ি টিউশন নিতে আসতো । তখন থেকেই আমার বোনকে সে চিনত । এখন সে আমার স্কুলেই শিক্ষকতা করে । নিখাদ ভদ্র ছেলে । বোনের দুর্দশা দেখে সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে যাতে বোনকে সুস্থ করা যায় । এটা মনে হয় ঈশ্বরের কৃপা । নইলে ডাক্তারদের মত,এতে যে বোনের খুব উপকার হবে,তাতে কোন সন্দেহ নেই ।
প্রথম প্রথম শুভমকে দেখে আমার বোনের কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ পেতো না । কিন্তু ইদানিং মনে হয় আমার বোন ওর কথা শোনে,তবে কথা অবশ্য বলে না । বোনের পুরুষেদের ওপর ঘৃণা,অবিশ্বাস,ভয় থাকাও অসম্ভব নয় । আমি প্রথম প্রথম ভয় পেয়েছিলাম,বোনের তাতে আরো খারাপ কিছু না হয় । কিন্তু না;শুভমের আন্তরিক চেষ্টায় মনে হয় ও যেন সাড়া দিয়েছে !
মোটের ওপর দুটো বছর শুভম প্রায় রোজ বোনের সঙ্গে মেলামেশার চেষ্টা করেছে । কিন্তু তবুও বলার মত তেমন কিছু নয় ।
কিন্তু আজকে ! আজকে যেটা ঘটেছে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না !
বাংলোতে এসে ঘর দেখা,হাতে মুখে জল দেওয়া,সারতে পাঁচটা বেজে গেল । তখন আমার বোন ওর নিজের ঘরেই ছিল । বনবাংলোর ঘরগুলো ঘিরে চার ধারে বারান্দা । ওঠা নাবার সিঁড়ি । সুবিধা মত এক জায়গায় টি টেবিল ঘিরে অনেকগুলো ভারি সুন্দর বেতের চেয়ার । আমি যখন বারান্দায় এসে লোকাল খবরের কাগজটা উল্টোছি, দেখলাম,দূরে বারান্দার এক কোনায় বোন দাঁড়িয়ে ।
চায়ের অর্ডার দিয়ে স্ত্রীকে বললাম শুভমকে ডাকতে । ও তখন ওর ঘরেই ছিল । এক ফাঁকে এসে চা খেয়ে গেল । আমার স্ত্রী কিন্তু বোনকে ওর জায়গা থেকে একচুলও নাড়াতে পারে নি । তখন আন্দাজ ছটা বাজে ।
স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করছিলাম । খেয়াল করিনি কখন ওরা নীচে নেমে গেছে !
গান শুনে একবার মনে হয়েছে ছুটে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে আদর করি । ওর মুখের দুটো কথা শুনি । না তা করি নি । যদি তাতে বিপদ হয় !
এখন বোনের এক তরফা কথা কানে আসছে । মনে হয় ওর মনের জমা ক্ষোভ,যত না বলা কথা হৃদয়ে এতদিন গুমরে মরেছে,বর্ষার ঢল নামার মত বেগে ধাবিত হচ্ছে ।
ভালো থাকুক বোন । জীবনের কাছে যেটুকু ওর চাওয়া পূর্ন হোক ।
ভাবছি,বোন ওখানে গেল কি করে । নিশ্চয়ই ওর মনে কোন পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে । সেটার কারণ যদি শুভম হয়,তবে আগেই সেটা হতে পারতো । আমার মনে হয়,বন থেকে ভেসে আসা শত শব্দ,জোৎস্নায় মাখামাখি অরণ্যের যে শোভা তাই অনুঘটকের মত কাজ করেছে । শব্দগুলো যেন মায়ের মুখের ঘুম পাড়ানি গান । প্রকৃতি যেন ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে বনভূমিকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে । তার কোমল মধু ঝরা কন্ঠ যা হৃদয়ে মুচড়ে ওঠা বেদনাকে প্রশমিত করে । মা'ই বোঝে সন্তানের বুকের জ্বালা । সন্তান পারে মায়ের কাছে তার না বলা দুঃখ উজাড় করতে ।
"প্রকৃতি হল মায়েরও মা" । মাস্টার মশাইয়ের বলা কথাটা বারবার কানে ভাসছে । অদূরে দুটো ছায়া ঘনীভূত হয়ে এখন এক হয়ে সেই ইঙ্গিত বহন করছে !
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট ।
-----------------------------