আউলিয়া
বদরুদ্দোজা শেখু
বকুলটোলার বাগ্দীপাড়া। সেখানে ক'ঘর বাগ্দি, মালো, দাস পরিবার বসবাস করে। তারা ওখানকার অনেকদিনের বংশানুক্রমিক বাসিন্দা। তারা প্রান্তিক মানুষ, তাই বকুলটোলা গ্রামের উপান্তেই তাদের বাস। ওই গ্রামে অনেক সম্পন্ন ও ধনী পরিবার আছে। তারা অনেক বিষয়ে এই প্রান্তিক মানুষদের উপর নির্ভরশীল। তবে তারা এই প্রান্তিক মানুষদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়না। তাদের বাড়িতে কাজের লোক বা জমিতে মুনিষ মজুর খেটে এই প্রান্তিক মানুষদের বছরের অনেকটা সময় কাটে । অনেকসময় পঞ্চায়েতের উন্নয়নমূলক মাটিকাটার কাজেও এরা যোগ দেয়।
ভূষণ বাগ্দী ওর স্ত্রী নমিতা আর দুই মেয়ে আর এক ছেলে অজিতকে নিয়ে ওই পাড়াতেই থাকে। শোনা যায় ,এককালে তাদেরও জমিজমা ছিল। মানে ভূষণের বাবার ছিল। তার বাবার তিন ছেলে ভূষণ, বসন ও পোষণ। বাবা মারা যাওয়ার পর ওরা সবাই ভিন্ন হ'য়ে যায়। বসন , পোষণ ওরা চাষের কাজকর্ম পারতো। কিন্তু ভূষণ বড়ো ছেলে, সে ওসব কাজ কখনো করেনি আর পারতোও না। এদিকে বছর বছর ওর খরচও বাড়তে থাকে, জিনিসের মূল্যও বাড়তে থাকে। মেয়ে দুটোর বিয়ের উপযুক্ত বয়স মানে ওই বারো/ তেরো বছর বয়স হতেই পাত্র দেখাশুনা ক'রে দূরের কৈয়ড় আর ধলসা গ্রামে বিয়ে দিয়ে দ্যায়। এতেই তার জমিজমা চ'লে যায়। শেষে থাকে বসত ভিটেটুকু। এবার তো আর গা না খাটালে চলে না। তবে সে সজ্জন মানুষ। অর্থহারা লোকের বাহুবল না থাকলে গ্রামে টেকা মুশকিল। ছেলেটাও ছোট। তবু সে ছেলেকে নিয়ে মাঝে মাঝে পঞ্চায়েতের মাটি কাটার কাজে যায়। ভূষণ যাও-বা কোদাল নিয়ে শুকনো মাটি কোপাতে পারে, তবে ঝুড়ি দিয়ে মাটি তুলে সেটা মাথায় ক'রে ব'য়ে অন্য জায়গায় ফেলতে পারে না। তাও ভূষণের স্ত্রীর মুখ চেয়ে ওদের সহকর্মীরা ওকে কাজে লেগে থাকতে সাহায্য করে
যাতে সে কাজটা না হারায় আর ওর ছেলেটাও কাজটা ধীরে ধীরে শিখে নিতে পারে। একদিন জ্যৈষ্ঠের কাঠ-ফাটা রোদে দূরের মাঠে রাস্তা মেরামতের কাজ হচ্ছিল। আশেপাশের জমিগুলো থেকে মাটি কেটে পুরনো ক্ষ'য়ে-যাওয়া রাস্তায় ফেলা হচ্ছিল ।
খরার দিন , তাই সকাল ৬ টা থেকে বেলা ২টা অবধি ঠিকাদার কাজটা করাচ্ছিল। হঠাৎ দুপুর নাগাদ মাটি কাটতে কাটতেই ভূষণ কোদাল ধরা অবস্থায় অসুস্থ হ'য়ে লুটিয়ে পড়লো। আশেপাশে কোনো গাছতলাও নাই যে সেখানে একটু ছায়ায় বসাবে বা শোয়াবে। তার ভাইয়েরা তাকে ধরাধরি ক'রে তার মুখচোখে জল ছিটিয়ে দিলো পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু সে লুটিয়েই পড়লো।
তখন তার ছোট ভাই পোষণ আর তার ছেলে ঘাড়ে ক'রে ব'য়ে তাকে বাড়িতে নিয়ে এলো। বাড়ি বলতে খ'ড়ে-ছাওয়া মাটির ছোট কুঁড়েঘর। সেখানে নিয়ে যেতেই কান্নাকাটি করতে লাগলো তার বৌ আর তার ভাইদের ছেলেমেয়েরা। পাড়াপড়শীও কয়েকজন জুটলো । সবাই মেয়েলোক বা বুড়ো লোক। একজন বললো, ডাক্তার শম্ভু দত্তকে ডাকো , সে যদিও হাতুড়ে ডাক্তার, তবে ভালো ওষুধ দ্যায়। গরমে রোদে হয়তো কাহিল হ'য়ে ওই অবস্থা হয়েছে। অজিত ও পোষণ ছুটলো ওপাড়ার ডাক্তার শম্ভু দত্তকে ডাকতে । সে বাড়িতেই ছিল। কিন্তু তার ভিজিট একশো টাকা আগে না দিলে সে আসবে না ওই দুপুর রোদে, সাফ ব'লে দিলো। ছেলেটি কান্নাকাটি ক'রে তাকে অনেক মিনতি করলো, কিন্তু সে তার ফিজ আগে না পেলে আসবে না। পোষণ তার ভিজিট ও ওষুদের দাম টাকা হাতে পেলেই মিটিয়ে দিবে বললো কিন্তু সে অনড়। ভূষণের অবস্থা তো সে জানে। ও এক পয়সাও নগদ দিতে পারবে না । এমনকি কোনো ওষুধের খরচাও সে করতে পারবে না। বললো, টাকা দিতে না পারলে তোদের গাই-টা আমার গোয়ালে বেঁধে দিয়ে যা তারপর যাবো। ব্যর্থমনোরথ হ'য়ে তারা ফিরে এলো।
এদিকে ভূষণের অবস্থা তখন যায়-যায়। মুখচোখ হাত পা সব নেতিয়ে পড়েছে। মাথায় জল ঢেলে আর কতটুকু হবে ? তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। বাড়ির সামনে অনেক লোকের ভিড়। সবাই বললো, ভূষণকে খাটিয়ায় ক'রে সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাও । সেখানে বিনা পয়সায় চিকিৎসা হবে। কেউ বললো , ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র দুপুরেই বন্ধ হ'য়ে যায় । তবে স্বাস্থ্যকেন্দ্র তো প্রায় পাঁচ ক্রোশ দূরে । এই অবেলায় তাকে কারা খাটিয়ায় ক'রে ব'য়ে নিয়ে যাবে ? অন্ততঃ চারজন শক্তপোক্ত লোক দরকার খাটিয়া ব'য়ে নিয়ে যেতে। ওর ওই ছেলে তো খাটিয়া বইতে পারবে না। পাড়ার দু'চারজন রাজী হলো তবে আজ নয় , পরদিন ভোর ভোর তারা নিয়ে যেতে রাজী। তারাও তো মাটি কাটার আজ ক 'রে এসেছে। সবাই ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। রাতের অবসরটা না পেলে তারা বোঝা টেনে চলতে পারবে না। ভূষণের স্ত্রী নমিতা কেঁদে কেটেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছে না।
এমন সময় তাদের বাড়ির সামনের গরুর গাড়ির লিক দিয়ে একজন সাইকেলে চড়া অপরিচিত পথিক হাজির হলো ।পাজামা পাঞ্জাবি পরা লোক , মুখে লম্বা পাকা দাড়ি ও মাথায় সাদা পাগড়ি , দেখে মনে হয় কোনো মৌলবী হবে। কাঁধে একটা বড়ো ঝোলা ব্যাগ। দুপুরের রোদে তারও মুখচোখ শুকনো রুখুশুখু। ওখানে অতো লোকজন দেখে সে সাইকেল থামিয়ে নামলো আর কী ব্যাপার তা জানতে চায়লো। ঘটনা শুনে বললো, কোনো ডাক্তার এলো না ! আচ্ছা, আমিও তো রুগী দেখে বেড়াই, কই আমাকে একবার দেখতে দাওতো রুগীকে , যদি কিছু করতে পারি। তখন বিপদের সময় সে একজন ডাক্তার শুনে কেউ বাধা দিলো না। সে ভূষণের ছেলে ও অন্যান্য লোকেদের সাথে বাড়িতে ঢুকে গেল। দেখলো উঠোনের মেঝেতে একটা খেজুর পাতার পাটিতে রুগীকে শোয়ানো হয়েছে। মাথায় জলপট্টি ও হাত পাখার বাতাস করা হচ্ছে আর আত্মীয়বজন কান্নাকাটি করছে। সেই পথিক সবাইকে স'রে যেতে বললো আর বাতাস ছাড়তে বললো। তারপর ভূষণের নাড়ী দেখলো, চোখ দেখলো আর বুকে যন্ত্র
লাগিয়ে পরীক্ষা করলো আর বললো , এই দুর্বল মানুষকে এতো চড়া রোদের দিনে মাটি কাটতে পাঠায়? উনার শরীরে ভয়ানক পানির অভাব হয়েছে।এক্ষুণি স্যালাইন দিতে হবে আর একটা ইঞ্জেকসন দিতে হবে। বলেই সে তার ঝোলা থেকে স্যালাইন বের ক'রে উপরে বাতার সাথে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিলো আর বাম হাতে সূঁচ ফুটিয়ে স্যালাইন চালু ক'রে দিলো। অন্যহাতে একটা ইঞ্জেকসনও দিলো। এই করতে করতে প্রায় আধঘন্টা সময় পার হলো ।
ভূষণ তখনো নেতিয়ে রয়েছে। আবারো তার নাড়ী দেখলো আর বললো , চিন্তা করবেন না। আপনার বাবা ঠিক সুস্থ হ'য়ে উঠবে। আরো বললো , রাত হ'য়ে আসছে। আমাকে তো বাড়িতে ফিরতে হবে। তো আরো তিনটে স্যালাইন বোতল ওদের দিয়ে শিখিয়ে দিলো
কেমন ক'রে তা লাগাতে হবে। আর রুগী এখন ঘুমোবে। এই চারটি স্যালাইন শেষ হ'লে ওই সূঁচ সাবধানে উনার হাত থেকে খুলে দিতে হবে। কাল সকালে সময় পেলে আবার আমি এসে একবার দেখে যাবো। দশবারো দিন কোনো কাজে যাওয়া চলবে না। আর খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করতে হবে।
কেউ কেউ জানতে চায়লো , ডাক্তার বাবুর বাড়ি কোথায় ?
- আমাকে চিনবেন না । আমি তো দুটো গ্রামের পরে যে হাজীপুর আছে সেখানে দরগাতলায় থাকি। আমার নাম বাসিত আউলিয়া। গেলে সবাই দেখিয়ে দিবে।
সেই পথিক টাকাপয়সা ওষুধের দাম কোনোকিছুই চাইলো না। বললো, উপরওয়ালার কুদরতে সব ঠিক হ'য়ে যাবে। ভূষণের ছেলে কাঁচুমাচু হ'য়ে টাকা না দিতে পারার কথা বলতেই সে বললো, আরে বাবা, কোথা থেকে দিবে ! আমি তো তোমাদের অবস্থা দেখছি। কিচ্ছু লাগবে না। আমি বিনা পয়সায় মানুষের বিপদে কাজে লাগি । সব উপরওয়ালার দয়া। তাঁর উপরে ভরসা রাখো। ব'লে সে সাইকেল নিয়ে বিদায় নিলো।
তার চিকিৎসায় ঘন্টা তিনেক পরে ভূষণের জ্ঞান ফিরলো। সে চোখ খুলে চারিদিক দেখলো। কোনো কথা বললো না, আবার ঘুমিয়ে পড়লো । দেখলো, তার বিছানার পাশে আলোর লম্ফু জ্বলছে আর তার স্ত্রী ও ছেলে পাশে বসে আছে। সে ঘুমের ঘোরে দেখলো , কোনো এক দেবদূত তার চিকিৎসা ক'রে তাকে বাঁচিয়ে তুলছেন। ভরসা দিচ্ছেন, বাবা , ঘাবরাইও না। ঠিক বেঁচে যাবে।- - -
ভোর রাতে ভূষণ উঠে বসলো, তবে খুব দুর্বল। ওই ডাক্তার দু' প্যাকেট গুঁড়ো ওষুধও দিয়েছিলো । খুব দুর্বল মনে হলে, তাকে এক লিটার পানিতে এক প্যাকেট গুলে বারে বারে খাইয়ে দিতে হবে । তার ছেলে সেই কাজ করলো ।দিন দু'য়েকের মধ্যে সে সেরে উঠলো । সপ্তাহ পার হ'য়ে গেলো । কিন্তু সেই ডাক্তার আর এলো না।
তাই ভূষণ তার স্ত্রী ও ছেলের সাথে পরামর্শ করলো, ওই ডাক্তারের খোঁজে যাবে আর তাকে কৃত্জ্ঞতা জানিয়ে আসবে। তাই আরো সপ্তাহ খানেক পর একদিন ভোর ভোর তারা হাজীপুর গ্রামে দরগাতলায় গিয়ে হাজির হলো আর ডাক্তার বাসিত আউলিয়ার বাড়ির খোঁজ করলো। সবাই শুনে তো অবাক। এরা বাসিত আউলিয়াকে খুঁজছে কেন ?
সে তো প্রায় দশ বছর আগে মারা গেছে ! পাড়ার লোকজন তার মাজার দেখিয়ে বললো, এখানে ওনাকে কবর দেওয়া হয়েছে। তারা দেখলো, বাঁশের কাঠামো দিয়ে ঘেরা তার মাজারে কিছু ফুল মানতের ঘোড়া ইত্যাদি দেওয়া আছে, একটা সাধারণ চাদর চাপানো আছে।
ঘটনা শুনে সবাই বললো, হ'তে পারে, আল্লার ফেরেস্তা হিসাবে আউলিয়া তোমাদের সেবায় গেছিলেন। ওনার তো ছেলেপিলেও ছিলো না । আর উনি তো সাধক পুরুষ ছিলেন , শেষ বয়সে সব সময় আল্লার নামে ডুবে থাকতেন আর উনিও তো ওই বিনা পয়সায় ডাক্তারী ক'রে বেড়াতেন। - - - তোমাদের কিছু চাওয়ার থাকলে ওই মাজারে প্রার্থনা ক'রে যাও। আর যদি কিছু দিতে চাও, একটাকা বা দু'টাকা যাই হোক, তা ওই মাজারের দানবাক্সে ফেলে দিতে পারো ।
ভূষণ বললো, আমরা খুবই গরীব, দেওয়ার মতো কোনো সামর্থ্য নাই, আমরা উনার সাথে দেখা ক'রে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছিলাম।উনি সেদিন আমার চিকিৎসা না করলে আমি বাঁচতাম না। নাই তো দিতে হবে না। কোনো ব্যাপার নাই। সব শুনে ভূষণ ও তার স্ত্রী ও ছেলে ওই মাজারে কিছুক্ষণ মৌন দাঁড়িয়ে থাকলো আর তার স্ত্রী বললো, ভগবান নিশ্চয় আমাদের কাছে দেবদূতই পাঠিয়েছিলো, আমরা চিনতে পারিনি । বাবা আউলিয়া ,আমাদের ক্ষমা কোরো, ব'লে তারা কেঁদে ফেললো। সেই থেকে তারা আউলিয়ার ভক্তে পরিণত হলো।
তারা বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরলো। কিন্তু তাদের মনে এক অলৌকিক আনন্দ ঝ'রে পড়লো। যার সেবায় কেউ নাই , তার উপরওয়ালা আছে । তাদের মুখ থেকে সেই ডাক্তারের ঘটনা চারিপাশে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো। যারা সেদিন ঘটনাস্থলে হাজির ছিল ,
তাদের অনেকেই বিশ্বাস করলো , আর কেউ কেউ অবিশ্বাস ক'রে উড়িয়ে দিলো। অলক্ষ্যে যেন ধ্বনিত হলো, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর ।
সেই মাটিকাটার ঠিকাদার ভূষণের ছেলেকে একটা কাজ দিলো, তার মজুর যোগান দেওয়ার কাজ আর ভূষণের অর্থকষ্টও রইলো না।
সব ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বাসী মানুষের বৃদ্ধিতে ক্রমশঃ আউলিয়ার মাজার একটি তীর্থস্থানে পরিণত হলো।
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট ।
---------------------'----'-------------------------