বিজ্ঞপ্তি
লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫
নভেম্বর ২১, ২০২৪
ব্যবসায়িক ডিল
শৌনক ঠাকুর
ওভার ব্রিজের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলো তৌশানী। কেউ আসবে না। বা কাউকে ছাড়তে আসে নি। হাওয়া খেতেও না । আত্মহত্যায় সে বিশ্বাসী নয় । নীচে দিয়ে একটার পর একটা ট্রেন সিটি দিয়ে চলে যাচ্ছে। আচ্ছা প্রত্যেকটি ট্রেন কি গন্তব্যে যায়? নাকি আমার মতো মাঝ পথে পথ হারিয়ে ফেলে?মনের অন্ধকার প্রেক্ষাপটে ভেসে ওঠে সেই সব স্মৃতি। এখানেই... হাঁ হাঁ ঠিক ... এই জায়গাতেই প্রথম সৌনোকের সাথে দেখা হয়েছিল। তখন অবশ্য দুজন দুজনকে চিনত না। রুমাল বের করতে গিয়ে পার্সটা পড়ে গিয়েছিল সৌনোকের । তৌশানী কুড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, " ও দাদা শুনছেন ? আপনার পকেট থেকে কি পড়ে গেল। ও... ও...ও দাদা......।" ভিড়ের মধ্যে কে শোনে কার কথা।তৌশানী সেদিন বাবাকে ছাড়তে এসেছিল। বাবাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে গেটের সামনে জটলা দেখে সে থেমে যায় । একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে আরে এ তো সেই লোকটা। কয়েকজন টিটিকে ভদ্রলোকটি কি যেন বোঝাচ্ছেন । কপালে ঘাম। দুপাশে লোক জড়ো হয়েছে। ফর্সা মুখে ক্রমশঃ রক্তিম আভা দেখা দিয়েছে। ডেইলি প্যাসেঞ্জার ... মান্থলি আছে এই সব কিছুই শোনা হচ্ছে না। ফাইন দিতেই হবে। আশেপাশের চেনা মুখ, অচেনা মুখ আড়চোখে তাকাচ্ছে। লজ্জায় যেন মনে হচ্ছে মাটিতে মিশে যায়। হঠাৎ তৌশানী ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে পার্সটা নিয়ে উপস্থিত হয়। যেন পায়ের তলায় মাটি পায় সৌনোক। ওখানেই যে ছিল তার মান্থলি।তারপর স্টেশনে প্রতিদিন দেখা হয় পরস্পরের। চোখাচোখি হতেই কখনো ঠোঁট চাপা একটু হাসি, কখনও বা মুচকি হাসি। একই ট্রেনে যাওয়া না হলেও ফেরাটা এক সাথেই হত। দৈবাৎ স্টেশনে দেখা হত । তারপর দৈবাৎ টা অভ্যাসে পরিণত হতে থাকে । একই ট্রেন । একই কামড়া। তারপর পাশাপাশি বসা।এভাবেই দিন কাটে। কিন্তু ডেইলি প্যাসেঞ্জার স্টেশনে হকার সহ অনেকেই জানত উভয়ের বিয়ে নিশ্চিত। শুধু শুভ দিনের অপেক্ষা। কিন্তু আজ হঠাৎ সৌনোকের কি এমন হলো।সৌনোক বলল, "তোমার সঙ্গে আমার আর ঘর বাঁধা হচ্ছে না।,"তৌশানী "কেন?"২সৌনোকের বাবা সৌনাভ্য মস্ত ব্যবসায়ী। কাপড়ের দোকান। কাটোয়া সহ আসেপাশের লোকজন "দি হাল ফ্যাশন" দোকানের নাম এক ডাকে চেনে। দোকানটি এখন একটা লোকেশন হয়ে উঠেছে। কুড়ি বাইস জন কর্মচারী কাজ করে। ব্যবসায়িক দৃষ্টি ভঙ্গি সৌনাভ্যবাবুর রক্তে মিশে গেছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার হিসাব। লাভ ক্ষতি। তাই যেদিন সৌনোকের মায়ের কাছে তৌশানীর কথাটি শোনে তখন তিনি একটা অদ্ভূত প্রশ্ন করেন , "ভাই বোন আছে , না নেই?
সৌনোকের মা অতি সাধারণ ঘরের মেয়ে। অঙ্কের মাস্টারের মেয়ে। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে বড় হয়েছে। সৌনোকের দাদু ওকে পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছিলেন। তখন অবশ্য ওদের অবস্থা আজকের মতো ছিল না। সৌনোকের বাবার আমলেই ব্যবসাটার শ্রী বৃদ্ধি ঘটেছে।"হা রে ওই মেয়েটিকে একদিন বাড়িতে নিয়ে আয় দেখি।" ডাল দিতে দিতে সৌনোকের মা বলল।টেবিলে ভাত খাচ্ছে সৌনোক।৩আজ সারাদিনটা দিন ওই একই কথা মনে আসতে থাকে সৌনোকের । স্কুলে মন বসছে না কিছুতেই । কিভাবে তৌশানীকে জিজ্ঞেস করা যায় ? কিভাবে শুরু করবে ? কোথায় গিয়ে শেষ হবে? ও কিছু মনে করবে কিনা? এই সব নানান চিন্তা কিলবিল করতে থাকে তার মাথায়। বাবার যতসব উদ্ভট প্রশ্ন। ছাতার মাথা। কিছুই বোঝা যায় না।পাঁচটা পাঁচের ব্যান্ডেল কাটোয়া লোকালে ফেরে দু'জনে। প্রতিদিনের মতোই জায়গা রাখে সৌনোক। তৌশানী ওঠে পরে স্টেশন সমুদ্রগড় থেকে । সে হাইস্কুলের শিক্ষিকা। বিষয় কেমিস্ট্রি। বেশ লম্বা । দোহারা গরন। কাঁচ কাঁচ রঙের এই মেয়েটির মুখশ্রী বেশ মিষ্টি। চটপটে। বেশ মিশুকে । বেশ একটা লালিত্য আছে। পলক পড়লে পলক সরানো একটু কঠিনই বটে।ট্রেনে নিয়মমাফিক বকে চলল তৌশানী । মুগ্ধ শ্রোতা কেবল সৌনোক। মাঝে মাঝে প্রাসঙ্গিক "হাঁ " ",হূ" , "না " শব্দ উচ্চারণ করে। মাঝে মাঝে বাবার কথাটি তার পড়ে যায়। কিন্তু পরক্ষনেই চিন্তা করে দূর কি দরকার। তাছাড়া দু'জনেই তো প্রাপ্ত বয়স্ক। এস্টাবিলিস্ট। কিন্তু মন যে বড়ই বেয়ারা।হঠাৎ সৌনোক বলে বসল, "মা একবার তোমাকে দেখতে চেয়েছে ।"তৌশানী বলে, "সেটাই তো স্বাভাবিক। বউমা বলে কথা"।সৌনোক বলল,"ভাবছি সামনের রবিবার তোমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসব।"তৌশানী বলল, "যথা আজ্ঞা কলির বিদ্যাসাগর। "সৌনোক বলল, "বিদ্যাসাগর বললে কেন ?"তৌশানী বলল, "বলবো না। তুমি যে সমাজের বিধানের পরিবর্তন করছো।"কৌতূহলী সৌনোকের প্রশ্ন , "মানে ?"তৌশানী বাদাম চিবাতে চিবাতে বলল, "এতকাল ছেলেরা মেয়েদের বাড়ি যেত। এবার স্বয়ং মেয়ে যাবে ছেলের বাড়িতে "।অনেক কথাই হলো । হাসিহাসিও কম হলো না। কিন্তু আসল কথাটাই জিজ্ঞেস করতে পারলো না সৌনোক।স্টেশনে নেমে তৌশানী বলল, "আজ একটু কাছারি রোডের দিকে যাবো।""কেন ?" সৌনোক জিজ্ঞেস করে।তৌশানী "বাবার ওষুধ কিনতে ?"সৌনোক অবাস্তব একটা প্রশ্ন করে ফেলে," কেন?"তৌশানী বলে , "ওষুধ লোকে কেন খায় ?সৌনোক কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।তৌশানী আবার বলল, "তোমার মতো আমার ভাই বোন নেই। তাই সব কাজ একাই করতে হয়। আচ্ছা চলি। রাতে ফোন করবো। "হতবাক হয়ে যায় সৌনোক। সারাদিন যে প্রশ্নটি নিয়ে সে জেরবার ছিল তার এভাবে সমাধান হয়ে যাবে বুঝতে পারে নি।৪
রাতে খাবার টেবিলে কথাটা উঠল। মা প্রসঙ্গ তুলল। সৌনোকের চোখে মুখে উত্তেজনার ছাপ তখন স্পষ্ট। বাবার ওই আশ্চর্য প্রশ্নের উত্তর সে পাবে।বাবা বললেন, " বুঝলাম তো সবই। কিন্তু জীবনে হিসেবেটা-ই বড়ো। বেহিসেবী জীবন সুতো কাটা ঘুড়ির মতো ,লক্ষ্য হীন। দিশাহীন।"মা ছেলে এই কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো না।মা বলল, "বুঝলাম না।"বাবা বলল, " লাভ নেই। লাভ নেই।"ঘাড় নেড়ে আবার বলল, "একে তুমি ব্যবসায় না বসে গোলামী .... থুরি ...চাকরি করছো। এটা আমার অপছন্দের। আবার ভালোবাসা...... বিয়ে..."মা বললো, "মানে ,মেয়েটি শিক্ষিতা, শুনেছি দেখতে শুনতে ভালো, পাল্টি ঘর , বাবা মা ভালো সরকারী কাজ করতেন এখন রির্টার করেছেন, স্বজাতি ....."কথাটি থামিয়ে দিয়ে বাবা বললেন, "আরে রাখো । রাখো। এখনকার দিনে কেউ কাস্ট নিয়ে ভাবে না। আর যদি ভাবতাম তাহলে শুভ্রা মানে আমাদের মেয়ের লাভ ম্যারেজ ওরকম ধূমধাম করে দিতাম না। কত ধনী ওরা। আসল কথা হলো পয়সা.... মানে বিজনেস ...... সবই বিজনেস।"সৌনোক ভাবে বাবা কি তাহলে পরোক্ষভাবে পণের কথা বলতে চাইছে।মা বলল, "কি বলতে চাও স্পষ্ট করে বলো!"রুটিটা ডালে চুবিয়ে বাবা বললো, "শোনো বর্তমান দেখলে হয় না , দেখতে হবে ভবিষ্যত। বর্তমান হলো চাকা , ভবিষ্যত হলো রথ। ভবিষ্যতের রথ বর্তমানের চাকার দাঁড়িয়ে । আর চাকার হাওয়া হচ্ছে অর্থ।"কথাটি বলে বাবা কিছু না বলে বাথরুমে হাত ধুয়ে গেল।সৌনোকের ভাবনাটা ক্রমশঃ দৃঢ় হতে থাকে। বাবা অবশ্য সেদিন একটা নতুন দোকান কেনার কথা বলছিলেন বটে। তাই হয়তো পণ...... ছিঃ। ছিঃ ! বাবা এতটা নিচে নেমে যাবে.... শুধুমাত্র ব্যবসা বাড়ানোর জন্য...." আর তাই হয়তো ? ৫বাবা ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে মুখ মুছতে থাকে।মনে মনে শক্তি সঞ্চয় করে সৌনোক বলল," সত্যি করে বলতো তুমি কি পণ নেওয়ার কথা বলছো ?"বাবা বলল , " আরে, রাম কহ! রাম কহ! আমি কি এতটা নিচ ? আমি কি ইস্কুল মাস্টার ? "উত্তেজিত হয়ে সৌনোক বলল, " হাঁ হাঁ সবাই সাধু পুরুষ আর যত দোষ মাস্টারদের। ফেসবুক খোলার উপায় নেই..."পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় আগেই মা উভয়পক্ষকে থামিয়ে বলল, "আহা ! তোমার আপত্তিটা কোথায় বলবে তো?"একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বাবা বলল," শোনো, একটাই মেয়ে বৃদ্ধ বয়সে শ্বশুর শাশুড়ি তোমার ছেলের ঘাড়ে চাপবে।"কথাটা তীরের মতো বিঁধলো সৌনোকের মনে।তারপর তীব্র স্বরে চিৎকার করে সৌনোক বলল," তুমি মানুষ না কি ! এত নোংরা ধারণা তোমার ....."বাবা বলল, "থাম , থাম , আর জ্ঞান দিস না। জ্ঞান ইস্কুলে দিবি । টাকা না থাকলে....."সৌনোক বলল,"আমি ওকেই বিয়ে করব।"বাবা বেশ জোরের সঙ্গে বলল, "হবে না"সৌনোক টেবিল চাপড়ে বলল, "হবে"মা দুজনকে থামাতে পারে না। হাঁপিয়ে ওঠে। একে তো হার্টের পেসেন্ট। তার উপর অ্যানিমিয়া আছে। ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসে পড়ে।উত্তেজিত সৌনোক বলল, "তোমার এই ধারনা ভুল। জীবনে প্রেম ভালোবাসা ....."বাবা একটু জোরের সাথে, "থামো। থামো। ওসব সিনেমাতে মানায়।"সৌনোক, ---" জীবনে টাকা ছাড়া কিছুই চিনলে না ..."বাবা,--- "ওটাই আসল।"সৌনোক, ---" না না আমি কোন কথা শুনবো না। দিন নেই রাত নেই কেবল ব্যবসা... ব্যবসা টাকা ....টাকা.. ...টাকা.."মা কপালে ঘাম মুছতে মুছতে বলল, " আমার কথা শোনো। একটু থামো । রাত হয়েছে। কাল কথা হবে।বাবা বলল, "না যা হবার আজই হবে।"একটু হাঁপাতে হাঁপাতে, মা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো, "কথা শোন, খিটকাল করিস না , আসেপাশে বাড়ি আছে..."সৌনোক থালাটা ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল ," না না আজ ই এর হেস্তনেস্ত করবো। আবার শুনলাম সুদের ব্যবসা ধরেছে... সুদখোর...."বাবা দ্বিগুণ স্বরে , " কি মুখের ভাষা! ছিঃ! ছিঃ ! মাস্টার"সৌনোক --- "প্রফেশন নিয়ে কোন কথা নয়"বাবা ---- "প্রফেশন".....ভারি একটা চাকরি..."মা কিছু একটা বলতে গেল কিন্তু মাথাটা যেন একটু ঘুরে গেল।বাবা বলল, " তুমি যেমন ব্যবসাতে বসলে না তেমনি তোমার বিয়ে নিয়েও আমি কেমন ব্যবসা করি দেখো।"মা ছেলে উভয়ের ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো।৬মা ক্রমশঃ ঘামতে থাকে। শরীরে অস্বস্তি । ডান হাতটাতেও কেমন যেন একটা ব্যথা। কিন্তু মেয়েদের সহ্যশক্তি পুরুষের তুলনায় শতগুণে বেশি। সাধে বলে,"কই মাছের প্রাণ!"বাবা ডান হাত দিয়ে খয়নি দলতে দলতে বলল, "সুধীরের মেয়েটিকে মনে আছে?"মা বলল, "কোন সুধীর ?''বাবা বলল , "ফুলিয়ার! কেন ? মনে নেই ক'দিন আগেই তো ফোন করছিল।"জড়ানো গলায় মায়ের উত্তর, "অ"।বাবা বলল, "তাছাড়া ফুলিয়ায় সুধীরের একচেটিয়া ব্যবসা। নদীয়ার একমাত্র তাঁতের ডিলারসিপ । এখন আবার আমাদের ইউনিয়নের নেতা হয়েছে।"সৌনোক বক্র দৃষ্টিতে তাকায়।বাবা খয়নিটা ঠোঁটের ফাঁকে ভরে বলল, " তাছাড়া প্রস্তাবটা যখন ওর দিক থেকেই এসেছ তখন.... সম্পর্ক তৈরি হলে ওই এলাকায় ব্যবসা বাড়বে । সে রকম হলে পূর্ব বর্ধমানের কাপড়ের ডিলারসিপটা পেয়ে....""এ.. এ... এই... এই.. " হঠাৎ চিৎকার করে মায়ের দিকে ছুটে যায় সৌনোক। বাবা চমকে উঠে। মায়ের মাথা তখন টেবিলের উপর । বেঘোর। অচেতন। শুধু "গোঁ গোঁ" শব্দ আসছে।ডাঃ দয়াময় ব্রুট বললেন, " মাইল হার্ট অ্যাটাক.... "বাবার দিকে তাকিয়ে , "মনে হচ্ছে বাঁ দিকটা ..... কাল সকাল ছাড়া ......। "বাবা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।ডাঃ ব্রুট বললেন, " ড্যাগাড্রন পুস করলাম। আর একটা ইসস্পি...... দিলাম"। বাকিটা ঠিক শোনা গেল না।ফিজ দিয়ে সৌনোক দরজা পর্যন্ত ডাক্তারবাবুকে এগিয়ে দিল।ডাঃ বাবু বললেন, "দেখো টেনশন যাতে না হয়। কাল সকালে আবার আসবো। চলি।"ডাক্তারবাবুর বাড়ি এই পাড়ায়। তাই তিনি হেঁটেই চলে গেলেন।এর মাঝে অবশ্য তৌশানীর দু'বার ফোন এসেছিল। রিসিভ করতে পারে নি। কি আর বলবে সৌনোক। সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। ঘুমন্ত মায়ের পায়ের নিচে কিছুক্ষণ বসে থাকে । দু'চোখ ভরে যায় জলে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ফোন নিয়ে চলে যায় ছাদে। বাবা তখন বাইরের বারান্দায় ।সৌনোক খালি গায়ে পাইচারি করে। আর ভাবতে থাকে কোনদিকটা আগে সামলাবে । তৌশানীকে দু'বার ফোন করতে গিয়েও পারলো না। গুমোট গরম। একটুও হাওয়া নেই। সামনের পাতাহীন ডাল সর্বস্ব বটগাছটিকে তখন ভুতের মতো দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে।অগোছালো চিন্তা। কি বলব ? পুরো ঘটনাটা বলে দেবো। না আরও একটু সময় নেবো। ও এখনও ফোনের অপেক্ষায় বসে আছে নিশ্চয়ই" । ভাল লাগছে না।"না আর ভাবতে পারছি না" বলে সে রিং ব্যাক করলো তৌশানীকে।৭রিং টা সম্পূর্ণ না হতেই ফোন ধরলো তৌশানী। স্বাভাবিক ছন্দে কথা বলার আপ্রান চেষ্টা করলো সৌনোক। কিন্তু মাঝে মাঝে ঘটল ছন্দপতন । হাজার হোক মানুষ তো ! তৌশানী বুঝলো কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু ঠিক কি হয়েছে তা বুঝতে পারলো না। ফোন রাখার আগে প্রতিদিনের মতো শব্দ করে একটা মিষ্টি জিনিস দিল তৌশানী। (ওদের ভাষায় "কিসমিস")আজ রবিবার। তৌশানীকে আনার দিন। মা শুয়ে আছে। বাবা বাড়িতে। ইতিমধ্যে দিদিকে ফোন করা হয়ে গেছে। আজই আসবে।মা শুধু একবার বলল, "তোর বাবা খুব জেদি। বদমেজাজি। দেখ কি করা যায় ! আমি তো অক্ষম হয়ে ......"থামিয়ে দিয়ে সৌনোক বলল, " আ... মা! এসব কথা এখন থাক। তুমি একটু শোয়। আমি তোমার ওষুধটা নিয়ে আসি।"কথা মতো বেলা দশটায় তৌশানীর সঙ্গে দেখা করতে গেল সৌনোক। বাইকে যেতে যেতে ভাবলো, তৌশানীকে সে ভালোবাসে। কিন্তু মা ? সারারাত মনের সঙ্গে সে অনেক লড়াই করেছে। নিজেকে শক্ত করেছে। বুঝিয়েছে বিস্তর। সমস্যাটা মায়ের শরীরের।তৌশানী দাঁড়িয়েই ছিল। অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশিই সেজেছে। বেশ লাগছে।একমুখ হেসে বলল, "চলো"সৌনোক বলল, " ওভার ব্রিজে একটু দাঁড়াই। গল্প করি।"সৌনোক দাঁড়াল একটু তফাতে।তৌশানী বলল, " সরে দাঁড়ালে যে "সৌনোক বলল, "কিছু না এমনি"।তৌশানী বলল,"তোমার কি হয়েছে বলো তো ? কার রাতেও ভালো করে কথা বললে না।"সৌনোক বলল, " বলছি , মানে । কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না?"সৌনোকের হাত দুটো টেনে নিয়ে তৌশানী বলল , "বলো? বলো না কি হয়েছে ?"হাত ছাড়িয়ে একটু তফাতে গেল সৌনোক। সাহস সঞ্চয় করে বলল, " তোমার সঙ্গে আমার আর ঘর বাঁধা হল না।"কথাটা তৌশানীর বিশ্বাস হলো না।বলল, "শুধুই ইয়ার্কি আর ইয়ার্কি। কবে যে সিরিয়াস হবে।"সৌনোক বলল, "না সত্যি বলছি। তোমার সঙ্গে আমার আর ঘর বাঁধা হচ্ছে না।,"তৌশানী "কেন?"তারপর চোখ নামিয়ে কাল রাতের ঘটনাটা এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল সৌনোক।তৌশানীর মুখে রক্তের একটা আভা বয়ে গেল।
শরীর যেন কেঁপে উঠল। চোখ স্থির।সৌনোক ভাবলো তৌশানী এবার হয়তো তাকে চড় মারবে, গালিগালাজ করবে ,উল্টোপাল্টা বলবে। পুরানো প্রসঙ্গ টানবে। এসবের জন্য সে অবশ্য প্রস্তুত।কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। তৌশানী কয়েক মূহুর্ত চুপ থেকে বললো , "তোমার জায়গায় আমি থাকলে ....."সৌনোক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, " পালিয়ে বিয়ে করার কথা আমিও ভেবেছি। পরে মানতে বাধ্য হবে।"তৌশানী চোখ মুছতে মুছতে বলল, "না । না । আমি ও কথা বলি নি। বলছিলাম, তোমার জায়গায় থাকলে আমিও এই ডিসিশনটাই নিতাম। "সৌনোক বলল,"আমাকে ভুল ...."তৌশানী বলল, " আরে না। না। সংসার না হোক আমাদের ভালোবাসায় তো কোনো খাদ নেই।"সৌনোক কি একটা বলতে গেল।কিন্তু তৌশানী বলল, "বাবা মা তো আমাদের জন্য কত কিছুই করে । ধরে নাও আমরা এইটুকুই করলাম।"
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট ।______(শেষ)________শৌনক ঠাকুর