Click the image to explore all Offers

অণুগল্প ।। অতিথি ।। সুদীপ ঘোষাল

অতিথি

সুদীপ  ঘোষাল


 বিপুল বাবু চুপ মেরে গেলেন।ডাক্তার বলছে, মনরোগ। বাড়ির বড় ছেলে বাবাকে গল্পের বই কিনে দেন নিয়মিত।ছোটোছেলে গানের ক্যাসেট এনে দিলো। কিন্তু বিপুলবাবুর কোনো পরিবর্তন নেই। গল্পের বই পড়েন না। গান শোনেন না। 

অথচ এই বিপুল বাবু চিত্তরঞ্জনে একটা উচ্চ বিদ্যালয়ে অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন। পঁয়ত্রিশ বছর চাকরি জীবন তার। এই সময়ে তিনি স্কুলে যেতেন সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে। নিজের হাতে রান্না করে খেতে ভালোবাসতেন। ভোটের কাজে তিনি ছিলেন বিজ্ঞ। সকলে তার কাছেই পরামর্শ নিতে আসতেন। মহুকুমার মধ্যে তার মত গণিতজ্ঞ ছিলো না বললেই চলে। লোকে তাকে শ্রদ্ধা করতো। আর বিস্মিত হতো তার কর্মজীবনের    সাফল্য দেখে। 

একদিন বাড়িতে তার বড় ছেলে বললো, বাবা আজ আমরা বিরিয়ানী খাবো। তুমি রান্না করো। 

বিপুলবাবু বাজার থেকে সমস্ত কিছু জোগাড় করে এনে রান্না করে পরিবারের সকলকে বিরিয়ানী খাওয়ালেন।তিনি ছেলেদেরকে বলতেন, রান্না করা শিখে রাখবি। আগামী দিনে রান্নার লোক পাবি না। এখন হোম ডেলিভারির যুগ। ফলে পেটের সমস্যা বাড়বে। রান্না করা শিখতে পারলে খেতে পাবি নিজের মত। তা না হলে যা জুটবে তাই খেতে হবে। 

ছেলেরা বাবার কথামত রান্না করা শিখেছে।

বিপুলবাবু সফলভাবে চাকরি জীবন সমাপ্ত করে যেদিন বাড়িতে এলেন বিরাট টাটা সুমো গাড়িতে চেপে,সেদিন তার উপহার রাখার জায়গা ছিলো না। বেছে বেছে তিনি একটা বিভূতিভূষণের বই রেখে দিয়েছিলেন যত্ন করে। 

তার কিছুদিনের মধ্যে একটা স্কুলের পার্ট টাইম টিচারের পদে যোগদানের জন্য অনুরোধ এলো। তারা বললেন,আপনি এই এলাকার  অঙ্কের   শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। আপনি আসুন। অনেকে উপকৃত হবে। সাম্মানিক বেশ ভালো। 
বিপুলবাবু বললেন, এত দিন তো এইসব করেই কাটালাম। এখন ছেলেরা শিক্ষক হয়েছে। আর আমি শিক্ষকতা করবো না। ছেলেদের বারণ আছে। 

এখন বিপুলবাবুর বড় ছেলে রতন ভাবেন , বাবা চাকরিটা করলে বোধহয় ভালো থাকতেন। চলাফেরা হতো। শরীর ভালো থাকতো। 
কিন্তু তা তো হোলো না। বাবা এখন চুপচাপ থাকেন। কারও সঙ্গে কথাও বলেন না। মন গুমরে আজ তার শরীরটা পাটকাঠির মত হয়েছে। 

তারপর বিপদ তো একা আসে না। সুখের সংসারে অভিশাপ হয়ে প্রবেশ করলো কর্কট রোগ। রতনের মায়ের  করোনা পজিটিভ  ধরা পড়লো। বিপুলবাবু সেদিন স্ত্রীকে বলে ফেললে, আর নয়। বাঁচতে ইচ্ছে   করছে না। 

স্ত্রী সব জেনে শুনেও বিপুলবাবুকে ধমক দিলেন, ছেলেরা থাকলো। তোমাকে দেখতে হবে। আমি তো এখন পনেরোদিনের অতিথি।
বিপুলবাবু ভাবলেন, এ রোগে মৃত্যুহার কম। তবু একটু কাঁদতে পারলে ভালো হতো। কিন্ত ছেলে বৌমা, নাতি নাতনিরা আছে। তারা দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই কান্নাকে ব্যাথার বিপুল পাথরে চাপা দিয়ে রাখলেন। 

বিপুল বাবুর স্ত্রী রত্না আলাদা ঘরে বসে বসে ভাবেন, এই তো কয়েকদিন আগে কলেজে বিপুলের সঙ্গে পরিচয়। প্রথম দেখাতেই ভালোলাগা। আর এই ভালোলাগা টেনে নিয়ে গেছিলো   তাদের কলকাতা চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া,বইমেলা, মিনার্ভা, কফি হাউস। তাদের দুজনের কবিতার বই আছে। কত আকুতি মেশানো প্রেমের কবিতা। তখন কি আর মনে ছিলো করোনা রোগে, কবিতা আবার নতুন করে জন্ম দেবে। 

আজ রত্না খোলা চুলে ছাদে গিয়ে রোদে বসে খাতা কলম নিয়ে কবিতা লিখতে বসেছে। বিপুল আড়াল থেকে দেখে চোখের জল ফেলতে     ফেলতে আপন মনে বলে উঠলো, আমি যেন তোমার আগে মরতে পারি রত্না। তোমার কবিতা শোনার পরে তৃপ্ত হৃদয়ে আমি মরতে চাই। 

নিচে ছেলের চিৎকার শোনা গেলো, মা গো তুমি কোথায়?  একবার নিচে এসো। এখনি আমরা কলকাতা নার্সিং হোমে যাবো।  ডাক্তারবাবু বলেছেন, তোমার আজ  অক্সিজেন  নেওয়ার প্রয়োজন ... 
--------------------------- 

সুদীপ ঘোষাল নন্দনপাড়া খাজুরডিহি পূর্ববর্ধমান ৭১৩১৫০ মেল sudipghoshal59@gmail.com                                                               


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.