ছবিঋণ- ইন্টারনেট
সৎ মা
অঞ্জনা গোড়িয়া
হসপিটালের বেডে শয্যায় বৌদি। দাদার হাতটা চেপে ধরল। "কথা দাও, কথা দাও।
চোখের দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে বলল"আবার বিয়ে করো তুমি। দাদা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ।দাদার হাত টা শক্ত করে ধরে আছে বৌদি। কথা না দেওয়া পর্যন্ত ছাড়ব না। দাদা শান্ত স্বরে বলল, এসব কী কথা বলছ?
প্লিজ বলো না। তুমি ঠিক সেরে উঠবে দেখো।
বৌদি মুচকি হেসে বলল, আমি সব জানি গো। আর ফেরা হবে না। তুমি চিন্তা করো না। আমি মন টাকে বুঝিয়েছি এইটুকু ই আমার অভিনয় পালা। এবার যেতে হবে। কথা দাও তুমি বিয়ে করবে। তবেই শান্তি পাব মরে।
দাদা, বৌদির শেষ অনুরোধ ফেলতে পারল না । হাতদুটো শক্ত করে ধরে বলল,ঠিক আছে, তাই হবে।
দুদিন পর ই চলে গেল বৌদি চিরনিদ্রায়। দু -দুটো মেয়েকে স্বামীর কাছে রেখে। বড়ো মেয়ে ৫ বছরের ছোটো মেয়েটা আড়াই বছর। দাদা নিশ্চল পাথর হয়ে গেল।
থ্যালাসেমিয়া রোগী ছিল বৌদি। চলে যাওয়ার ই কথা। সবাই জানতো। তবু এত তাড়াতাড়ি ? কিছুতে ই মেনে নেওয়া যায় না।
ছোট মেয়েটার জন্মাবার সময় খুব বাড়াবাড়ি অবস্থা হলো। ডাক্তার বারণ করা স্বত্ত্বেও বৌদি আবার বাচ্চা নিয়েছিল।
দাদার নাকি খুব সখ ছিল একটা ছেলের। শুধুমাত্র দাদার ইচ্ছে কে মর্যাদা দিতে গিয়ে বৌদি মৃত্যু হলো। মৃত্যুর পর দাদা অসুস্থ হয়ে পড়ল । কিছুতেই মেনে নিতে পারল না এ মৃত্যু।
একা,বড়ো অসহায় লাগলো। কিছু দিন পর সুস্থ হলো ঠিকই সংসারে আর মন নেই। অন্যমনস্ক হয়ে ঘুরে বেরায়। বাড়ির জ্যাঠামশাই আবার বিয়ের ব্যবস্থা করল। দাদা ও বৌদির কথা রাখতে রাজি হয়ে গেল। নতুন বৌদি নতুন সংসার ।নতুন বৌদিও কেমন গুম হয়ে থাকে ।
বৌদির জীবনের আর কাহিনি। দিদিকে দেখতে এসে বোনকে পছন্দ।
গরীব বাবা এই সুযোগ টা হাত ছাড়া করতে চায় নি।বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেল ছোট মেয়ের। কিন্তু কে জানত, বর একজন মানসিক রোগী। ফুল সজ্জার রাতে ই বরের পাগলামো মূর্তি দেখে বৌদি ধরে ফেলল।
কিছু বুঝতে পারার আগে ই সেই রাতেই নতুন বৌদি পালিয়ে এল বাপের বাড়ি । রাতের অন্ধকারে। চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। পাশের গ্রামে ই বিয়ে হয়েছিল তাই পথ ঘাট চেনা ছিল। যাইহোক বৌদি আর ফিরে যায় নি। তবু মেয়ে তো। কলঙ্ক পিছু টানে নি । কিছুতে ই আর বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চায় নি। কিন্তু অসহায় বাবার অনুরোধে এক প্রকার বাধ্য হয়ে আবার বিয়েটা করতে হলো।
কিন্তু সবসময়ই বৌদি কেমন গম্ভীর মনে থাকতো। মেয়েদুটোকে কিছু ই বলত না। এটুকু বুঝি যথেষ্ট ভালোবাসে। বৌদির ও বয়স কম। বিয়ে হতে না হতে ই দুই কন্যার মায়ের পরিচয় পাবে৷ ক'জন মেয়ে ই তা মেনে নিতে পারে?
পাড়া প্রতিবেশীরা সব সময় কিছু না কিছু মন্দ কথা বলতে ই থাকে। সৎ মা কখনো ভালো হতে পারে না।বাজে বাজে কথা বলে মেয়েদের মন বিষিয়ে দিল। বড় মেয়েটা কিছুতে ই মা বলে ডাকত না।
বুঝতাম বৌদির খুব কষ্ট হতো।
বড় মেয়েটা পড়াশোনায় তেমন ভালো ছিল না ,কিন্তু ঘরের কাজ করতে তার খুব পছন্দের। নিজে থেকেই বাসন মাজা, ঘর মোছা , জল তোলা সব ই করতো। ছোট মেয়েটা ও টুকি টাকি কাজ করত।
তা নিয়ে ও বৌদি কে কম কথা শুনতে হয় নি।পায়ের ওপর পা তুলে বসে বসে মেয়েদের খাটাচ্ছে। এই না হলে সৎ মা।নিজের মা হলে এমন করতে পারত?
তবু নতুন বৌদি মুখে কোন দিন কটূ কথা বলে নি । কী অদ্ভুত এরা। কিছু বলার আগে ই নিঃশ্বব্দে কাজ করে যেত।ছোটমেয়েটা বড্ড বাবা নেওটা । বাড়ি ফিরলেই জড়িয়ে ধরত। বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে কী আদর! কিছুতে ই কাজে যেতে দেবে না। নতুন মাকে ও সমানে ভালোবাসত ।
তবু বৌদির মনে একটা কষ্ট সব সময় ব্যথিত করে। মাঝে মাঝে ই বলত আমাকে, যত ই মায়ের মত শাষণ করি না কেন, আমি তো আর সত্যিকারের মা নই। যত ই ভালোবাসি পাড়া প্রতিবেশী বলবে এটা আমার ন্যাকামো । ভালো মা হওয়া সহজ নাকি?
কেউ বুঝতে পারে নি , মায়ের অসুখ টা ই ছোটো মেয়ের শরীরে চলে আসবে।
একদিন হঠাৎ ছোট মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেল । ডাক্তার দেখে বলল,ইমিডিয়েট হসপিটালে ভর্তি করুন।ডাক্তার বললেন ,এখুনি A নেগেটিভ রক্ত চায়। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। সবাই রক্ত খুঁজতে পাগল। দাদার দিশাহারা অবস্থা। কোথাও পাওয়া গেল না রক্ত। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল।
দাদা ডাক্তারবাবুর হাতে পায়ে ধরে বলল,যেভাবেই হোক আমার মেয়েকে সারিয়ে তুলুন।
ডাক্তার বাবু হাসতে হাসতে বললেন,আপনার মেয়ে ভালো আছে। দেখুন বেডে গিয়ে। দাদা, মেয়ের বেডের সামনে গেল।ছোটো মেয়ে বলে উঠলো, "বাবা"। ওই দেখো আমার "মা"।
এই প্রথম এত মিষ্টি করে ডাকল "মা "বলে।
দাদা চেয়ে দেখে পাশের বেডে ই শুয়ে নতুন বউদি । আর বুঝতে বাকি থাকল না। ছোট মেয়ে বৌদিকে দেখিয়ে বলে। ওই যে আমার নতুন মা। চলো আমরা বাড়ি যাই।একমুখ হাসি হেসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল।
---------------------------------------