ছবিঋণ- ইন্টারনেট
ওরা
প্রতিক মিত্র
১
ছেলেটিকে অসময়েই লোক হয়ে যেতে হল। বাবা রসিক ছিল খুব। তাবলে দুর্ঘটনায় মরে যাওয়ার মত চমক দিয়ে যাবে ও ভাবতেও পারেনি।কয়েকটা মাস কিছু আত্মীয়ের দয়া দাক্ষিণ্য হয়তো বা অকৃত্রিম ভালোবাসায় খাওয়া-দাওয়া-মাসকাবারি কেটে গেলেও ছেলেটি বুঝলো একটা কিছু করতে হবে।মুশকিল হল বললেই তো হবে না,কাজে নামার আগে অনেক বাছাবাছি আছে।না হয় বাবার রোজগার যেমন তেমন ছিলনা,তাতে তার মধ্যেও তো সে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে।ফলে যা খুশি একটা যে করবে,করে উঠতে পারছিলনা।তখনও মনে প্রাণে গবেষণার তুমুল ইচ্ছে।কিন্তু একটা চাকরি।কলেজে পার্ট-টাইম পড়ানোর খোঁজ পায় ক'টা।যে সব ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতো তাদের থেকেই জানতে পারে। টিউশন পড়িয়ে যা ওর রোজগার সেটি যথেষ্ট নয়।ফলে…যেতে হল।ইন্টারভিউতে ও শুনেছিল তেমন কিছু চাপ হবে না।মফস্বলের ছোট্ট কলেজে পার্ট-টাইমারের জন্যও যে এই ভীড় দেখে বেচারা বড্ড হতাশ হল।ঠিক তখনই ওর মনে হল বাবার ফ্যাক্টরিতে চাকরিটা চেষ্টা করাটাই উচিত ছিল।সুযোগ এখনও কি মিলবে না?অবাঙালী মালিকের মেয়েটাকে একমাস পড়িয়েছিল।মেয়েটি ওর প্রতি একটু বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছিল বলে ভদ্রলোক ওকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল।বুদ্ধি লোকটার কম নয়।লোহালক্করের ওপর বসে থাকে তো কি, মেয়ে কি পড়ছে কিভাবে পড়ছে সব খেয়াল রাখতো।মনে মনে বেশ খুশিই হয়েছিল ওর পড়ানোর ধরনে। সেই মালিককেই আর একবার ধরলে ক্ষতি কি?মালিকের কথা থেকে মালিকের মেয়ের কথা আসে।মেয়েটিকে শহরের রাস্তায় আর তো তেমন দেখেনি।বয়সে ওর চেয়ে সে অনেকটা ছোটো।মেয়েটা মফস্বলের হাতেগোণা মেয়েগুলোর মধ্যে একজন ছিল যে ওর সাথে কথা বলতো,হয়তো বা পছন্দও করেছিল কিন্তু যে কারণেই হোক ওর মেয়েটিকে তেমন পছন্দ হয়নি। উলটো দিকে বাবা মারা যাওয়ার ক'মাস পর থেকেই একটি মেয়েকে দেখলেই ওর অনুভুতিটা হত ঠিক অন্যরকম।এই মেয়েটিকেও দেখলে বয়সে ওর চেয়ে বেশ কম বলেই মনে হয়।মেয়েটিকে বিভিন্ন জায়গায় ও দেখেছে।এমনকি এই কলেজেও।হয়তো এখানেই পড়ে।ইন্টারভিউ ভালো হলেও কাজটা মেলে না।ইন্টারভিউতে ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন এমন একজন এসেছিলেন।কথাবার্তা হাবভাবে তিনি বুঝিয়েছিলেন ওর কাজটা পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।অথচও তারপরও? হয় ওর মতন ক্যাবলাদের সাথে এমনই হয়।
২
কোলকাতায় গিয়েছিল।কতগুলো বই কেনার ছিল।তাছাড়া হাওড়াতে শেষমেশ যে মেয়েদের কলেজে পার্টটাইমারের কাজটা পেল সেই কলেজের একটা কাজের জন্যও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়াটা ওর জরুরী ছিল। বাসে ভাড়া চাওয়া নিয়ে তুমুল বাওয়াল।যাকে নিয়ে বা যাদের নিয়ে কনডাক্টরের সমস্যা ছিল সে হল ওই মেয়েটি।সঙ্গে একটা হোঁৎকা মতন ছেলে।হাতাহাতি প্রায় লেগে যাওয়ার জোগাড় কেননা ছেলেটির আনাড়িপনা ছিল বাড়াবাড়ি রকমের।সঙ্গে মেয়েটি থাকা সত্বেও ছেলেটিকে রোখা যাচ্ছিল না মোটেও।ওর একবারের জন্য মনে হয়েছিল ওদের জন্য বলুক।বলে আর উঠতে পারে না।কি না কি লোকে ভাববে বিশেষ করে সেই বাসে যেখানে অধিকাংশই তিতিবিরক্ত হয়ে ছিল। শেষমেশ ঝামেলাটার কি হল ওর আর দেখা হয়নি। ও নেমে গিয়েছিল আগে।না চাইলেও চোখ ওর চলে গেল মেয়েটির দিকে। কেন যে ওর মনে হচ্ছিল ওর পাশে থাকা উচিত ছিল মেয়েটির।নিজে লাজুক ক্যাবলা ধরনের বলে হয়তো খেয়াল করেনি, মেয়েটির চোখগুলো কিন্তু তাক করা ছিল ওর দিকেই।
৩
আরো বছর দুএক পরের কথা।জীবন সোজা পথে চলে নি কারো জন্যেও।ওর গবেষণার কাজ শুরু যেমন হয়েছে তেমনি শরিকি ঝামেলার দরুন ওকে আর মাকে বাড়ি ছাড়া হতে হয়েছে। আদি বাড়ির থেকে ওদের এই ভাড়া বাড়িটার ঠিকানা খুঁজে পাওয়াই মুশকিল।বন্ধু ছাত্রছাত্রী ইত্যাদিদেরও লজ্জায় চট করে এখানে আনে না।একটা বন্ধ গলির শেষে একটা খাটাল একটা বস্তি পেরিয়ে আসতে হয়। পড়ানোর জন্য স্টেশনের কাছে ওর এক ছাত্রই একটা ঘর ভাড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।কলেজের লিখিত পরীক্ষায় পাশ করায় বাড়ি থেকে উৎখাত হওয়ার ঘা'টাতে একটু প্রলেপ দেওয়া গেলেও স্থায়ী চাকরি না পাওয়া অবদি…আরো অনেকেরই নিশ্চয়ই অনেক কিছু খারাপ তেমনি অনেক কিছু ভালো হয়েছে।সব হিসেব রেখে কি লাভ?তবে ওই মেয়েটার খবর ও জানে।মেয়েটি যথেষ্ট ধনী বাড়ির মেয়ে।ওনেক ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল।না না ওই হুমদো ছেলেটার সাথে নয়।ওটা ওর দাদা।আসলে বিয়ের বদলে চাকরির ইচ্ছে থাকলেও ওই দাদা আর বাবাই তড়িঘড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করেছিল।মেয়ে সুন্দরী, স্বাধীনচেতা, কাজ করতে চায় তার ওপর কাকে নাকি পছন্দও করে বলে ওর বন্ধুমহলে রটেছিল।ছোটো মফস্বল।খবর ছড়াতে বেশি সময় লাগেনি।ছেলেটি নাকি এমনিতে গোবেচারা,ভীরু গোছের ভালো কিন্তু কাজ কিছু করে না তেমন ফলে।তার ওপর বদনামও রটছিল অনেক।কিন্তু সেই বিয়ে টেকেনি।বিয়ের সাতদিন যেতে না যেতে মেয়ে যে সেই ফিরে এসেছে আর ফেরত যায়নি। ছেলের বাড়ি থেকেও লোক এসেছিল তবে মাস তিনেক পরে। ততদিনে দু'পক্ষই মোটামুটি মানসিকভাবে প্রস্তুত বিচ্ছেদে।
৪
স্থানীয় একটা বিয়ে বাড়িতে ও দেখলো মেয়েটিকে। বিয়ের পর আলাদা কোনো বদল আসেনি তো।এখন তো এটাও জানে মেয়েটির বাড়ির অবস্থা কত ভালো ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়েটির সাথে কোনোদিনই তেমন কোনো ঘনিষ্ঠতা না হওয়া সত্বেও কেন যে ওর বারবার ওর কথা মনে হচ্ছিল।সমব্যথা?আফশোষ?ও ওর ক্যাবলা উদাসীনতা দিয়েই মেয়েটির দিকে আর একবার চেয়ে অবাক হওয়াটা দুরে রাখার চেষ্টা করে এটা না ভেবে মোটেও যে কিভাবে মেয়েটি ওকে পছন্দ করেছিল।ও কি বোকা! না না বয়সের মেয়েটির সাথে ওর তেমনও ফারাক নেই।ওকে দেখতে একটু অমন বাচ্চা বাচ্চা।শাড়ী পরে যেভাবে ও সবার সাথে কথা বলছে বোঝাই যাচ্ছে দাপটটা ওর স্বভাবজাত।তাতে কে কি ভাবলো অবাক হল তাতে কি আসে যায়।যে হুমদো দাদাটা ওর বিয়ের জন্য নাচানাচি করেছিল সেই অনুশোচনায় আহত হয়ে সংকল্প নিয়েছে জীবনটা বোনের।আর ও বোনের সাথে আছে। দু'একটা কথা আশেপাশের লোকেদের সাথে বলে মায়ের সাথে খেতে বসে এবারে ও উদাসীনতা দিয়ে অবাক হওয়া থেকে বোধহয় এবারের মত আর পার পেতে পারেনা।অবাক যে উপস্থিত বাকি নিমন্ত্রিতরাও।মেয়েটি হাজির সোজা ওর কাছে।
৫
না ওদের মধ্যে যা কথা হয় তা না শোনাই ভালো। তবে কথাশেষে হাসতে থাকে দু'জনেই।
-------------------------------------
প্রতীক মিত্র
কোন্নগর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, 712235
ফোন: 8902418417