কাকলি দেব
খোলা হাওয়ায় সতেরো তলার বারান্দায় বসে সকালের উষ্ণ রোদ পোয়ানোর সৌভাগ্য যে বাবার হবে,এ টা বোধহয় বাবা এবং আমরা কেউই আগে ভাবতে পারিনি। নব্বইটা বসন্ত ভালো মন্দে মিশিয়ে বাবা কাটিয়েছিল। জীবনে অনেক মানসিক এবং শারীরিক যন্ত্রনা সহ্য করেছিল। কিন্তু সব কিছুকেই হারিয়ে দিয়ে নিজে জয়ী হবার আপ্রাণ চেষ্টাটা বাবার শেষ পর্যন্ত সফল হলো।
last নভেম্বরে যখন বুকে জল জমে বারো দিন ধরে hospital এর icu তে যমদূতের সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছিল শুধুমাত্র নিজের অদম্ম্য মনের জোর আর বেঁচে থাকার অসীম আগ্রহকে হাতিয়ার করে তখন আমরা ও ভাবিনি বাবাকে বাড়িতে আবার ফিরিয়ে আনতে পারবো !
আজ যখন বাবা সমস্ত ধরা ছোঁয়া র বাইরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে ,তখন সেই মিষ্টি হাসির উদ্দেশে হাত নেড়ে বলবো ,"পরিপূর্ণ একটা জীবন কাটিয়ে গেলে ,বাবা !এতো সৌভাগ্য কম লোকের ই হয়। "
"জীবন কে কেমন করে জিতে নিতে হয় সবাই কে তা দেখিয়ে দিয়ে গেলে।
মাত্র সতেরো বছর বয়েসে নিজের বাবা কে হারিয়ে যে গভীর মনোকষ্টে ভুগেছিলে তার ক্ষত টা বুকের এক কোনায় তোমার আজীবন ছিল !সেই কষ্ট ভুলতে রাজনীতি তে জড়ালে !পারিবারিক জীবনের ছোট্টো গন্ডি তে আটকে না থেকে জীবন কে একটু দূর থেকে নিস্পৃহ ভাবে দেখতে শিখলে !কত সংগ্রাম কাল পার করলে !সেই উত্তাল রাজনৈতিক জীবন ,পশ্চিম বঙ্গের মানচিত্রে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা সময় টা এখন ইতিহাস !কমিউনিস্ট পার্টি র সঙ্গে যুক্ত একজন একনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে নিজেকে খুঁজে পেলে !"
অভাগা দুঃখী মানুষের কষ্ট কে নিজের মনে করে কত রাত বিনিদ্র কাটিয়েছিলে !কোনো প্রতিদান পাবে বলে কোনোদিন রাজনীতি করোনি !
মার্ক্সসিজম নিয়ে পড়াশুনা করলে অনেক। প্রফুল্ল্য সেন এর আমলে যে খাদ্য আন্দোলন হয়েছিল তাতে সক্রিয় ভাবে অংশ নিলে। বাংলার রাজনৈতিক পটচিত্র বদলে গেলো এই আন্দোলন এর ফলে। যুক্তফ্রন্ট গঠন হলো, তোমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করলে সংগ্রামী মানুষের জয় হল এবার।
তোমার নিজের পছন্দের মানুষ কে জীবন সঙ্গিনী লাভ করলে ,পরিবারের পরিধি বৃদ্ধি হলো কন্যা সন্তান এর আগমনে। কলকাতা র উপকন্ঠে নিজের স্ত্রী আর মেয়ে র সঙ্গে থাকতে একটি ছোট ফ্ল্যাট এ। কিন্তু তাদের সময় দিতে পারোনি কখনো। সারাদিন অফিস এর পরে সারা সন্ধ্যে পার্টি অফিস এর দায়িত্ব সামলে যখন রাত এর শেষ বাস এ করে বাড়ি ফিরতে তখন তোমার সঙ্গী হতো আরো একজন যুবক ,যে পরবর্তী সময়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিল। আদর্শগত মিল থাকায় তার সঙ্গে ফেরার পথে কিঞ্চিৎ আলাপ জমে উঠতো ! মুখোমুখি বাড়ি টি তে সেও থাকতো ! পারিবারিক জীবনে যত টা সময় দেওয়া দরকার হতো সেটা রাজনীতি তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিলো। কোলকাতা জেলা কমিটি র দায়িত্ব ছিল তোমার ওপরে !রাজনৈতিক জীবনে অনেক দায়িত্ব নিয়ে অনেক কাজ ও করলে , কিন্তু ব্যাক্তিগত জীবনে র হিসেবে একটু গরমিল হয়ে গেলো।ভালোবাসার মানুষ গুলো যেন দূরে চলে গেলো, রাজনৈতিক বন্ধু রা ঘিরে রইলো !
এমনি করে জীবন এর মধ্যগগনে চাকরী জীবনের অবসান হলো। বলা হয়নি ,প্রথম জীবনে অনেক দামি চাকরি হেলায় ছেড়ে দিয়েছিলে শুধু মাত্র সংগ্রামী রাজনীতি কে ভালোবেসে আর নিজের আত্মমর্যাদা কে অক্ষুন্ন রাখতে ! সেই গল্প আমার শোনা ছিল।
নিজের মতো করে অবসর জীবন কাটাতে শুরু করলে !রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে সরে এসেছো ,communist দের মধ্যে দুর্নীতি এবং অবক্ষয় তোমাকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে তুললো ,এই রাজনীতি তো করোনি কোনোদিন। সমাজ বদল এর আন্তরিক প্রয়াস এইভাবে যখন তাসের ঘর হয়ে ভেঙে যাচ্ছে তখন অন্য একটা জ্ঞানের জগৎ তোমার কাছে দরজা খুলছে ! সেটা হলো 'ইতিহাস 'এর জগৎ। তারপর আবারো ডুব দিলে এক অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারে ,সেটা হলো পৃথিবীর সামগ্রিক ঐতিহাসিক তথ্যের আবিষ্কার ! সেই সময় নিজের পুঁজি প্রায় নিঃশেষ করে দিতে থাকলে শুধু বই কিনতে !সাহিত্য ছাড়া আর বোধহয় সব রকম বিষয়ে অগুন্তি বই এর সংগ্রহশালায় দিনের অধিকাংশ সময় কাটাতে।
মেয়ের বিদেশে থাকার সুবাদে পাঁচবার বিদেশ যাত্রা করলে !মধ্য প্রাচ্য সম্পর্কে অনেক জানতে পারলে ,জানার আগ্রহ তোমার বৃদ্ধ বয়েসেও ঠিক শিশুর মতো ছিল !
রবীন্দ্রনাথ এর গান ভালোবাসতে ,গান শোনার একটা বহুল তাগিদ তোমার মধ্যে সব সময় দেখেছি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গান এর সুরে মন মাতিয়েছিলে। "কত অজানারে জানাইলে তুমি ,কত ঘরে দিলে ঠাঁই। দূর কে করিলে নিকট বন্ধু ,পরকে করিলে ভাই। "এই মন্ত্র জীবনে অন্তস্থ করতে পেরেছিলে। এতো মানুষ দেখলাম ,কিন্তু এই জীবন দর্শন মেনে চলার মতো কম লোকই দেখেছি।
জীবনের শেষ দশ বছর যেভাবে বাঁচলে তা আদর্শ বলা যায় !নব্বই বছরের জীবন কাল শেষ করলে নিজের মেয়ে র কাছে থাকাকালীন , সেও এক পরম পাওয়া দুপক্ষেরই। !একাকিত্ব কে জয় করে নিয়েছিলে সঠিক জীবন বোধ এর সাহায্যে। সেটা কিরকম , একটু বলি ,আজকাল positivity নিয়ে অনেক চর্চা হয় , কিন্তু তোমার মধ্যে সেটা সবচেয়ে বেশি দেখেছি। ভেঙে পড়ার অনেক কারণ কে হেলায় জিতেছিলে নিজের positive, strong মানসিকতা দিয়ে। জীবন থেকে কি করে আনন্দ আহরণ করতে হয় , সেটা শিখিয়ে দিয়ে গেলে।
-------------------------------------------------------------