ছোটগল্প ।। বানের জল ।। শংকর লাল সরকার
বানের জল
শংকর লাল সরকার
গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির পর সকালের দিকে ঝকঝকে রোদ দেখে ছায়া নস্করের ভরসা হয়েছিল আজ বোধহয় জলে টান ধরবে। কিন্তু একটু বেলা হতেই আকাশের অবস্থা ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে লাগল। চাপ চাপ কালো মেঘ ভেসে এসে আকাশের সমস্ত আলোটাকে চেটেপুটে নিতে লাগল। তারপর নামল বৃষ্টি। কখনও প্রবল ধারায় কখনও একটু থেমেথেমে। ওদের বাড়ির একটু নীচ দিয়েই খলবল খলবল করে বয়ে যাচ্ছে জলের স্রোত।
দুপুরের দিকে টিপটিপে বৃষ্টির ভিতর ডিঙি নৌকা থেকে ওদের দাওয়ায় নামল পঞ্চায়েত প্রধানের সাগরেদ তারক নস্কর, সম্পর্কে ছায়ার ভাশুর। ছায়ার একমাত্র ছেলে ন্যাড়া বলল, "এই মেঘবৃষ্টি মাথায় করে কোথায় যাচ্ছিলে জ্যাঠা?"
নতুন ছাতা বন্ধ করে ছায়ার এগিয়ে দেওয়া জলচৌকিতে বসে তারক বলল "তেপান্তরের মাঠে বাড়ি করেছে তোর বাপ। এদিকে এলে তোদের বাড়িতেই আসি। তোরা আমাকে কি মনে করিস জানি না কিন্তু হাজার হোক তোরা হলি আমার ছোট ভাইয়ের ছেলে বউ। তোদের কোন বিপদ দেখলে স্থির থাকতে পারি না। জল যেরকম বাড়ছে এখানে থাকা আর ঠিক নয় তোরা রিলিফ সেন্টারে চল।"
"আমরা রিলিফ সেন্টারে যাব?" ন্যাড়া চেঁচিয়ে ডাকল "মা মাগো!"
তারক বাধা দিয়ে বলল "এখনই না, সময় হলে যাবি। আমি দেখে এলাম এখনও বাঁধের অনেকটা নীচে জল। ইস্কুলের কোঠাবাড়িতে থাকবার, খাবার সব ব্যবস্থা আছে। জল নামলে তোদের আর এই জলাজমিতে ফিরতে হবেনা। আমাদের ওখানেই পাকাপাকি ভাবে থাকবি।"
ন্যাড়ার কৌতুহলী মুখের দিকে তাকিয়ে বলল "আপাতত তুই আমার সঙ্গে পঞ্চায়েত অফিসে চল, রিলিফের চিড়ে গুড় দেবার ব্যবস্থা করি।"
দরজার আড়ালে দাড়িয়ে ছায়া বলল "যৌথ বাড়ির স্বত্ত্ব ন্যাড়ার বাবা ছেড়ে এসে, এখানে জমি কিনে বাড়ি করেছে। দাদা, স্বামীর ভিটে আমি ছাড়তে পারব না।"
তারক জবাব দিল "হ বউ ওখানে তোমাদের কোন অসুবিধা হবে না। ন্যাড়ার বাবার ঘর তো ফাঁকাই আছে ওখানেই থাকবে। আমি তোমাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করে দেব। হাজার হোক তোমরা আমার মরা ছোট ভাইয়ের বউ পোলা।"
যাবার সময় নতুন ছাতাটা খুলে দরজার দিকে মুখ করে আস্তে আস্তে তারক বলল "রিলিফের সব কিছুই ন্যাড়াকে দেব। তবে আমার সেদিনের কথাটা একবার ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখো। জল যেরকম বাড়তে শুরু করেছে এই ঘর আর নিরাপদ নয়। আমি আবার খবর নিতে আসব ন্যাড়ার মা।"
ছাতার তলায় জ্যাঠার গায়ে গা লাগিয়ে নৌকায় উঠে গেল ন্যাড়া। ছায়ার কাছে দৃশ্যটা তৃপ্তিকর। কিন্তু পরক্ষণেই একটা অন্য ভাবনার ভিতরে সে ডুবে গেল। গত কয়েকদিনের একনাগাড়ে বৃষ্টি আর বানের জল বাড়ার জন্য জীবনের আর সব ভাবনা তলিয়ে গিয়েছিল। ছায়ার মনে পড়ল দিন দশেক আগে একদিন ন্যাড়ার জন্য নতুন একসেট জামা প্যান্ট আর ওর জন্য একটা ছাপা শাড়ি নিয়ে এসেছিল তারক। তারপর দরদী গলায় দিয়েছিল একটা প্রস্তাব। বাড়ি বিক্রির প্রস্তাব। হাতে ভালো খদ্দের আছে। জেদি গলায় ছায়া বলেছিল "সে আমি পারব না দাদা। ন্যাড়ার বাবা অনেক কষ্টে এইটুকু জমি কিনে বাড়িটা করেছে। ন্যাড়ার এই সামান্য সম্বলটুকু কোনমতেই বেচতে পারব না।"
তারক বলেছিল "ন্যাড়ার ভাবনা কি কেবল তোমার একার। ওর সঙ্গে আমারও তো একটা রক্তের সম্পর্ক আছে, নাকি? বাড়ি বেচার টাকাতে গঞ্জের মোড়ে একটা মুদির দোকান দেব। তোমরা মায়েপোয়ে চালালে তরতর করে দোকান চলবে। করোনা পরিস্থিতিতে মুদির দোকানেরই তো রমরমা। রাতারাতি তোমাদের অবস্থা ফিরে যাবে। তখন দুই বিঘা জলাজমির বদলে চার বিঘা ডাঙা জমি কিনতে পারবে।"
পরামর্শটা খারাপ নয়। হলে মন্দ হত না। কিন্তু ছায়া কানাঘুষোয় শুনেছে পঞ্চায়েত প্রধানের সাগরেদ তারক এক নম্বরের ফেরেববাজ। অনেককে ঠকিয়ে সে তাদের জায়গা জমি জলের দরে কিনে নিয়েছে। সহজাত বুদ্ধিতে ছায়া টের পায় ওদের জমিটাও তারক দখল করতে চায়। ওর মতলব মাছের ভেড়ি বানাবার। নিজের লোক হয়ে তাদের দুঃসময়ের সুযোগ নিতে চাইছে সে। কিন্তু সব বুঝেও ছায়া কি করবে। কে তার কথা শুনবে? প্রভাবশালী পঞ্চায়ের প্রধানের ডানহাত তারক নস্করের বিরোধিতা করার সাহস কার হবে? সকলেই তো মুখবুজে ওদের দৌরাত্ম সহ্য করে। ন্যাড়া এখনও খুব ছোট। বিধবা মেয়েমানুষের সবচেয়ে বড়ো জোর বাপ ভাইয়ের বাহুবল। কিন্তু ছায়ার বাপ তো সেই কবেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। আর ভাইদুটো তো বোনের খোঁজই নেয় না। সারাটা দুপুর ভেবে ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ছায়া। মন শক্ত করল। বাড়ি সে কিছুতেই বেচবে না। মৃত স্বামী রতনের এটুকু স্মৃতি নিয়েই সে বাঁচতে চায়। বানের জলের ভয়ে স্বামীর ভিটে ছেড়ে সে পালিয়ে যাবে না।
বিকালের দিকে ন্যাড়া ফিরল। হাতে চিড়ে গুড়ের প্ল্যাস্টিকের একটা প্যাকেট আর মাথায় ত্রিপল নিয়ে একবুকে জল ঠেলতে ঠেলতে আসছে। রিলিফের নৌকা বাড়ি অবধি আসেনি, ওকে কম জলে নামিয়ে দিয়েছে। দাওয়াতে পা রেখেই ন্যাড়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলল মা শিগগির কাঁথা নামাও আমার ভীষন শীত করছে। ছায়া ন্যাড়ার কপালে হাত দিয়ে দেখল ওর শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
দিনের আলো মরে আসার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির বেগও বাড়তে লাগল। এলোমেলো হাওয়ার দাপটে নারকেল গাছগুলো নুয়ে পড়ছে। ঝপাস করে একটা আওয়াজ পেয়ে ছায়া জানলাটা একটু ফাঁক করে দেখল দাওয়ার একপাশের মাটি ভেঙে তুলসিমঞ্চটা হেলে পড়েছে। ওর বুকটা বেদনায় মুচড়ে উঠল। ন্যাড়ার বাপ অনেক যত্ন করে ওটা বানিয়েছিল। সাপের কামড়ে মরার পরে ওর কাপড়ে ঢাকা দেহটা বাঁশের চালিতে বেঁধে ঠিক ওখানটাতেই রাখা হয়েছিল। কথাটা মনে হতেই গলার কাছটাতে কান্নার একটা ডেলা আটকাল ছায়ার।
"মা মাগো দরজার খিলটা খোল না, বাবা নৌকা নিয়ে এসেছে।" আচমকা ন্যাড়ার কথাটা কানে যেতেই ছায়া চমকে উঠল। জানলা বন্ধ করে ছুটে এল ন্যাড়ার পাশে। "ও সোনা, জ্বরের ঘোরে কি ভুল বকছিস!"
"ও! বাবা আসেনি, কিন্তু আমি যে স্পষ্ট শুনলাম বাবা আমাদের ডাকছে ঘর থেকে বেরিয়ে নৌকাতে উঠতে বলছে।"
আচমকা সরসর শব্দ শুনে ছায়া খাড়া হয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল। দাওয়ায় চোখ পড়তেই প্রচণ্ড ভয়ে ওর সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠল। জল থেকে ওদের দাওয়ায় উঠে আসছে একটা পেল্লায় রাজ গোখরো। কালচে রঙের শরীরটার উপরে হলদেটে সাদা দাগ। মাথায় পাদুকার চিহ্ন। এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে ওদের বাড়ির দিকে। সুন্দরবনের জল জঙ্গলের মেয়ে ছায়া। সাপ দেখে মুর্ছা যাবার কথা নয় কিন্তু রতন মারা যাবার পর থেকেই সাপ দেখলেই ও প্রচণ্ড ভয় পায়। এখুনি যেন ওটা ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ছুটে দরজাটা চেপে বন্ধ করে ইট দিয়ে ঠেকনা দেয় সে।
সন্ধ্যা পার হতে টের পাওয়া গেল চালের উপরে কিছু নড়াচড়া করছে। আওয়াজ শুনে বোঝা যায় কমপক্ষে আরও দুজোড়া আছে উপরে। তারমানে জল আরও বেড়েছে। ঘন অন্ধকারে ঘরের চারপাশে বয়ে যাওয়া ধারাল সোতের খলবলে ভাষা জানান দিচ্ছে অবশিষ্ট মাটিও চলে যাবে বানের আওতায়। ছায়া ডুকরে কেঁদে উঠে। বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য মনেপ্রানে ঠাকুর ডাকতে থাকে। ওদের বাড়িটা কি শেষপর্যন্ত তলিয়ে যাবে জলের তলায়।
প্র্রবল জ্বরের তাড়নায় ন্যাড়া প্রলাপ বকছে। "জ্যাঠা বলেছে তোর মা রাজী হলেই রিলিফের নৌকা করে তোদের ইস্কুল বাড়ির ক্যাম্পে নিয়ে যাব। সেখানে গেলে আর কিছু ভাবনা নেই।" বসে বসেই তন্দ্রায় ঢুলে পড়ে ছায়া। স্বপ্নে দেখে তারকের নৌকা ওদের দাওয়ার ঘাটে লেগেছে। আচমকা তন্দ্রা ভেঙে যায়, বাড়ি বেচতে রাজী হলে বানের পর ওরা ফিরবে কোথায়? বেদনায় ছায়ার বুকটা মুচড়ে উঠে।
আধা ঘুম আধা জাগরনের মধ্যেই বুঝতে পারে খলবল করে জল বইছে চৌকির তলায়। "ও কাকী ঘরে থাইকো না, বান্ধ ভাইঙ্গা গ্যাছে, গলগল করে জল ঢুকতাসে।" বিশু পাগলার গলার শব্দে প্রথমটায় দিশাহারা হয়ে পড়েছিল ছায়া। তারপরই হুড়মুড় করে একহাঁটু জল ভেঙে দরজা খুলে দাওয়ায় বেরিয়ে এল। চেঁচিয়ে ডাকল "ও বিশুদা একটু দাড়াও! আমার বড়ো বিপদ।"
বিশু পাগলা ফিরল না, চলতি স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল। পাগলের মতো চেঁচিয়ে উঠল ছায়া "হায় হায়! এখন আমি কি করি।" ঘরের ভিতর বিড়বিড় করছে ন্যাড়া। ছুটে ঘরের ভিতরে এসে ছেলেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল ছায়া। কোন শব্দ পেলেই ছুটে আসে বাইরে, এই বুঝি নৌকা এল। তারকের মুখের উপরে বলেছিল স্বামীর ভিটে সে কিছুতেই ছাড়বে না। মরতে হয় এখানেই মরবে। বাড়ি বেচতে রাজী না হলে তারক কিছুতেই এখানে নৌকা পাঠাতে দেবে না।
চৌকির তলার জল লাফাতে লাফাতে উঠে আসছে উপরে। আর একটু পরেই কাঁথা বালিস ছুয়ে ফেলবে। শরীরে ঠাণ্ডা জলের স্পর্শ পেয়ে গুঙিয়ে উঠে ন্যাড়া, "মা কিসে কামড়াচ্ছে জাত লতা নয়তো।" আবছা আলোয় দেখা যায় জলের মধ্যে কিসের সর্পিল অবয়ব। হিসহিস শব্দ করে লম্বা হিলহিলে শরীর এঁকেবেঁকে শুকনো জায়গা খুঁজছে। আবছা ঘরের ভিতরে জলের মধ্যে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে চকচকে কালো হিলহিলে শরীরগুলো।
ন্যাড়া কেঁদে উঠে, "মা জ্যাঠার নৌকা কি আর আসবে না?"
"না রে সোনা আমাদেরই এখন নৌকা হতে হবে।" ন্যাড়াকে কোলে নিয়ে একবুক জল ঠেলে দাওয়ায় বেরিয়ে আসে ছায়া। এলোমেলো ঝোড়ো হাওয়া। চারদিকে হুহু করে বইছে জলের স্রোত। সাঁতার দিতে ভয় হয়। অভুক্ত শরীরে আর শক্তি নেই। কিন্তু একজায়গায় দাড়িয়ে থাকা চলবে না। স্রোতের টানে ভাসতে হবে।
ভেসে যেতে যেতে চোখে পড়ল ঘরের চালে খাটো লাঠির মতো দুটো কালো রঙের চকচকে শরীর। ওরা উঠেছে চালের উপরে। তবে যেভাবে জল বাড়ছে ওখানটাও আর কতক্ষণ জলের উপরে থাকবে বলা যায় না। অন্ধকারের ভিতরে স্রোতের টানে স্বামীর ভিটে থেকে দূরে সরে যেতে যেতে ওদের উদ্দেশ্য করেই ছায়া চেঁচিয়ে বলল, "আমরা বানের জলে ভেসে গেলাম খবরটা তোরা দিস।"
শংকর লাল সরকার
Mob. 8637852643
E. Mail. shankarlalsarkar@gmail.com