সঠিক পরিসংখ্যান এই মুহূর্তে আমার হাতে নেই। তবে আমার ধারণা লাখে হয়তো দুএকটা এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানও বিষয়টিকে স্বীকৃতি জানিয়েছে। বলা ভালো স্বীকৃতি জানাতে বাধ্য হয়েছে। বিজ্ঞানের তো এটাই দায়, যা ঘটমান সত্য, তাকে স্বীকৃতি জানিয়ে যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা হাজির করা। এমন ঘটনা যে কেবল স্মরণাতীত কালে ঘটত তা নয়, সাম্প্রতিক কালেও আমরা সংবাদপত্র বা অন্যান্য মিডিয়ায় এমন ঘটনার প্রকাশ দেখেছি। দেখে বিস্মিত হলেও আতঙ্কিত হইনি। বরং মানুষের অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তির প্রকাশ দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছি। জীবন-উচ্ছিন্ন মানুষটিও ফিরে পেয়েছেন ছেড়ে যাওয়া সবকিছু, স্বজনবান্ধবও তাঁকে সাদরে ডেকে নিয়েছেন। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন এমন ঘটনার কথা শুনলে মানুষের হৃৎকম্প শুরু হত। আর যারা এমন ঘটনার শিকার হত, তাদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা কতটুকু বা বর্ণনা করতে সক্ষম এই যান্ত্রিক কিবোর্ড !
হারাধন মণ্ডল, ১৯০১ সালে না-জন্মে যদি আরও চল্লিশ পঞ্চাশ বছর পরে জন্মাতেন তাহলে হয়তো তাঁকে মৃত্যুর অধিক এক বিড়ম্বনার শিকার হয়ে কুলদূষক হিসাবে বংশলতিকা থেকে মুখ লুকোতে হত না। তারাপদ, নিরাপদর মতো সুপদর বিয়েটাও তিনি জাঁকজমক করে দিয়ে যেতে পারতেন। তারাপদ, নিরাপদর মতো সুপদর ছেলেমেয়েকেও কোলে নিয়ে তিনি পরম আনন্দে গুষ্ঠিসুখ অনুভব করতে পারতেন। কিন্তু সে সুযোগ তিনি পাননি। বলা ভালো প্রবলপ্রাণ হারাধন মণ্ডলকে সেই সুযোগটুকু দেওয়াও হয়নি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে সেদিন হারাধন মণ্ডলের যে কী খেয়াল হল ! পুকুরে জাল ঠ্যাঙাতে মানে জাল ফেলতে শুরু করলেন। দশটা প্রমাণ সাইজের ভেটকি না-ধরে তিনি জাল ফেলা থামাবেন না। ঘোষেদের সঙ্গে চলা দশ বছরের মামলাটির নিষ্পত্তি হয়েছে গতকাল। সেই জয়ের আনন্দ উদযাপনের জন্য এই দশভেটকিবধের পরিকল্পনা। বাড়িতে লোকজন তো কম নয়, ঝি-চাকর মিলিয়ে পঞ্চাশ-ষাট জন তো হবেই। হারাধন মণ্ডলের ধনুক ভাঙা পণের কথা কারও জানতে বাকি নেই। তাই কেউ তাঁকে থামানোর চেষ্টা করল না, সাহায্য করতেও এগিয়ে এল না কেউ, না ছেলেরা, না ভাইপোরা, না বাড়ির কাজের লোকজন। শেষমেশ দুটো জাল ছিঁড়ে তিন নম্বর জালটি ভিজিয়ে দশম ভেটকিটাকে ডাঙায় তুলে তিনি বিজয়ীর হাসি হাসলেন, তবে তা ক্ষণিকের। জালসমেত পেল্লাই সাইজের ভেটকিটাকে উঠানে ছুড়ে দিয়ে তিনি গোলাঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে পড়লেন। স্ত্রী সৌদামিনী গোলাঘর নিকোনোর কাজ দেখভাল করছিলেন। তিনিই প্রথম আন্দাজ করেন। মানুষটা তো কখনও এমন আচরণ করে না।
— সদু, আমাকে একটু জল এনে দাও। যন্ত্রণায় ছাতিটা ফেটে যাচ্ছে।
এইটুকু কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন হারাধন মণ্ডল। বাড়ির লোকজন যখন বুঝলেন, তখন অবস্থা আয়ত্তের বাইরে। সৌদামিনীর হাতের জলটুকু পাথেয় করে তিনি চললেন সুদূর ভ্রমণে। কবিরাজ আসেন, নাড়ি দেখেন এবং মাথা নেড়ে চলে যান।
সমস্ত আয়োজন সেরে বেরোতে বেরোতে অনেকটা রাত হয়ে যায়। শ্মশানযাত্রীর সংখ্যা কম করে শ-দেড়েক তো হবে। শ্মশান খুব কাছে নয়, ক্রোশ তিনেক পথ। মাঝে আধ ক্রোশ জঙ্গলাকীর্ণ। সাপখোপ ও বুনো জীবজন্তুর সঙ্গে মিলেজুলে ডাকাতরাও ঘাঁটি গেঁড়ে থাকে ওই বনের গহনে। তবে তার থেকেও বড় এক ভয় শ্মশানযাত্রীদের ত্রস্ত করে রাখে। হাড় হিম করা সেই অশরীরী ভয় তাদের মনের জানালায় বারংবার উঁকি দিয়ে যায়। হারাধন মণ্ডলের বড়দা সনাতন মণ্ডলের হাতে গাদা বন্দুক। মেজদা ও সেজদার হাতে সাহেবি বর্শা। শ্মশানযাত্রীদের মধ্যে পাকা লাঠিয়াল আছে জনা কুড়ি। বাকিদেরও হাত ফাঁকা নেই। আত্মরক্ষার্থে তারা লাঠি-সড়কি যা পেয়েছে সঙ্গে নিয়ে নিয়েছে। ফলে ডাকাতদের ভয় শ্মশানযাত্রীদের মন থেকে একেবারেই মুছে গেছে। কিন্তু অন্য ভয়টি, যা আসলে অনপনেয় তা তখনও জেঁকে বসে আছে। একমাত্র ভরসা, সঙ্গে রয়েছেন পঞ্চাখুড়ো। সত্তর-বাহাত্তর বছর বয়সেও তিনি যেন জোয়ান মদ্দ। জীবনে কত যে দাহকার্য সেরেছেন তার ইয়ত্তা নেই। নিজের হাতে তিনি নারকেল দড়ির মোটা কাছি বানিয়ে তা দিয়ে খাটিয়ায় শায়িত হারাধন মণ্ডলকে জম্পেশ করে বেঁধে ফেলেন। খাটিয়ার মাথার দিকে একটি হাঁসুয়াও গুঁজে দেন। কাজ শেষ করে তিনি সবাইকে অভয় দিয়ে বলেন, ভয়ের কিছু নেই ; শুধু জঙ্গলের পথটুকু সাবধানে চললেই হল।
খান পনেরো হ্যাজাক লাইট, পঁচিশ তিরিশটা মশাল; এমন এলাহি ব্যাপার যেন শবযাত্রা নয়, শোভাযাত্রা। অমাবস্যার ঘোরতর অন্ধকারকে নাস্তানাবুদ করে শ্মশানযাত্রীরা এগিয়ে চলে। ক্রোশ দুয়েক পথ অতিক্রম করার পর জঙ্গল শুরু হয়। জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে পথ; মাথার উপরেও লতাপাতার চাঁদোয়া। বর্ষা শুরু হয়নি তাই রেহাই। নচেৎ জঙ্গলাকীর্ণ মেটে পথটুকু পার করতে জান বেরিয়ে যেত। কোথাও কোথাও জঙ্গল এমন ঝামরে পড়েছে যে, শববাহীদের প্রায় হাঁটুমুড়ে এগোতে হচ্ছে। এমনটা না-করলে খাটিয়া উপরের লতাপাতায় আটকে যাবে। পথপ্রদর্শক পঞ্চাখুড়োর নির্দেশমতো লেঠেলদল গাছে গাছে আঘাত করে কাউকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। আর পঞ্চাখুড়ো কখনও বিভিন্ন দেবদেবীর নাম, কখনও নানা খিস্তিখেউড় উচ্চস্বরে আওড়ে চলেছেন, যেন ছড়া কাটছেন। অবশেষে জঙ্গলের পথ শেষ হয়। ততক্ষণে আসন্ন ভোরের আলো জঙ্গলের মাথা ছুঁয়ে ফেলেছে। শ্মশানযাত্রীরা ফাঁকামাঠে পৌঁছে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এখানে তারা খানাপিনা করে এতক্ষণের ধকল একটু সামলে নেবে। মশালগুলি বৃত্তাকারে মাটিতে পুঁতে দিয়ে সবাই হাত পা ছড়িয়ে মাঠে বসে পড়ে। কেউ কেউ পানীয়ের বোতলে চুমুকও দেয়। এমন সময় খাটিয়া বহনকারীদের আর্তনাদ সকলকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। খাটিয়া নামিয়ে শববাহীরা দেখে খাটিয়া ফাঁকা, হারাধন মণ্ডল নেই। দড়ির বাঁধন কাটা, খাটিয়ার মাথার দিকে যে হাঁসুয়াটি পঞ্চাখুড়ো গুঁজে দিয়েছিলেন সেটিও নেই। খাটিয়া থেকে দেহ উধাও হয়ে গেল অথচ শববাহীরা বুঝতেই পারল না ! শ্মশানযাত্রীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়, কেউ কেউ শববাহীদের দোষী সাব্যস্ত করে প্রহারে উদ্যত হয়। কেউ কেউ কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। পঞ্চাখুড়ো অভিজ্ঞ মানুষ, শববাহীদের দলকে দোষারোপ বা খিস্তিখেউড় কিছুই করেন না। তিনি জানেন খাটিয়ায় যখন মড়া উঠে বসে, তখন আচ্ছা আচ্ছা মদ্দ বাকহারা হয়ে ধুতি ভিজিয়ে ফেলে। সে সময় অতি বড়ো সাহসীও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। পঞ্চাখুড়ো অনুমান করেন ঘটনাটি বেশি আগে ঘটেনি, সম্ভবত জঙ্গল থেকে বেরোনোর কাছাকাছি সময়েই এমনটা ঘটে থাকবে। তিনি কাউকে কিছু না-বলে আপনমনে কী সব বিড়বিড় করতে করতে সবাইকে খাটিয়ার চারপাশ থেকে সরে যেতে ইশারা করেন, কোমরে গোঁজা কাস্তেটা নিয়ে তিনি খাটিয়ার চারদিকে দণ্ডী টেনে দেন। তারপর খাটিয়ার পায়ের দিকে উবু হয়ে বসে হাতের লাঠিটা দিয়ে সপাটে তিনবার খাটিয়ায় আঘাত করেন। জঙ্গলের ভিতরে পাখপাখালির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যায়। পঞ্চাখুড়ো দাঁড়িয়ে পড়েন, গলায় বেশ কিছুটা কারণ ঢেলে সমবেত শ্মশানযাত্রীদের উদ্দেশে গলা চড়িয়ে তিনি বলতে শুরু করেন, শোন শালারা, ভয় পাবি না মোটেও, এসব আমি কম দেখিনি। যেমনটা বলব তেমনটা করবি। আমাদের সঙ্গে খাবারদাবার বা মদের কমতি নেই। সবাই ভালো করে খেয়ে দেয়ে নে। সকাল হল বলে, খানাপিনা সেরে সবাই লাঠি হাতে বেড়িয়ে পড়বি। আমাদের ছোটোবাবুকে দানোতে পেয়েছে। তবে যত বড় দানোই হোক না-কেন, ও শালা বেশি দূর যেতে পারবে না। ভাগ্য ভালো হলে শালা নিজেই মাথার ঘোরে খাটিয়ার কাছে ফিরে আসবে। আমি থাকব খাটিয়া-পাহারায়। একটা কথা মাথায় রাখবি, তোদের দেখলে শালা কিন্তু খুব কান্নাকাটি করবে। বলবে আমি মরি নাই, আমি হারাধন মণ্ডল, বাবা হারানিধি মণ্ডল ; আরও চোদ্দো পুরুষের পরিচয়ও বলে যাবে গড়গড় করে। ওর কথায় কান দিবি না, লাঠির এক ঘায়ে শালার মাঠাটা ফাটিয়ে দিবি। যদি কোনোভাবে ...
পঞ্চাখুড়োর কথা শেষ হয় না। জঙ্গল লাগোয়া ঝোপে একটি শেয়াল ডেকে ওঠে। তার রেশ ধরে জঙ্গলের ভিতরেও অগণিত শেয়াল সুর মেলায়। আকস্মিক এই শিবারবে শ্মশানযাত্রীদের দৃষ্টি জঙ্গলের দিকে ঘুরে যায়। সকলে বিস্ময়বিমূঢ় চোখে দেখে, ভোরের সোনালি আলো মেখে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছেন স্বয়ং হারাধন মণ্ডল; খালি গা পরনে মালকোঁচা দিয়ে পরা সাদাধুতি, ডানহাতে ধরা রয়েছে পঞ্চাখুড়োর দেওয়া সেই হাঁসুয়া।
---------------------------------------------------
চন্দন মিত্র
ভগবানপুর (হরিণডাঙা), ডায়মন্ড হারবার
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা