সময়টা উনিশ শতকের গোড়ার দিকে , ভারতে ইংরেজ শাসন শেষ হবে হবে করছে। তবে উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ টি এস্টেট এর মালিকানা তখনও ইংরেজদেরই হাতে ।দার্জিলিং হিমালয়ের কোলে গড়ে ওঠা এমনই এক টি এস্টেট এর মালিক ছিলেন ফ্রেডরিক সাহেব, পুরো নাম ফ্রেডরিক উইলসন ।
আজ যে গল্প বলবো, তা এই ফ্রেডরিক সাহেবকে ঘিরেই। গল্পটা শুনেছিলাম আমারই এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মুখে । সম্পর্কে তিনি আমার দাদু স্থানীয় । দাদু পুরোনো দিনের মানুষ, ঝুলিতে তার অনেক গল্প ।যৌবন বয়সে কিছু দিনের জন্য তিনি কাজ করেছিলেন ওই ফ্রেডরিক উইলসন সাহেবের বাড়িতে । তবে কিছুদিন যেতে না যেতেই সে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি ।
কেন ? সেটি নিয়েই গল্প ।
আমার সেই দূর সম্পর্কের দাদুর বয়স তখন বেশ কম। সদ্য স্কুল ফাইনাল পাস করে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন । বাড়িতে চরম অনটন ।ঠিক এখনকার পরিস্থিতি না হলেও সরকারি চাকরি পাওয়াটা নেহাতই ছেলেখেলা ছিলনা সেই সময়েও ।
হঠাৎ একদিন উত্তরের একটি টি এস্টেট এ কেরানী পদে লোক নিচ্ছে খবর শুনে দাদু ছুটে গেছিলেন সেখানে । যদিও তাতে লাভ হয়নি মোটেই। চাকরিটা দাদুর হাত ফস্কে যায় অল্পের জন্য ।কিন্তু ঠিক সেইসময়ই কোনো এক শুভাকাঙ্ক্ষী বাঙালি ভদ্রলোক দাদুকে পরামর্শ দেন, যে কোনো ভাবে বাগানের মালিক ফ্রেডরিক সাহেবের অনুগ্রহ লাভ করতে পারলে নাকি , যেমন তেমন কিছু হোক ,কাজ একটা জুটে যাবেই ।
ফ্রেডরিক সাহেব এমনিতে নাকি বড্ড দয়ালু মনের মানুষ তবে একটু বেশীই খামখেয়ালী স্বভাব যেন তার।
শেষ বয়সে বিশাল ব্যবসার দায়িত্বভার প্রায় পুরোটাই এদেশীয় এক অংশীদারের হাতে তুলে দিয়ে, নিজেকে সবার থেকে খানিকটা গুটিয়েই নিয়েছিলেন ফ্রেডরিক সাহেব।
তার টি এস্টেট থেকে মাইল খানেক দূরে এক নিরিবিলি আর বেশ মনোরম পাহাড়ি বাঁকে শখ করে তৈরি করেছিলেন এক বাংলোবাড়ি।নাম - "রোজ কটেজ " ।
যৌবনকাল থেকেই ফ্রেডরিক সাহেব ভীষণ শৌখিন ও অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ হিসেবেই ওই এলাকায় পরিচিত ছিলেন । আর তার সেই শখের নিদর্শন ছড়িয়ে ছিল গোটা রোজ কটেজ এর দেওয়াল জুড়ে। লেপার্ড থেকে বাইসন , হরিণ থেকে বুনো দাঁতাল এমনকি গন্ডার অব্দি, কেউই তার বন্দুকের অব্যর্থ নিশানার হাত থেকে রেহাই পায়নি কক্ষনো।
শেষ বয়সে এহেন ফ্রেডরিক সাহেব হয়ে পড়েছিলেন এক্কেবারে নিঃসঙ্গ।তবুও সুদূর স্বদেশে ফিরে যাবার কথা কখনো ভাবেননি তিনি। উত্তরবঙ্গের পাহাড়, জঙ্গল ,নদী, চায়ের বাগান এসবের সাথে যেন আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার।
বুড়ো ফ্রেডরিক সাহেবের সবসময়ের সঙ্গী ছিল তার এক মাঝবয়েসী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান চাকর মরিস , যাকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন সুদূর কলকাতা থেকে । এছাড়া ছিল বাংলোর মালি ও দারোয়ান বাহাদুর ।
সাহেব অবিবাহিত বা নিঃসন্তান কোনোটাই ছিলেন না । দাদু শুনেছিলেন সাহেব বিপত্নীক আর তার একমাত্র কন্যা নাকি থাকেন সেই সুদূর ইংল্যান্ডে ।
এরপর কোনো এক সকালে , আমার সেই দূর সম্পর্কের দাদু একপ্রকার মরিয়া হয়েই পৌঁছে গেছিলেন 'রোজ কটেজ ' এ ।ফ্রেডরিক সাহেবের অনুগ্রহ লাভের আশায়। সপ্তাহে দুদিন মাত্র বাইরের লোকেদের সাথে দেখা করতেন সাহেব । বাকি দিনগুলোতে শুধু খুব দরকারি কাজ ছাড়া বাইরের কারো সাথেই তেমন মেলামেশা করতেন না তিনি।
প্রায় ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করার পর, সাহেব চুরুটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বাংলো থেকে বেরিয়ে এসে বসেছিলেন সামনের ভীষন নরম আর ভেলভেটের মতো চকচকে সবুজ ঘাসের লনে।
ফ্রেডরিক সাহেবের চেহারা দেখে বয়স আন্দাজ করা ছিল বেশ কঠিন । প্রায় ছ ফুট উচ্চতা , টিকালো নাক, লালচে সাদাটে চামড়া, শীর্ণ অথচ শক্তপোক্ত শরীর আর মাথা ভর্তি বাদামি চুল । দাদুর এরপর মাঝে মাঝেই ওনাকে দেখে কোনো বিদেশি উপন্যাসের নায়ক বলে ভ্রম হতো।
স্থানীয় দু একজন লোক সাহেবের সাথে টুকটাক কিছু কথা বার্তা বলে বিদায় নিলে , দাদু সাহস করে এগিয়ে যান সাহেবের দিকে।
" হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট .. ইয়ং ম্যান ?" সাহেবের রাশভারী গলা শুনে,
প্রথমে রীতিমত ঘাবড়ে গেছিলেন দাদু । তারপর কোনমতে নিজেকে সামাল দিয়ে, সাহেবের কাছে নিজের আর্জি তুলে ধরেন তিনি ।
নাহ্ এবার ভাগ্য সহায় হয়েছিল তার। ফ্রেডরিক সাহেব এর মেজাজ সেইদিন কোনো কারনে ছিল বেশ ফুরফুরে। তার ওপর দাদুর মুখে ঝরঝরে ইংরেজি শুনে খুব খুশী হয়েছিলেন তিনি । তবে আরো খুশি হয়েছিলেন দাদু বন্দুক চালাতে জানেন শুনে ।
সুতরাং সেইদিন দাদুকে আর খালি হাতে ফিরতে হয়নি ।
টি এস্টেট এর কেরানীর চাকরি না জুটলেও , জুটেছিল খোদ ফ্রেডরিক উইলসন সাহেবের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এর চাকরি । বেতন বেশ ভালো, সাথে থাকা খাওয়া যাকে বলে এক্কেবারে ফ্রী। আর কাজও তেমন আহামরি কিছু নয়। সাহেবের ব্যবসা সংক্রান্ত কাজ ও কাগজ পত্রের হিসেব রাখা আর মাঝে মাঝেই বন্দুক হাতে সাহেবের সাথে বনে বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়ানো । ওই চাকরি যে সেই সময় দাদুর কাছে হাতে চাঁদ পাবার সামিল ছিল তা বলাই বাহুল্য।
ইউরোপীয় ধাঁচে তৈরি রোজ কটেজের গায়ে যেন মাখানো ছিল এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা । নির্জন পাহাড়ি বাঁকে যেন কারো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত ধবধবে সাদা রঙের বাংলোটি। কাছে গেলেই বাতাসে ম ম করতো নাম না জানা নানান ফুলের সুগন্ধ। দাদুর জন্য বরাদ্দ হয়েছিল বাংলোর দোতলার দক্ষিণ কোণের একটি ঘর।
সবকিছু চলছিল বেশ। শুধু মাঝেমধ্যে দাদুর কেমন খটকা লাগতো ,সাহেবের মাঝবয়েসী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান চাকর মরিসকে দেখে । সাহেবের ঘর গেরস্থালি দেখাশোনার একমাত্র লোক ছিল সে। দোহারা চেহারা , গায়ে হলদেটে ফর্সা চামড়া , মাথায় পাতলা কালো চুল আর ঘোলাটে চোখে সর্বদা সতর্ক চাউনি। বড্ড বেশী রকমের চুপচাপ যেন মরিস । তার সাথে কেমন একটা ভীরু অথচ রহস্যময় হাবভাব সারাটাক্ষণ। যেচে আলাপ করতে চাইলেও সে যেন বারবার এড়িয়ে যেত। সাহেবের সাথেও যে খুব একটা কথাবার্তা হতো মরিসের, তাও নয়। সাহেবের কখন কি দরকার সে নিখুঁত ভাবে সাজিয়ে রাখতো হাতের কাছে । তা সে সাহেবের পায়ের জুতোই হোক কিংবা তার পছন্দের খাবার বা পানীয়।
অন্যদিকে দারোয়ান ও মালির কাজ একা হাতেই সামাল দিত বাহাদুর । বাংলোর সদর গেটে তালা দেওয়া থাকতো প্রায় সর্বক্ষণ। বাহাদুরকে পুরোটা সময়ই দেখা যেত বাগানে কাজ করতে। মরিসের তুলনায় যদিও তার আচরণ ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক । তবে বাহাদুর আবার দেশী মদের নেশায় চুর হয়ে থাকতো দিনরাত। ওর সাথে চাইলেও গল্প তেমন জমে উঠতে চাইতো না দাদুর। ভাষাগত সমস্যাও ছিল এর এক বড় কারণ। বাহাদুর স্থানীয় লোক। তার কিছু আত্মীয় স্বজন কাছের পাহাড়ি বস্তিতে থাকতো বটে,তবে নিজের পরিবার পরিজন বলতে তেমন কেউই ছিল না বাহাদুরের।
সবুজ জঙ্গলে ঢাকা দার্জিলিং হিমালয়ের কোলে ফ্রেডরিক সাহেবের বাংলো যেন ছিল একটুকরো ইউরোপ । সেখানের খাবার দাবার , পরিপাটি করে সাজানো আসবাব পত্র , মেঝেতে পাতা দামী কার্পেট, গ্রামাফোনের সুর সবমিলিয়ে যেন সম্পূর্ন অন্য এক জগত।
বাংলোর চারপাশটা ঘিরে ছিল বেশ কিছুটা ফাঁকা জমি । ঝকঝকে সবুজ গালিচার মতো সে জমিতে বাহাদুরের হাতের যত্নে গজিয়ে উঠেছিল রঙ বেরঙের নানা জাতের বাহারি ফুল গাছ । বাংলোর সামনের লনে রোজ সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিল পাতা হতো। মরিসই একা হাতে সব ব্যবস্থা করত। বাংলোর পেছনের বাগানে ছিল কিছুটা বড় আকারের গাছপালার ভীড় । নানা রকম পাতাবাহার, পাইন, জুনিপার রডোডেনড্রন এইসব। কোনো কোনো গাছের নিচে তৈরি করা ছিল সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বসবার জায়গা।আর ওই বাগানেরই একেবারে শেষ প্রান্তে খাদ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল এক জং ধরে যাওয়া লোহার দোলনা। তবে তালাবন্ধ অবস্থায় । বাড়ির কারোরই পেছনের বাগানে খুব একটা যাতায়াত ছিল না । এমনিতেই সারাটা দিন বেশ নিঝুম পরিবেশ । তার ওপর
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে যখন দ্রুত সন্ধ্যে গড়িয়ে নামতো, রোজ কটেজে হঠাৎই যেন টের পাওয়া যেত এক গা ছমছমে অনুভূতি।
আমার সেই দাদু তখন সদ্য যৌবনে পা দিয়েছেন।পাড়া গাঁয়ের ছা পোষা জীবন ছেড়ে হঠাৎ অমন এক পরিবেশে এসে যেন সব কিছুই তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হতো।
সাহেব শিকারে বেরোতে চাইলে পাশের গ্রাম থেকে বাহাদুর ঘোড়া নিয়ে আসতো বাংলোর গেটে । প্রথম দিন দাদুর জন্যও ঘোড়া আনা হয়েছিল বটে, তবে ঘোড়ায় চড়তে না জানায় , সেই যাত্রায় দাদুর শিকার করতে যাওয়া হয়নি । তাই চাকরিতে যোগদানের দিন পাঁচেকের মাথাতেই দাদুকে রীতিমতো ঘোড়ায় চড়ার তালিম নেওয়া শুরু করতে হয়েছিল । সাহেবের ফরমান বলে কথা ।
সেইসময় একটা অদ্ভুত কথা কানে এসেছিল দাদুর। একসময় সাহেবের বাংলো লাগোয়া জমিতেই তার নিজস্ব ঘোড়ার আস্তাবল ছিল । কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ঘোড়াগুলো নাকি সেখানে আর থাকতে চাইছিল না । সন্ধ্যে নামলেই যে কোনো ভাবেই হোক এমনকি দড়ির শক্ত বাঁধন ছিঁড়ে হলেও তারা পালিয়ে যেতে শুরু করেছিল। অগত্যা তাই পাশের বস্তিতে সাহেবের ঘোড়া রাখবার ব্যবস্থা করতে হয় ।
দিন পনেরো কেটে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে একটা অদ্ভুত রকমের অস্বস্তি অনুভব করা ছাড়া দাদুর আর তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছিল না । সাহেব বেশ মুডি মানুষ ছিলেন । নিজের লাইব্রেরী রুমে পছন্দের বই আর গান নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন বেশিরভাগ সময়। কখনো ইচ্ছে হলে ডিনার শেষে টেবিলে দামী পানীয়ের বোতল সাজিয়ে ডেকে পাঠাতেন দাদুকে । দাদুও বেশ খুশি মনেই সাহেবকে সঙ্গ দিতেন শেষ পেগ পর্যন্ত। সে সময় মাঝে দু এক বার সারারাত ধরে ফ্রেডরিক সাহেবকে প্রলাপ বকতে দেখেছিলেন দাদু । অশ্রুভেজা চোখে জড়ানো গলায় কার সাথে যেন দুর্বোধ্য ইংরেজিতে কথা বলে যেতেন তিনি একটানা।
আপাত দৃষ্টিতে সবকিছু বেশ স্বাভাবিক চলছিল তবুও কেনো যেন দাদুর মনে ঘুরেফিরে নানারকম সন্দেহ দানা বাঁধতে লাগলো । বিশেষ করে মরিসের আচরণ ছিল বেশ সন্দেহজনক । মরিস অকারনেই দূর থেকে দাদুর ওপর নজর রাখতো। অথচ সামনে থেকে আলাপ করতে গেলে চোখ নামিয়ে যেন পালিয়ে বাঁচত সে।
একদিন এক পড়ন্ত বিকেলে রোজ কটেজে প্রথমবার দাদুর সাথে ঘটে যায় এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ।সময় যেন এরই অপেক্ষা করছিল । বাংলোর পেছনের বাগানে একা ঘুরতে ঘুরতে দাদু হঠাৎ স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন সেই জং ধরা লোহার দোলনাটিতে বসে দোল খাচ্ছে সোনালী চুলের এক কিশোরী মেম সাহেব । পরনে তার সাদা ধবধবে এক ফ্রক । দাদুর পায়ের আওয়াজ পেয়েই বোধহয় দোলনা থামিয়ে একছুটে দৌড়ে পালিয়ে গেছিল সে । বলা ভালো হাওয়ায় মিশে গিয়েছিল যেন ।
বাংলোর বুকে নেমে আসা ধোঁয়াটে অন্ধকার মাখানো সে সন্ধ্যেতে , বাগানের শেষ প্রান্ত থেকে ভেসে এসেছিল মেয়েলি গলার খিলখিল হাসির আওয়াজ । বাগানের গাছপালা গুলো দুলতে শুরু করেছিল হঠাৎ। দাদুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল আচমকাই ।
পরদিন সকালে বাহাদুরকে কথাটা জানাতেই সে খুরপি হাতে মাটি খোঁচাতে খোঁচাতে বলে -' সাব আপ ডর গয়ে ক্যায়া ? উও কভি কভি আতি হ্যায় । ডর লগে তো ভাগ যাও । ' বলেই দাঁত
বের করে হাসতে শুরু করেছিল সে।
বেশিরভাগ সময়ই বাহাদুর এর কথার মাথামুন্ডু কিছুই বোধগম্য হতো না দাদুর । নেশার ঘোরে কখন কি যে ভুলভাল বলে চলতো সে , তার কোনো ঠিক ছিল না।
তবে বাহাদুরের কথাগুলো যে নেহাতই ফেলনা নয় সেটা দিনকয়েক যেতে না যেতেই টের পাওয়া গিয়েছিল বেশ । বরাবরের মত মাঝরাতে একটা অদ্ভুত রকমের অস্বস্তি বোধ হতেই ঘুম ভেঙে গেছিল দাদুর । হঠাৎ করে বড্ড বেশি শীত করছিল যেন ।
বাইরে কি তবে বরফ পড়বে ! নাহ্ এপ্রিলের শেষে বরফ পড়ার কোনো সুযোগ নেই । তাহলে!!
দাদু লক্ষ্য করলেন গোটা ঘরটা জুড়ে একটা ঠান্ডা হাওয়া যেন ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছে ক্রমাগত। কোনো জানালা কি তবে ভুলবশত খোলা রয়ে গেছে ? নাহ্ পর্দা তো উড়ছে না।.... তবে !!
গা টা ক্রমশঃ অস্বাভাবিক ভারী হয়ে আসতে লাগলো দাদুর । রাত তখন প্রায় ২ টো। সাহেবের পড়ার ঘর থেকে গ্রামাফোনের করুণ এক সুর ভেসে আসছে । ঘর জুড়ে ডিম লাইটের হালকা নীলাভ আলো। পাথরের মতো নিথর শরীর নিয়ে বিছানায় বসে থাকতে থাকতে দাদু যেন হঠাৎ আবার দেখতে পেলেন সেই কিশোরী মেম সাহেবকে।অবিকল সেদিন সেই দোলনায় দোল খেতে দেখা কিশোরীটি ! কাধেঁর ওপর খোলা এক ঢাল সোনালী চুল। পলক ফেলতে না ফেলতেই দরজা খুলে এক নিমেষে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে ।
সকালে দাদুর যখন ঘুম ভাঙে, তখন গায়ে তার বেশ জ্বর।তাই সাহেবের সাথে দাদুর সেদিন নেওড়ার জঙ্গলে শিকারে যাবার পরিকল্পনা বাতিল করতে হয় । ফ্রেডরিক সাহেবকে আগের রাতের ঘটনা পুরোটা খুলে বলতেই তিনি একটা ভীষন রকম গম্ভীর আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ করে শুধু বলেছি লেন - "ইউ নিড মোর স্লিপ গাগান , টেক কেয়ার অফ ইওরসেলফ " ।
আমার সেই দূর সম্পর্কের দাদু গগন চন্দ্র রায় ফ্রেডরিক সাহেবের বাংলা উচ্চারণের দৌলতে গগন থেকে গাগান এ পরিনত হয়েছিলেন অচিরেই ।
দাদুর প্রথম চাকরির শুরুর কটা মাস কেটে যাচ্ছিল এভাবে ।সোনালী চুলের মেয়েটি সম্পর্কে জানতে চেয়ে, কি ফ্রেডরিক সাহেব কি বাহাদুর, কারো কাছ থেকেই কোনো সদুত্তর পাননি দাদু ।
তবে যাকে তিনি দেখেছিলেন সেই কিশোরীটি , সে যে আদৌ কোনো জীবন্ত মানুষ নয়, সেটা বুঝতে দাদুর আর বাকি ছিল না ।দু দুটো ঘটনা ঘটে যাবার পর তিনি যে একেবারেই ভয় পাননি সেটাও নয় । আসলে চাকরিটা ছিল বড্ড লোভনীয়! তাই ওসব ঝুট ঝামেলা এড়াতে সে রাতের পর থেকেই দাদু নিজের মাথার বালিশের নীচে মা বিপত্তারিনীর ছবি আর সাথে শোবার আগে নিয়ম করে বার পাঁচেক গায়েত্রী মন্ত্র জপ করা শুরু করেছিলেন।
কিন্তু রোজ কটেজে দাদুর দিন ফুরিয়ে আসছিল ক্রমশঃ।
দাদুর ঘোড়ায় চড়া শেখা হয়ে গেছিল চটপট । সপ্তাহে দুদিন করে সাহেবের সাথে ঘোড়ায় চড়ে টহল দিতেন চারপাশ । কখনো তারা যেতেন টি ফ্যাক্টরি তে আবার কখনো কোনো নিঝুম পাহাড়ি জঙ্গলে আবার কখনো অন্যকোথাও।
দাদু বন্দুক দিয়ে সাহেবকে শিকার করতে দেখেছিলেন বার্কিং ডিয়ার , পাহাড়ি বুনো ছাগল আবার কখনো সখনো সম্বর, হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার এইসব ।যদিও দাদু হাজার চেষ্টা করেও নিরীহ প্রাণীগুলোর ওপর গুলি চালাতে পারেন নি । ইচ্ছে করে ভুল নিশানা লাগিয়ে বিবেকের দংশন থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন বারবার ।
ক্রমশঃ বর্ষার কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছিল পাহাড় । সাথে যখন তখন মুষলধারে একটানা বৃষ্টি।পাহাড়ের বর্ষা যেন বড্ড বেশী সুন্দর , বড্ড বেশী সবুজ আর মোহময়ী রূপ তার । এমনি এক বর্ষনমুখর দিনে ভরদুপুর বেলা দাদু হঠাৎ টি এস্টেট সংক্রান্ত এক মামলার গুরুত্বপূর্ন কিছু নথি খুঁজতে গিয়ে, সাহেবের লাইব্রেরী রুমের সবথেকে উচুঁ তাকে খুব মোটা একটি বইয়ের ফাঁকে খুঁজে পেয়েছিলেন রঙ চটে হলদে হয়ে যাওয়া পুরোনো সাদা কালো এক ছবি ।
ছবিটি আর অন্য কারো নয়, সেটা ছিল সেই সোনালী চুলের কিশোরী মেম সাহেব এর । সেই মায়া ভরা নিষ্পাপ মুখ, রোগাটে গড়ন , কৈশোরের উচ্ছ্বলতা যেন স্পষ্ট তার ছবিতেও । ছবিতে সে এক ঘোড়ার ওপর বসে। পেছনে দাঁড়িয়ে কমবয়েসী মরিস , বেশ হাসি হাসি মুখ । মরিসের পাশে এক অচেনা স্থানীয় যুবক । ছবিটা দেখার পর থেকেই দাদুর মন ভীষনভাবে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। কিশোরী মেয়েটি তবে কে ? তা জানার জন্য দাদু যেন দিন দিন মরিয়া হয়ে উঠতে লাগলেন ।
কিন্তু এসব জিজ্ঞেস করবেনই বা কাকে ? বাহাদুরের সাথে কথা বলে বিশেষ লাভ হবে না । অন্যদিকে স্বয়ং ফ্রেডরিক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলে অনধিকার চর্চার অপরাধে চাকরি খোয়াবার ভয় । শেষে অনেক ভেবে একদিন সময় করে কাছের পাহাড়ি বস্তির বাসিন্দা রুস্তমকে লুকিয়ে ছবিটি দেখান দাদু । এই রুস্তম লোকটিই দাদুকে ঘোড়ায় চড়া শিখিয়ে ছিল । স্বল্পভাষী রুস্তম ছবিটি দেখে আরো বেশি চুপচাপ আর গম্ভীর মুখে বসেছিল খানিকক্ষণ।শেষ অব্দি সে শুধু বলেছিল এসব ঝামেলায় না জড়াতে । জড়িয়ে নাকি কোনো লাভ হবে না । দাদু অবাক হয়ে শুনেছিল, ফ্রেডরিক সাহেব ও মরিস দুজনই নাকি বেশ বদরাগী লোক । রুস্তম নিজেও ওদের সমঝে চলে, বিশেষ করে মরিসকে । সাহেবের নির্দেশে মরিস নাকি মানুষ খুন করতেও পিছপা হবে না ।
রহস্যটা রহস্যই থেকে যাচ্ছিল । দাদুর মাথা থেকে সেই কিশোরীর চিন্তা যেন কিছুতেই বের হতে চাইছিল না । শেষটায় পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে সেই ছবিটি নিজের বালিশের নীচে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন দাদু।
যেন সেই রহস্যময়ীর প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি ক্রমশঃ। কিশোরীটি আদৌ কোনো রক্ত মাংসের মানুষ কিনা তা নিয়ে আর কোনো মাথাব্যথা ছিল না দাদুর । তাকে একবার দেখবার জন্য তার সাথে একবার কথা বলবার জন্য সকাল সন্ধ্যে হণ্যে হয়ে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছিলেন তিনি । সাহেবের অনুপস্থিতিতে তার লাইব্রেরী এমন কি শোবার ঘরে অব্দি ঢুকে নানা কাগজপত্র ঘেঁটে দেখার চেষ্টা করতেন দাদু। যদি কোনো ভাবে কোনো খোঁজ পাওয়া যায় সেই নিষ্পাপ মায়া ভরা মুখ, সোনালী চুল আর নীল চোখের কিশোরীর ।
কি অমোঘ আকর্ষণ ছিল সেই ছবিটির জানা নেই। দাদু দিনের মধ্যে বেশ কয়েক বার ছুটে ছুটে গিয়ে ছবিটি স্বস্থানে আছে কিনা দেখে আসতেন ।
এভাবে কিছুদিন চলার পর,
হঠাৎ একদিন টি ফ্যাক্টরিতে একটি বিশেষ কাজে যেতেই দাদুর সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল রমেন বাবুর । এই রমেন বাবুই উপযাচক হয়ে একদিন ফ্রেডরিক সাহেবের কাছে চাকুরীর আর্জি জানাবার উপদেশটা দিয়েছিলেন দাদুকে ।
সেদিন দেখা হতেই রমেনবাবু দাদুকে ইশারায় আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন - চাকরিটা একেবারে রোজ কটেজেই জুটে গেল তবে, হ্যাঁ ? তা কোনো অসুবিধে হলে বোলো । এই তল্লাটে বাঙালি কাউকে তেমন পাবে না , বুঝলে । আর যেখানে আছো একটু সামলে থেকো । বাতাসে কত রকম গল্প ভেসে বেড়ায় । তা সেসব আজগুবিও হতে পারে । ওসব কিছু আমি বলছি না । মানে.. আসলে বাঙালি তো তাই ... চিন্তা হয় ।
দাদু তক্ষুনি শক্ত করে হাতটা চেপে ধরেছিলেন রমেন বাবুর । বলেছিলেন - 'আচ্ছা বলুন তো ব্যাপার কি ? এত কিসের ভয় ? কি রহস্য ? কিসেরই বা এত সাবধানতা ? আমার তো মাথা বিগড়ে যাচ্ছে মশাই '।
রমেন বাবু খুব নীচু গলায় বলেছিলেন - দেখো ভাই এসব কথা সাহেবের কানে গেলে রক্ষে থাকবে না বলে দিচ্ছি । আমারও পরিবার আছে, ছেলে পুলে আছে । বেঘোরে চাকরিটা খোয়াতে চাই না মোটেই । তবে ওই ... জাত ভাই বলেই বলছি । এই রোজ কটেজ কিন্তু ভূতুড়ে জেনে রাখো । সে তুমি বিশ্বাস করো আর নাই করো । সাহেব তার একমাত্র মেয়েকে আদর করে 'রোজ' নামে ডাকতেন ।তার নামেই এই বাংলোর নাম। মেয়ে লন্ডনে টন্ডনে থাকে ওসব বাজে কথা । এখানকার কেউ এসব নিয়ে কখনো মুখ খোলে না তাই। তবুও তোমায় ভরসা করে বলছি শোনো ,
সাহেবের তখন মাঝবয়স , মাঝে মাঝেই স্ত্রী মেয়ে সুদূর ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে মাসখানেক কাটিয়ে যেতো । ফ্রেডরিক সাহেবও বছরে অন্তত একটি বার হলেও স্বদেশ ঘুরে আসতেন। এমনভাবে
সবকিছু চলছিল বেশ ভালোই । চা বাগানের ব্যবসাও চলছিল রমরমিয়ে । সাথেই ফ্রেডরিক সাহেবের শিকারের নেশা বেড়ে চলছিল দিন কে দিন । সাহেবের শখের বাংলো সেজে উঠছিল নিত্য নতুন সাজে । কিন্তু জানো তো , ওই সব শয়ে শয়ে শিকার, মরা জন্তু জানোয়ারের মাথা চারপাশে, এসব কিন্তু বড় অপয়া জিনিস । আর হলোও যেন তাই । হঠাৎই এক করুণ মৃত্যু যেন ছন্দ পতন ঘটিয়ে দিল সবের। সাহেবের স্ত্রী মেরি হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন তার লন্ডনের বাড়িতে। খবরটা পেয়ে সাহেব তড়িঘড়ি ছুটে যান লন্ডনে।
মাস খানেক পর ফিরে আসেন এদেশে। এবার পাকাপাকিভাবে সাথে করে নিয়ে আসেন সদ্য ষোলোয় পা রাখা মাতৃহারা কিশোরী মার্গারেটকে।
নিয়তির পরিহাস কে মেনে নিতে ক্রমশঃ ফ্রেডরিক সাহেব ব্যবসা আর তার শিকারের নেশা নিয়ে আরো বেশি ব্যস্ত হয়ে যেতে লাগলেন ।ওদিকে সদ্য মা হারা মার্গারেট তার বাবাকে কাছে পেয়েও পায়না । একদিকে মাকে হারাবার শোক অন্যদিকে চরম একাকীত্ব কিশোরী মার্গারেটকে যেন কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে। সে সারাটা দিন মন মরা হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে পাহাড়ের আনাচে কানাচে । ঠিক
সেই সময়ই স্থানীয় এক অল্পবয়েসী যুবক , নাম প্রকাশ ছেত্রি ঘোড়ায় চড়া শেখাতে আসতে শুরু করে মার্গারেটকে । কথাটা শুনেই দাদুর চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে ওঠে সেই ছবিতে দেখা মরিসের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অল্প বয়েসী ছেলেটির মুখখানা ।
মনখারাপ আর একাকিত্বের ঘন কালো মেঘে জর্জরিত মার্গারেট যেন এক ঝলক সোনালী রোদের দেখা পায় প্রকাশের মাঝে । ভাব জমতে সময় নেয় না দুজনের।তারপর একসময় ধীরে ধীরে সামাজিক অবস্থানের অসাম্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মার্গারেট প্রেমে পড়ে স্থানীয় যুবক প্রকাশ ছেত্রির। মার্গারেট এর জীবন জুড়ে তখন শুধুই তার উথালপাথাল নতুন প্রেম ।
কিন্তু ব্যস্ত ফ্রেডরিক সাহেবের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সহজ হলেও মরিসের চোখে কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে দু জনের মেলামেশা । শোনা যায় মরিস নিজেও নাকি প্রেমে পড়েছিল সমুদ্র নীল চোখের ষোড়শী মার্গারেটের ।এবং আর পাঁচটা ত্রিকোণ প্রেমের মতোই এরও পরিণতি হয়েছিল সর্বনাশা ।
ফ্রেডরিক সাহেবের কানে মেয়ের নিষিদ্ধ প্রেমের কথা পৌঁছে দিতে দেরি করেনি মরিস । একাহাতে সাহেবের ঘর সংসার আগলে রাখার পাশাপাশি সে ছিল সাহেবের একমাত্র বিশ্বস্ত সহচর ।
মার্গারেট ও প্রকাশ এর অসম কিন্তু গভীর ও নি:স্বার্থ প্রেম ফ্রেডরিক সাহেবের ব্রিটিশ আভিজাত্যের গরিমাকে ভেঙে চুরমার করে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল । খবরটা কানে যেতেই ফ্রেডরিক সাহেব রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন । তার আত্মসম্মানে বড্ড আঘাত লেগেছিল । আঘাত লেগেছিল মরিসের স্বার্থান্ধ ভালবাসাতেও। এ দুয়ে মিলে ফল হয়েছিল মারাত্মক । সাহেবের নির্দেশে এক ঘোর বর্ষার রাতে মরিস গুলি করে হত্যা করে নিরপরাধ মার্গারেট ও তার আঠেরো বছর বয়েসী প্রেমিক প্রকাশকে । শোনা যায় এরপর থেকে বহুদিন কোনো স্থানীয় লোক আর ওই বাড়িতে ভয়ে কাজ করতে যেতে চাইতো না ।এমনকি সাহেবের ঘোড়াগুলো অব্দি সেই স্থান ত্যাগ করেছিল চিরতরে। আগেও একবার এক বিহারী ছোকরা সাহেবের পি এ হিসেবে চাকরি পেয়েছিল রোজ কটেজ এ । শেষে একসময় রীতিমত অসুস্থ হয়ে চাকরি ছেড়ে পালায় সে ।
রমেন বাবুর কথাগুলো দাদুর মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল গভীরভাবে । অবশেষে যেন মোহ ভঙ্গ হয়েছিল তার।
রোজ কটেজে ফিরে , আতঙ্কে সে রাতে দু চোখ এর পাতা এক হতে চাইছিল না দাদুর । চোখ বুজে জোর করে ঘুমের চেষ্টা করতে গিয়েও, মাঝরাতে ঘরের ভেতরে একটা খসখস শব্দ শুনে বিছানায় আচমকা উঠে বসেছিলেন তিনি । আর ঠিক তখনই ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখেছিলেন, সাহেবের রান্নাঘরের এক ধারালো চাকু হাতে মরিস দাঁড়িয়ে দাদুর খাটের ঠিক পাশেই । তারপর সেই চাকুর তীক্ষ্ণ প্রান্ত সেদিন দাদুর বুকে ঠেকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে ফ্যাসফ্যাসে গলায় মরিস বলেছিল -' ইখান থেকে চলে যা । আদারওয়াইজ যাদের ফোটো নিয়ে খোঁজ খবর করলি , টাদের মোটোই ইউ উইল বি ফিনিশড । আন্ডারস্ট্যান্ড ?'
কি কদর্য ভয়াল দৃষ্টি মরিসের দুচোখে!!!! দাদুর একবার যেন প্রতিশোধ নিতেও ইচ্ছে করেছিল । কিন্তু গ্রামের বাড়িতে ফেলে আসা বিধবা মায়ের মুখটা মনে পড়তেই সে ভাবনা ত্যাগ করেছিলেন তক্ষুনি।
বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল ।অনেক বছর আগে ঠিক এমন কোনো এক রাতেই হয়তো খুন হতে হয়েছিল মার্গারেট ও তার প্রেমিককে । দাদুর সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে যাচ্ছিল ভয়ে।
বালিশের নিচে রাখা সেই ফটো , রুস্তমের কাছে সেসম্পর্কে দাদুর খোঁজ খবর নেওয়া, কোনো কিছুই মরিসের দৃষ্টি এড়ায়নি তবে ! নিজের প্রাণের ভয়ে চাকরির মায়া ত্যাগ করেছিলেন দাদু।
পরদিন ভোর হতেই , মায়ের অসুস্থতার অজুহাতে রোজ কটেজ ছেড়েছিলেন তিনি চিরকালের মতো । ঠিক বেরোনোর মুহূর্তে সদর গেটের কাছে ,বাহাদুর এর মুখোমুখি হতেই, সে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল দাদুর দিকে। এই দৃষ্টি দাদুর কাছে ছিল সম্পূর্ণ অচেনা । মুখে হাসি হাসি ভাব এনে বাহাদুর শুধু বলেছিল - 'যাও'। যেন সে বুঝতে পেরেছিল সবটাই । মরিসকে সেদিন সকালে আর চোখে পড়েনি দাদুর । গেট থেকে বেরিয়ে যাবার সময় একবার শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে দূর থেকে দেখেছিলেন ফ্রেডরিক সাহেবকে ।সাহেব তখন ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে বইয়ের পাতায় মগ্ন , হাতে চুরুট জ্বলছে। আভিজাত্য ,প্রতিপত্তি আত্মগরিমার নেশায় বুঁদ একজন মানুষ । স্বেচ্ছায় নিজের একমাত্র মেয়ের খুনীর সাথে দিন কাটাচ্ছিলেন নির্বিঘ্নে ।
টি এস্টেট এর নিজস্ব জিপে চেপে বাড়ি ফেরার পথে দাদু আনমনে জামার পকেটে হাত দিতেই ,আবার খুঁজে পেয়েছিলেন সেই অভিশপ্ত ছবিটি । নাহ্ এবারে দাদুর আর মন হয়নি ছবির সেই মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখবার ।
পথের বাঁকে কোনো এক পাহাড়ি খাদে কুটি কুটি করে সে ছবি ছিঁড়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন দাদু।চলন্ত গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে যেন মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন অভাগা প্রেমিকযুগলকে ।
--------------------------
Poulami Mitra
Pandapara beside Bowbazar.Jalpaiguri District.