কথাকাহিনি ইভেন্ট -১ ।। কমবেশি শতশব্দে অণুগল্প ।। নির্বাচিত লেখাগুচ্ছ
পরীক্ষামূলক ভাবে কম-বেশি শত শব্দে অণুগল্পের ইভেন্ট ( প্রতিযোগিতা নয়) শুরু করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল অণুগল্পের চর্চা হোক আরও বেশি করে। তাতে আপনাদের যে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি, সে জন্য আমরা ধন্য ও কৃতজ্ঞ।
আমাদের ধারনা ফুলের সৌন্দর্যের ও সৌরভের যেমন বিচার করা যায় না, যেমন পাখির মধুর কলতানের মাপকাঠি নির্ণয় করার মতো শ্রবণযন্ত্র আমাদের নেই, ঠিক তেমনি মনের অনাবিল আনন্দে উৎসারিত সাহিত্য কর্মের বিচার করা নিছক বোকামি। আর সেই বোকামিটাই করতে গিয়ে বার বার মনে প্রশ্ন জাগছে কারো প্রতি অবিচার হল না তো!
ভালোলাগা মন্দলাগা বিষয়টা আপেক্ষিক। তাই নিক্তি মাপে সঠিক নির্বাচন সম্ভব নয়। পাঠক- পাঠিকা ও আমাদের সম্পাদকমণ্ডলীর ভালোলাগার ভিত্তিতে বেছে নেওয়া অণুগল্পগুলোই এখানে দেওয়া হল।
এখন থেকে প্রতি মাসে ইভেন্ট চলতে থাকুক এইভাবে।
------------- কথাকাহিনি পরিবার।
আলোয়ান
সমাজ বসু
বিকেল হতেই পার্কের বেঞ্চিটা তিন বন্ধুর দখলে চলে যায়। একেবারে নিঃশব্দ জবরদখল। ষাটোর্ধ্ব তিনজন মানুষের আলাপচারিতা। মাঝেমধ্যে দুএকটা খেলার বল এসে তাদের বিরক্ত করে। এছাড়া পাক্কা দুঘন্টা ধরে চলে বিকেলের এপিসোড।
--- কিহে মানবেন্দ্র,জ্যাকেটটা তো খাসা পরেছ!
--- স্টেটস থেকে ছেলে পাঠিয়েছে।
--- তাই বলো। আমার তো আবার পুনের ডাক এসেছে। নাতনিকে নিয়ে ওরা হিমশিম খাচ্ছে। তার ওপর দুজনেই চাকরি করে। গিন্নিকে নিয়ে যাচ্ছি। মাসদুয়েক আমাকে পাবে না।
--- শিবেন, তুমি ছাপোষা মানুষ। ভালোই আছ। মাঝে মাঝে মনে হয়,তুমি এত বর্ণহীন থাকো কি করে? কথার মাঝখানে হঠাৎ শিবেনবাবুর ছেলে এসে দাঁড়ায়।
--- বাবা, তুমি আজ আলোয়ান আনতে ভুলে গেছ। তোমার বৌমা পাঠাল। ছেলে নিজের হাতে শিবেনবাবুর গায়ে জড়িয়ে দিল।
ঘুষ
পৌলমী মিত্র
একমাত্র মেয়ে মন্দিরার বয়স বাইশ ছুঁতে না ছুঁতেই মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য রীতিমতো পাগল হয়ে উঠলেন সান্যাল বাবু। যথারীতি বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিয়েটাও দিয়েই ফেললেন।
আজ ৩ বছর পর, ডিভোর্সী মন্দিরার জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে, পারিবারিক বন্ধু তথা স্থানীয় নেতা সমরেশ এর হাতে নগদ ৫ লাখ টাকার প্রথম কিস্তি তুলে দিলেন সান্যাল বাবু।
পাশে বসে থাকা মন্দিরা এবার আর চুপ থাকতে না পেরে মৃদুস্বরে বলে উঠলো ‘ ইশশ্ ..এই টাকাটা যদি ৩ বছর আগে আমায় সেই ম্যানেজমেন্ট কোর্স টা করবার জন্য দিতে বাপি ......।’
সান্যাল বাবু চমকে উঠে মন্দিরার চোখের দিকে চাইতে গিয়েও পারলেন না ।
প্রেমের ফাঁদে
মুক্তি দাশ
চুমকির ক্লাস ইলেভেন। সেইসময় তাদের স্কুলে এক নতুন ইংলিশ টিচার জয়েন করলেন। অতি সুদর্শন। পড়ানোতেও তেমনি দক্ষ।
চুমকি অনুভব করল, সে ইংলিশ-টিচারের প্রেমে পড়ে গেছে। কিন্তু মুখ ফুটে তো আর বলা যায় না।
একদিন সে সুযোগ বুঝে একটা চিরকুটে I love you লিখে টিচারের হাতে গোপনে ধরিয়ে দিল। টিচার বললেন, "কী এটা?"
চুমকি রহস্যময়ীর মতো মুচকি হেসে বলল, "দেখুনই না!"
টিচার দেখলেন। তারপর বললেন, "ঠিক আছে।"
উপচানো খুশিতে চুমকি বলল, "সত্যি বলছেন?"
"হ্যাঁ, সত্যি বলছি।" টিচার বললেন, "একদম ঠিক আছে।"
চুমকির বিশ্বাসই হচ্ছে না! যাচাই করে নেবার জন্যে সে লাজুক মুখে জানতে চাইল, "কী ঠিক আছে?"
টিচার বললেন, "বানান।"
চাবি
কার্তিক চন্দ্র পাল
শয়নকালে স্ত্রীর শাশুড়ি-বন্দনা শ্রবণ আমার নিত্যদিনের অভ্যেস। শাশুড়ি-বৌমার এহেন অহিনকুল সম্পর্কের সালিশি করা একজন নিরীহ পতিপুঙ্গবের পক্ষে কিরূপ দুষ্কর তা বিবাহিত পুরুষ মাত্রেই জানেন।
ইদানীং কালে তাই নিশিভোজনের পর বাথরুম-যাপনের অভ্যাস তৈরী করেছি। এতে 'গর্জনশীলা চল্লিশা'-র তেজ একটু স্তিমিত হয় বটে, তবে একটি শ্লেষবাক্য নিয়ত শুনতে হয় : 'শুধু খাওয়া আর ------'।
আজ দেখি অন্য পরিবেশ!
ঝড়ের পূর্বাভাস নয় তো? নাহ্। ঝলমলে আকাশ। ব্যাপার কী!
-----"কাল বাজার গেলে মায়ের বাতের মলমটা এনো মনে করে।"
কিমাশ্চর্যম্! 'তোমার মা' থেকে 'তোমার' শব্দটা বেমালুম বাদ!
---"জানো, মা আজ ভাঁড়ার ঘরের চাবিটা আমায় দিলো। বললে, বড়বৌ সংসারটা তুইই আগলে রাখিস।"
বউয়ের চোখটা চিকচিক করছে মনে হলো। বুঝলুম পরিবেশ বদলের চাবিটা কী।
জীবন্ত ফুলদানি
এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল
সেদিনও ছিল এমন মায়াবী চাঁদনি রাত।
সৌরভ ও মালতীর প্রথম বিবাহবার্ষিকীর মধু নিশি।
সৌরভের আদরে গলে যেতে যেতে মালতী বলেছিল, আজকের দিনে একটা লাল গোলাপ অন্ততঃ আশা করেছিলাম।
পরদিন অফিস ফেরত সৌরভ লাল গোলাপ সহ গোলাপ চারা এনে বলেছিল,
'এই নাও প্রতিদিনের প্রীতি উপহারের বন্দোবস্ত।'
এরপর থেকে বিবাহবার্ষিকীর সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতি বছর একে একে জুঁই, গন্ধরাজ, হাসনুহানা প্রভৃতি গাছের চারাদের আগমন ঘটেছে মালতীর সাধের বাগানে।
আজও জুঁই আর হাসনুহানার গন্ধ মাখা বাতাস যেন চাঁদের মায়াবী আলোর আদরে মাখামাখি।
আজ সৌরভ নেই।
কিন্তু সৌরভ ছড়াচ্ছে ফুলে ভরা সৌরভের প্রীতি উপহারেরা।
পঁচিশতম বিবাহবার্ষিকীতে একা মালতীদেবী ব্যালকনিতে ডুব দেন স্মৃতির সৌরভে।
থাকার জন্য ঘর
সৌমিক ঘোষ
- জেঠু, জানলায় এসো, কথা আছে।
মোহনবাবু সাড়া দেন- কি বল ?
- এই দিদি হাসপাতালে কোভিড সেকশনে জয়েন করেছেন। থাকার জন্য ঘর চাই ।
- কিন্ত এই সময়ে!
শিখা তাড়াতাড়ি বলে- না ,না । আমি থাকবো না। আমার স্বামী ও মেয়ের জন্য। মাঝে একবার এসে দেখে যাবো। আপনারা বয়স্ক মানুষ।
- এসো। বিল্টু যখন বলেছে তখন সবই ঠিক , তবু আই.ডি.প্রুফটা দিও।
শিখা বলে - নীচের ঘর বন্ধই থাকে? আপনারা?
- সবই কপাল। একটাই ছেলে । বউমা ওপরে উঠবে না। ঝগড়া, অশান্তি ।
বৃষ্টির রাতে শিখা মেয়েকে দেখতে এসেছিল । জানলায় মেয়ের কি কান্না।
মোহনবাবুরও চোখে জল, - বউমাও যে এমনই একরাতে ছেলে আর নাতনিকে নিয়ে চলে গেছে কানাডা।
আংশিক
অচিন্ত্য বাগ
দুই বন্ধু পাশাপাশি শুয়ে গল্প করছে ।
প্রথম : "জানিস,আজ স্বপ্নে দেখলাম, ঘুড়ি ওড়াচ্ছি ।কিন্তু আমার দুহাতের মুঠোয় শক্ত করে রাখা লাটাইটা ক্রমশ এতটাই ভারী হয়ে এল যে শেষপর্যন্ত ছেড়ে দিলাম । দেখলাম মাঞ্জাটা ছিঁড়ে আমার বগ্গাটা ক্রমশ দূর দূর নীলে হারিয়ে গেল ।"
দ্বিতীয় : "সেকি! আমারটাও অদ্ভুত । দেখি সামনে খাড়াই পাহাড়,নীচে গভীর খাদ । মাঝে একটা দড়ির সেতু । সেটা পেরোতে হবে সাবধানে । ভয়ে বুক চেপে ধরলাম । হঠাৎ পিছন থেকে আওয়াজ এল,আগে বঢ়ো । আমি পা বাড়ালাম । আর ওমনি ঘুমটা ভেঙে গেল ।"
দুই বন্ধু পরস্পরের দিকে সবিস্ময়ে চেয়ে আছে । মুখের বলিরেখায় প্রচ্ছন্ন কৌতুক ; কৌতুক নয় শূন্যতা । একজনের দুটো হাতের আর অন্যের দু পায়ের ।
অক্টোপাসের চোখ
চন্দন চক্রবর্তী
অক্টোপাসের ছবিটা আজকেই চোখে পড়ল । সারা গায়ে বুটি । কি বিচ্ছিরি ! যেন আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আস্তে আস্তে রস চুষে খাবে !
সবেতো দু পেগ গিলেছে,অনিমেষের পেট গুলিয়ে মাথা ঘুরতে লাগলো ! আয়েশার কি কুটিল হাসি !
বেসিনে হড়হড় করে বমি হয়ে গেল । মাথা তুলতেই,একি ! আয়নায় অক্টোপাশটা তাকে আকড়ে ধরতে চাইছে ! চোখগুলো ঠিক আয়েশার মত !
ঐশী বারবার বলেছিল,আজকে তাদের ষষ্ঠ বিবাহবার্ষিকী,অনিমেষ যেন সকাল সকাল বাড়ি ফেরে । ঐশীর চোখ দুটো ভারী মায়াময় !
কেন যে অনিমেষ ঐশীকে ভুলে সন্ধ্যা হলেই আয়েশার এখানে ছুটে আসে ! না আর নয় ।
অনিমেষ টলতে টলতে সোজা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল । খুব রাত হয়নি,এখনো সময় আছে ।
দুই মেরু
দেবশ্রী সরকার বিশ্বাস
অজয় বরাবরই একটু গুরুগম্ভীর স্বভাবের, স্ত্রী অণিমা তুলনায় হাল্কা মেজাজের। সংসারের খুঁটিনাটি সমস্ত বিষয়েই তারা যেন দুই মেরুর বাসিন্দা!
নীল রংটা বড় ভালোবাসে অণিমা; জানালার পর্দা,বিছানা পছন্দের রঙে সাজাবে সে, কিন্তু এই রংটা একেবারেই পছন্দ নয় অজয়ের। একদিন বাগানের
ফিরে পাওয়া
বিকাশ বর
বাসটা থামতেই উঠে পড়লাম। পিছনের দিকে দু'টো সিট ফাঁকা, সামনে একটা সিট ফাঁকা । জানালা ঘেঁসে একটা মেয়ে বসে। অনেকটা রাস্তা। হুড়মুড়িয়ে প্যাসেঞ্জার উঠছে। কিন্তু কিন্তু করে মেয়েটার পাশে বসে পড়লাম। অন্য সময় হলে বসতাম না। কেমন যেন অস্বস্তি হয়। দূরত্বের কথা ভেবে বসতেই হল। আড়চোখে দেখার সাহস নেই। আড়ষ্ট হয়ে বসে আছি। বসার সময় একটু দেখেছিলাম। পলকে অসাধারণ সুন্দরী !
কনডাক্টর টিকিট করতে এলেন।
মেয়েটা দু'টো টিকিট করল। হঠাৎ মেয়েটি আমার দিকে একটা টিকিট বাড়িয়ে দিল- "আপনার টিকিট।"
মুখ খোলার আগেই মেয়েটি বলল, "কেমন আছেন সুভাষদা ?" দেখলাম কলি বসে। আমার প্রথম প্রেম। কলি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।
আজ আবার ফিরে পেলাম।
সারপ্রাইজ
অনিন্দ্য পাল
ছ'মাস পরে বাড়ি ফিরছে বাসু। সুরমা ঘর সাজিয়েছে। নিজেকেও এই ছমাস ধরে সাজিয়েছে। আধপেটা খাওয়া, ঘাম ঝরানো। আগের সেই থামের মত হাত পা
আর নেই। সবাই বলছে, তাকে নাকি নায়িকার মত লাগছে। সারপ্রাইজ দেবে বাসুকে।
রুটি গুলো গামলায় রেখে মাংসটা গরম বসাতে যাবে, ঠিক তখনই দরজায় চেনা টোকা। ছুটে গেল সুরমা।
দরজার ওপাশে তার অপেক্ষা।
কিন্তু এ কি? একটা কঙ্কালসার মানুষ! বাসু? মাথাটা যেন ঘুরে গেল সুরমার।
অবাক বাসু ঘরে ঢুকে বললো, " তুমিও?"
( শ-৯৬)
চন্দনের গন্ধ
সুদীপ ঘোষাল
সকালে নিমকাঠির দাঁতন ব্যবহার করেন অনেকে। জনশ্রুতি আছে, বারোবছর নিমকাঠির ব্যবহারে মুখে চন্দনকাঠের সুবাস হয়। কথা বললেই নাকি চন্দনের সুবাস বেরোয়। শুনে হয়ত মানুষ নিমকাঠির ব্যবহার করেন। কিন্তু মা বলতেন, শুধু নিমকাঠির ব্যবহার নয়, তার সঙ্গে মানুষকে ভালবাসতে হয়। কারও অমঙ্গল কামনা করতে নেই। মিথ্যা কথা বলতে নেই। তাহলেই মানুষের মুখে সুগন্ধ হয়। এমনকি দেহের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। মানুষ তো দেবতার আর এক রূপ।
বাবাও বলেন,মানুষের প্রতি ভালোবাসা মনে এলে চন্দনসুবাসে ভরে যায় হৃদয়...
শত পুত্রের জননী
অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায়
আমি তখন উত্তর দিনাজপুরের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করি । ক্লাস সেভেনের রিংশুকের ওপর আমার একটু দুর্বলতা ছিল । এহেন রিংশুক অনেক দিন স্কুলে আসছে না । খোঁজ নিতে গিয়ে আমি তো অবাক । রিংশুক হাসপাতালে ভর্তি । ও যে থ্যালাসেমিয়ার পেশেন্ট তা আমি জানতাম না । ওর বাবা এবং মা দুজনেই রোগটার বাহক । অজ্ঞতার কারণেই একমাত্র সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত । অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না । মারা গেল রিংশুক । আর পাঁচজন মায়ের মত ভেঙে পড়লেন না রিংশুকের মা । পুত্রের শোকে বিলাপ না করে মাতৃ স্নেহে এগিয়ে এলেন শতশত থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রিংশুকদের বাঁচাতে । বেচে দিলেন সমস্ত জমিজমা । গড়ে তুললেন সেবা প্রতিষ্ঠান । নাম দিলেন রিংশুক ।
বিবেক
দেবাজীব সরকার
অবাঞ্ছিত বোঝাটা গতকাল রাতে ঘাড় থেকে নামানোর পরে বেশ একটা জম্পেশ ঘুম হয়েছে অভিরূপের। সকালে উঠে সংবাদপত্রের খবরটা থেকে চোখ সরাতে পারছিল না অভিরূপ। "নতুনপাড়ার জঞ্জালের ভ্যাটে পাওয়া সদ্যোজাতের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এলেন নিঃসন্তান দম্পতি সুচেতনা ও জয়জিৎ বসু।"
কিছুক্ষণ বাদে দিদি এসে বললো, -"অভিরূপ আমার সঙ্গে একটু থানায় চল, আইনি প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। ভাব তো, এরা মানুষ না জানোয়ার, নিজেদের আনন্দ ফুর্তির জন্য একটা জীবনকে এভাবে শেষ করে দিতে পারে?"
থানায় যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায় অভিরূপ, পা টা কেঁপে ওঠে । বলে ওঠে, "খুব ভালো করেছিস, দিদি। সত্যিই মানুষগুলো জানোয়ার । নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিতে থাকে।
সুখী দম্পতি
পূর্বাশা মন্ডল
দুপুরে বস্তিতে খবর এলো সারাইয়ের কাজ চলাকালীনই চৌমাথার ব্রিজ ভেঙে পড়েছে। কয়েকজন শ্রমিকও মারা গেছে!
শুনে গৌরী আলুলায়িত কেশবেশে তার ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এল। কেঁদে বলল – সেকি গো!আমার বর যে ওখানেই জোগাড়ের কাজে গেছে!
গৌরী পাগলিনীর মতো চৌমাথার দিকে দৌড়তে লাগল। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলল – বউ, তোর ভালোবাসার টানে আমি বেঁচে ফিরেছি রে! এদিক পানে চেয়ে দেখ।
গৌরী ফিরে দেখল ধুলিধূসরিত, সামান্য আহত মহাদেব তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। গৌরী দৌড়ে গিয়ে স্বামীকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল।দুজনের চোখের জলে ভালবাসার বন্ধন আরও দৃঢ় হল। নিরন্ন, দরিদ্র, কঙ্কালসার চেহারার গৌরী- মহাদেব এইমুহূর্তে পৃথিবীর সেরা সুখী দম্পতি।
স্বাদ
জয়তী ব্যানার্জি মুখার্জি
একফোঁটা ছেলে অথচ হাজারটা বায়না ; মাছ ছাড়া ভাতই খাবে না । কাঁটা বেছে খাওয়াতে খাওয়াতেই দুপুরটা গড়িয়ে যায় । চশমার এপাড় থেকে তীক্ষ্ম নজর রাখি যাতে একটা কাঁটাও মুখে না যায় ।
এমন ছোট্ট বয়সেই মা-র হাতে খেতে গিয়ে আমার গলায় কাঁটা লেগেছিল । অসাবধান ছিল না মা, হয়তো দেখতে পায় নি । মাও হাই-পাওয়ারের চশমা পরতো যে ! কিন্তু ঠাকুমা তারপর থেকে একেবারেই বন্ধ করে দিল মা-র হাতে খাওয়া । কদিন পর মা-টাও একেবারে নেই হয়ে গেল ।
রোজ ছেলের শেষ পাতের একটু ভাত নিজের ভাতে মেখে নিই । ঠিক লক্ষ্য করে ছেলে, বলে-
“কেন মা?”
“মায়েরই হাতে মাখা ভাত তো রে! এতেই মা-র হাতের স্বাদ পাই ।“
অনুভূতি
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
কদিন ধরে মনটা একটু ভাল জীবনবাবুর। কেন জানি বুড়ো বয়সে এসে এক উন্মাদনা হচ্ছে! এক অদ্ভূত অনুভূতি। ছেলের চোখে দিব্যি তা ধরা পড়েছে। আসলে বাবাকে সাধারণত গোমড়া মুখেই দেখে নবীন। পরপর দু"দিন প্রকাশকরা বাড়ি বয়ে এসে কাগজপত্রে সইসাবুদ করাল।
জিগ্যেস করে জানল, নবীনের উপন্যাস প্রকাশিত হবে। আর একটা গল্পসংকলন। জীবন ওকে লক্ষ্য করেছে লেখালিখি করতে, তবে কখনো উৎসাহ দেখায়নি। বরং বিরক্ত হতো নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে কম তো অবহেলিত, অপমানিত হন নি। মুখের ওপরে পান্ডুলিপি ছুঁড়ে পর্যন্ত মেরেছে। সযত্নে সব রেখেছিলেন তাও। রত্না চলে যাবার পর সব পুরনো ট্রাঙ্কে তালাচাবি।
মন চঞ্চল হলো। জানতে ইচ্ছে করছে, কি লিখছে নবীন! প্রকাশকেরা ছুটে ছুটে আসছে!
আলোর পথে
মোয়াল্লেম নাইয়া
হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের মতো রতন ও আলম আজ তিনদিন তিনরাত অভুক্ত অবস্থায় হেঁটে চলেছে৷ তৃতীয় দিন শেষ রাতে ক্লান্ত রতন পকেট থেকে কয়েকগাছা চুড়ি আর রঙিন টিপ আলমের হাতে দিয়ে পিচ ঢালা কালো রাস্তার বুকে একেবারে নেতিয়ে পড়লো ৷ ফ্যাস্ ফ্যাসে গলায় আলম শুধু শুনতে পেল-"জানো আলমদা আমার ছোট্ট 'পরি' বলেছিল, বাবা, আসার সময় আমার জন্য কাঁচের চুড়ি আর টিপ নিয়ে এসো৷ "রতনকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে আলম বলে ওঠে, "না ভাই তোমাকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারিনা, যেমন করে হোক তোমার 'পরির' কাছে আমি তোমাকে পৌঁছে দেবই"! দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আলম,রতনকে কাঁধে নিয়ে অন্ধকার সাঁতরে কোনো এক "আলোর পথে" এগিয়ে চলল।
মা বাবা
অনীশ ব্যানার্জ্জী
গভীর রাতে যে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে ঘুমের মধ্যে টের পায়নি সে। হঠাৎ কাঁচ ভাঙার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। আলো জ্বেলে মশারি থেকে নেমে দেখে মৃত মা বাবার ছবিটা পড়ে ভেঙে গেছে। কম্পন অনুভব করতে পারে সে, বুঝল বাড়ি থেকে পালাতে হবে। বেরোতে যাবে হঠাৎ সিলিং ফ্যান খুলে পড়ল বিছানায়, অল্পের জন্য রক্ষা পেল সে, ভাগ্যিস ছবিটা ভাঙার শব্দে সে নেমে গেছে। ছবির ভিতর থেকে আওয়াজ এল, "মরে গেলেও আমরা সবসময় তোর সাথেই আছি। এই ভাবেই সমস্ত বিপদ থেকে উদ্ধার করব তোকে"। অশ্রুজলে ছবি বুকে আগলে রেখে সে অনুভব করল মা বাবার মৃত্যু নেই, তারা অমর।
মাস্টার
ঈশিতা পাল পট্টনায়ক
বয়সের সাথে আজকাল ক্লান্তি গুলোও কেমন যেন বলা কওয়া নেই অপ্রত্যাশিত অতিথির মতো ঝুপ করে ঘাড়ে এসে পড়ে- এমনটা ভাবতে ভাবতে চালচুলোহীন অতীন মাস্টার বড় রাস্তায় পা দেয়। মাস্টার বটে!
বউ বলতো- আপদ! ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়ায়! বাকিরাও বলে!
সারাজীবন ছাত্রদের 'মানুষের মতো মানুষ' করতে গিয়ে এসব বিশেষন গা সওয়া হয়েগেছে। অবিশ্যি কর্নের অক্ষমতায় এখন তার লাভই হয়েছে।
ঋষিপ্রতিম বাবার আদর্শে বড় হয়েছেন, শুধু উত্তর পুরুষদের - বড় করতে পারেননি!
অনেকটা হেঁটে এসে বুকটা জানান দিয়ে ওঠাপড়া করে। আর মিনিট দশেক হাঁটলেই চটকলের বস্তি।
বস্তির অভুক্ত,কচি আপদগুলোর সাথে নতুন উদ্দমে তাদের সম্ভাবনার গোড়ায় জল দিতে এসেছেন ,আমাদের অতীন মাস্টার এবং এক কাপড়ে!
সোনালী সূর্যের আলোয়
বিশ্বনাথ প্রামানিক
“- যা অন্তত বেঁচে তো থাক”- সজোরে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে হাঁ করে চেয়ে থাকে মা।
দুর্ভেদ্য বেড়া পেরিয়ে ওপারে কারও হাতে পড়ল কিনা কান খাড়া করে শুনতে থাকে সে।
সীমান্তের ওপারে বন্দুকের নল তাক করে উর্দিধারি লোকটা হাঁ করে চেয়েছিল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হঠাৎ-ই সে দেখে, উড়ে আসছে একটি ভাসমান শিশু। মুহূর্তে বন্দুক ফেলে লুফে নেয় সে। আর ঠিক তখনিই সহস্র গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যায় তার দেহ। মৃতপ্রায় রক্তাক্ত লোকটি ট্রিগারে চাপ দিতে গিয়ে দেখে, অকুতভয় শিশুটি ছোট্ট হাতে নলের মুখ চেপে ধরে হাসছে। ট্রিগার থেকে আঙুল সরিয়ে মরনের কোলে ঢলে পরে সে। সোনালী সূর্যের আভায় উজ্জ্বল তার হাসি মুখে, নিস্পলক চেয়ে থাকে শিশুটি।
-------------------------------------------------
সব অণুগল্পগুলো পড়লাম। অত্যন্ত সমৃদ্ধ আর সুন্দর সব গল্প। লেখক ও সম্পাদকমণ্ডলীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।🙏
উত্তরমুছুন