সুধা
আশুতোষ দেবনাথ
খুব ভোর ভোর থাকতে সুধা দাঁড়িয়েছিল গ্যারেজের থেকে একটু দূরে, মেইন রাস্তার ধারে। গলির মুখটায়। একটু আড়ালে।
রোজকার মত মিলন - দের মিনি বাস গ্যারেজ থেকে নির্দিষ্ট টাইমে বেরিয়ে এসে সুধা যে গলির মুখে দাঁড়িয়েছিল ঠিক সেখানেই দাঁড়ায়।
সঙ্গে সঙ্গে হেলপার মিলন বাস থেকে নেমে যায় সুধার কাছে।
সুধা তখন যেন সত্যি সুধাময়। রঙিন শাড়ি পরা। ফর্সা গায়ে লাল ব্লাউজের জন্য একটা বাড়তি সৌন্দর্য ফুটে বেরোচ্ছে ভোরের আলোয়। তাঁর সারা শরীরে তখন মাতৃত্বের পরিপূর্ণতা।
মিলন জানে, সুধার তিন কুলে কেউ নেই। কোথা থেকে যে বিয়ে করে এনেছিল নেশাখোর জুয়াড়ি সুখেন।
শেষে কিনা চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়েছিল একটা ছোট্ট শিশুকে বাঁচাতে। শিশুটিকে বাঁচিয়ে নিজেকে আর বাঁচাতে পারেনি সুখেন। চলন্ত ট্রেনের চাকায় দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে কিম্ভুতকিমাকার হয়ে গিয়েছিল। আর এখন যত ঝামেলা সব মিলনের। আসন্ন প্রসবা সুধার জন্য রোজ বাজারের টাকা দেওয়া থেকে শুরু করে শাড়ি, ব্লাউজ, ডাক্তার, বদ্যি। ওষুধ, পথ্যি, মানত আরো কত কি বাহানা সুধার। দুর্ঘটনার পর রেল লাইনের বসতির মানুষ - জনেরা কিছু টাকা তুলে দিয়েছিল এদিক সেদিক থেকেও কিছু কিছু দান ক্ষয়রতিও জুটেছিল। সে সবই তো ফুরিয়ে গেছে। এখন সব দায় - দায়িত্ব মিলনের। আর সেই কারণে মিলন নিজের মাথার চুল নিজে ছিঁড়তে চায়। ইস ! কী করে যে সে ফেঁসে গেল ? একজনে অন্যের বাচ্চা বাঁচাতে লাইনে ঝাঁপ দেবে। একজনের মা হবার সখ আর কিনা মরতে মরণ তার।
রোজ একবার করে মিলন এই কথা সুধাকে বলে।
কথাটা শুনে সুধা একটু চুপ করে থেকে পরে ফিক করে হেসে বলে, তোমারই তো বন্ধু ছিল।
সুধার এই কথা শুনে মিলন মেজাজে বলে, বন্ধু না আরো কিছু। কে বলেছিল মাতালকে বিয়ে করতে । আর তুমিও মরার আর কোনো জায়গা খুঁজে পেলে না। বলে মিলন দলা পাকানো ভাঁজ করা একশো টাকার নোট খানা সুধার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, এই নাও। আজ দিচ্ছি। কাল থেকে অন্য ধান্দা খুঁজে নিও। আমি আর পারব না। আমার দায় কিসের শুনি? কী যেন ভেবে একটু পরে বলে, হায়, আবার সুধা নাম। কে রেখেছিল ?
মিলনের শুধু এই মেজাজ দেখানো সুধার গা সওয়া। সে জানে মিলন যতই রাগ করুক না কেন এটা শুধু তার বড়ো মুদ্রা দোষ। রোজ রোজ এই কথা বলেও আবার পরদিন ও ঠিক আসবে।
তবু সুধা যেন একটু লজ্জায় দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে বলে, সে তো তোমারই বন্ধু ছিল।
বন্ধু না আরো কিছু। কে বলছিল বিয়ে করতে ? নিজে তো চলে গেল অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে। আমিও হয়তো কবে কখন ভোগে চলে যাব। করি তো পরণ্ডারে হাতে নিয়ে মিনিবাসের হেল্পারী। পাদানিতে ঝুলে ঝুলে । কোনো সময়ে হাত ফস্কে পড়ে গেলেও হলো। বাস ! একেবারে হিসেবের খাতায়।
বালাই ষাট। অমন কথা আর কখনো মুখে এনো না। তুমি না থাকলে আমাদের দেখবে কে ?
আবার ড্রাইভার রসিকের ঘন ঘন হর্ণ বাজাতে থাকায় মিলন দৌড়ে চলে যায়।
সুধা একটু গলা ছড়িয়ে বলে, দুপুরে ঠিক সময়ে এসো কিন্তু খেতে।
কিছুসময় পরে মিলন দের মিনিবাস নিউ ব্যারাকপুর বয়েজ স্কুলের সামনের স্ট্যান্ড থেকে বিনয়, বাদল, দীনেশ বাগের দিকে যাবার সময় সে রকম প্যাসেঞ্জার না হওয়ায় একটু দেখে শুনে রয়ে সয়ে যাচ্ছিল। সেই কারণ পিছন থেকে পরের বাসটা ওভারটেক করতেই রসিক ড্রাইভার মিলনের উপর তেড়ে উঠলো। কেন মিলন আগে থেকে ড্রাইভারকে সতর্ক করেনি। যতসব অপয়া। কাল থেকে আর আমার বসে উঠবি না। বলেই সে স্পিড বাড়িয়ে দিল।
জনবহুল রাস্তায় স্টিয়ারিং ধরে অ্যাকসিলেটরে পা রেখে ডা ই নে, বায়ে ধাওয়া করে সামনের বাসকে ওভারটেক করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো।
ড্রাইভার বেঁটে রসিকের বসন্তের দাগে ভরা মুখমন্ডল তখন কঠোর। চোখে এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সদিচ্ছা। তা ক্রমে ক্রমে বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকে ।এমনিতে মালিকের কত সন্দেহ আর অবিশ্বাস ড্রাইভার কন্ডাকটর আর হেল্পারদের উপর। তারপর আজ যদি ফাস্ট ট্রিপেই ঝাড় খেতে হয় ? দাঁতে দাঁত চেপে স্পিডের গাড়িকে বেপরোয়া ভাবে ওভারটেক করতে গিয়ে জোরে ব্রেক চাপতে ঝাঁকুনিতে ভিতরের প্যাসেঞ্জার তেড়ে উঠছে।
এই, এই এসব হচ্ছেটা কী শুনি ? আমাদের মারবি নাকি ? এত সময় গরুর গাড়ির মত চালিয়ে এখন নিজেরাই কে আগে যাবি তাই নিয়ে মারামারি করছিস?
রসিকের কানে যাত্রীদের হুশিয়ারি কন্ডাকটর ড্রাইভার ও হেলপার - এর কানেই যায় না। ওরা তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। এতটাই মরিয়া যে, জনবহুল রাস্তার ভোরের মধ্যে বেপরোয়া ভাবে ওভারটেক করতে গিয়ে পিছনের গাড়িটাকে ধাক্কা মারে। সেই সঙ্গে একটা রিক্সাকে। ধাক্কা খেয়ে প্যাসেঞ্জার ছিটকে যায়। এই দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর ড্রাইভার মুহূর্তের মধ্য কোথায় পালিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে কন্ডাকটর হেল্পারদের খুঁজে পাওয়া গেল না। যতো রাগ গিয়ে পড়লো মিনি বাসের উপর। সেটাকে উত্তেজিত জনতা মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে গুড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দিল।
আর ওদিকে তখন সুধা দুপুর থেকে মিলনের খাবার নিয়ে বসে আছে। কলমি শাক ভাজা, কাঠাল - বিচি আর শাকের ডাটা দিয়ে চিংড়ি মাছ আর দেশী আমড়ার টক । এই সবই আজকাল সুধার খেতে খুবই ভালো লাগে। মিলনের ও। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে যাচ্ছে তবু মিলন আসছে না দেখে সুধা আর অপেক্ষা করতে পারলো না। যার একটার মধ্যে আসবার কথা সে কি না সাড়ে তিনটে বাজার পরও এলো না কেন ? তবে কোনো এক্সিডেন্ট হলো। মনের ভিতরে এমন একটা আশঙ্কা দেখা দিতেই সুধা ছুটে গেল মোড়ের মাথায় ভবেশের পান - বিড়ি - সিগারেটের দোকানে।
গিয়েই বিস্তারিত সব খবর জেনে নিল মিলনদের মিনিবাসের এক্সিডেন্ট থেকে বাস ভাঙচুর, আগুন লাগানো, অবরোধ, পুলিশের লাঠি চার্জ। এত কিছু খবর জানার পরও ড্রাইভার, কন্ডাকটর, আর হেলপার দের কোনো খবর ভবেশ বলতে পারলো না। জানার পর সুধা ঘরে ফিরে গিয়ে মিলনের অপেক্ষায় বসে থাকলো পথের দিকে তাকিয়ে।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে হয়। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত। আরো গভীর হতে থাকে রাত। তবু বসে থাকে সুধা।
ক্যানেলের ধরে প্রান্তরে বন জ্যোৎস্না ক্যানেলের জলে প্রতিফলিত। সেই আলোকিত বন জ্যোৎস্নায় সুধা অপেক্ষায় থাকে ---- তার একান্ত প্রিয়জনের পায়ের শব্দ শোনার জন্য।
তার চোখে প্রত্যাশার ঝিকিমিকি।
------------
আশুতোষ দেবনাথ
সি - ২৭, শহীদ বন্ধু নগর
নিউ ব্যারাকপুর
কলকাতা - ৭০০১৩১