অষ্টম স্যার থেকে ডাক্তার বাবু
অচিন্ত্য কুমার ধাড়া
অষ্টম স্যারের কাছে বৈশাখী চতুর্থ শ্রেণী থেকে প্রাইভেট পড়ে। স্যার চাকরি পাননি ,টিউসান করেন । বৈশাখীরা তিন বোনই স্যারের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। উপরের দুই বোনের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গেছে।বৈশাখী বর্তমানে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। বৈশাখী র বাড়িতে ঠাকুমা বাবা আর মা কে নিয়ে সংসার। অষ্টম স্যারের পড়ানো বৈশাখীর খুব ভালো লাগে । এক দিন বৈশাখী সকালে পড়তে গেছে, হঠাৎ খবর গেল এক্ষুনি তাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। তৎক্ষণাৎ বাড়ি ফিরে দেখে তাদের বাড়ি তে হৈচৈ হচ্ছে। বৈশাখী র মা জামা কাপড় কেচে ছাদে শুকনো করতে দেওয়ার সময় বেসামাল হয়ে মাথা ঘুরে একেবারে নিচে পড়ে গেছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হল। কিন্তু সব চেষ্টা বৃথা। রাস্তায় যেতে যেতে ই বৈশাখীর মা হার্ট ফেল করে মারা গেল । বৈশাখী খুব কষ্ট পেল, মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে মাতৃ হারা হল। বড়ো নিঃসঙ্গ বোধ করে সে। মাঝে মাঝে বেশ মন মরা লাগে তাকে।
ইতিমধ্যে মাস ছয় কেটে যাওয়ার পর বৈশাখীর বাবা আবার বিয়ে করল। প্রথম প্রথম বৈশাখীর দ্বিতীয় পক্ষের মা তাকে খুব ভালোবাসত। যত দিন গড়ায় বৈশাখী তার সৎ মায়ের চোখে র বালি হয়ে ওঠে। বৈশাখীর উপর তার সৎ মায়ের এমনকি বাবার ও প্রথমে মানসিক এবং পরে শারীরিক নির্যাতন ও চলতে থাকে। বৈশাখী বাড়িতে প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় একদিন প্রাইভেট পড়তে গিয়ে পড়ার শেষে অষ্টম স্যার দেখল সকল ছাত্র ছাত্রী বাড়ি ফিরে গেলে ও বৈশাখী মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।স্যারের পড়ানোর জায়গা হল নিজের বাড়ি হতে হাফ কিলোমিটার দূরে গ্রামের একটা লাইব্রেরির ফাঁকা লম্বা দালানে। আরো হাফ কিলোমিটার বিপরীত দিকে বৈশাখী র বাড়ি । স্যার জিজ্ঞেস করলেন কেন বাড়ি যাচ্ছো না ? বৈশাখী নিরুত্তর। বার বার জিজ্ঞেস করে ও স্যার উত্তর পেল না । অবশেষে বৈশাখী বলল আমি বাড়ি ফিরে যাবো না স্যার। আপনার সাথে আপনাদের বাড়ি যাবো। তাই কি হয়? স্যার অনেক বুঝিয়েও কোন ফল মিলল না । বৈশাখী র বাড়িতে খবর দেওয়া হল। কিন্তু কোন উত্তর এল না।
স্যারের বাড়িতে আরো অভাব। মা , দুই ভাই এক বোন। ঐ টিউসান করে কোন রকমে দিন পাত হয় বাড়তি আর একজনের পেট চালানো যত না বড় কথা তার থেকেও বড় বৈশাখী কৈশোর থেকে যৌবনে পা রাখতে চলেছে। কি ভাবে তাকে পার করবে ? আবার সমাজের ভ্রুকুটি। যাক্, দেখা যাবে।আর সাত পাঁচ না ভেবে অগত্যা স্যার বৈশাখীকে তার সাথে বাড়ি নিয়ে এসে মাকে বৈশাখীর সকল অসহায়তার কথা বলল।মা মেনে নিল । এই ভাবেই চলে। বৈশাখী নিয়ম করে রোজ স্যারের সাথে পড়তে যায় । অষ্টম স্যার ক দিনই ভাবছে টিউসান ছাড়া আর কিছু করতে। হঠাৎ যোগাযোগ হল পাশের গ্রামের কিশোরী ডাক্তার বাবুর সাথে। তাঁর পরামর্শ পেয়ে ডাক্তার বাবুর কাছে এক বেলা ডাক্তারি প্র্যাকটিস করার সম্মতি পেল । প্রতিদিন সকালে প্র্যাকটিসে যায় আর পড়ানোর সময় পরিবর্তন করে সন্ধ্যায় হল । এদিকে বৈশাখী এক দিন আবদার করলো তার ঠাকুমাকে ও বৈশাখী র কাছে এনে স্যারের বাড়িতে রাখতে হবে। কারণ বৈশাখী সৎ মায়ের কাছে ঠাকুমার কষ্ট ও হাড়ে হাড়ে টের পেত। বড় চিন্তায় পড়ে গেল অষ্টম স্যার। বৈশাখীর আবদার মেনে স্যার তার ঠাকুমাকে ও নিজের আশ্রয়ে রাখলো। স্যারের নাম গ্রামীণ ডাক্তার হিসেবে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ল। স্যার কল পেলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে রক্ত নিয়ে ল্যাবে গিয়ে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টও করে দিতে লাগল। সন্ধ্যায় স্যার পড়াতে পড়াতে রোগী দেখার কল পেলে ঐ সময় টা বৈশাখী ও একটু ছেলে মেয়েদের পড়া ধরে। এইভাবেই চলতে থাকে। আস্তে আস্তে অষ্টম স্যার,স্যার থেকে ডাক্তার বাবুর খ্যাতি পেতে থাকল। কারণ গ্রাম বাংলায় বড় স্বীকৃত ডাক্তার না থাকায় কোয়াক্ ডাক্তার বাবুরাই প্রাথমিক চিকিৎসা পরিষেবা টা দিয়ে থাকেন ।
উপার্জন বাড়ল। ভাই ও বোনের বিয়ে দিয়ে দিল। বেশ নাম ডাক ও রোজকার বাড়লেও প্রতিবেশি রা ডাক্তার বাবুর পিছনে ফিস ফিস শুরু করে দিল। নিয়মিত বৈশাখী ও ডাক্তার বাবু কে নিয়ে গুঞ্জনে কান ফাঁদা দায় হয়ে গেল। সমাজ এমনই,বড় আহামুক,আর বিচিত্র । ভীষণ চিন্তিত ডাক্তার বাবু । কি করা উচিত? বৈশাখী কে বিয়ে করে সমাজের মুখ বন্ধ করবে ? তা কি করে হয়? দু জনের বয়সের তফাৎ দশ বারো বছর। তথাপি ইদানিং বৈশাখী র ও আব-ভাব কিছু টা বুঝতে পারে ডাক্তার বাবু । ডাক্তার বাবু ও যেন মা মরা কন্যা র প্রতি মায়া আর কিছু টা উছল যৌবনের টানে বৈশাখী র প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে দিন দিন। বৈশাখী এবং ডাক্তার বাবু কেউ কাউকে নিজেদের গোপন কথা প্রকাশ করতে পারছে না। না এভাবে চলতে পারে না । এক দিন বৈশাখী র মুখোমুখি হতেই হবে। তাই একদিন সন্ধ্যায় ডাক্তার বাবু ,তার মা , বৈশাখী, বৈশাখী র ঠাকুমার ও গ্রামের পঞ্চজনার সাক্ষাতে ডাক্তার বাবু প্রস্তাব রাখল সে বৈশাখী কে বিয়ে করতে চায়। সমাজের মুখ বন্ধ করতে আর বৈশাখী র প্রতি নিজের কর্তব্য পালন করতেই তার এই সিদ্ধান্ত। উপস্থিত সকলে ডাক্তার বাবুর এই সিদ্ধান্ত কে মান্যতা দিল এবং ধন্য ধন্য করতে লাগল। দীর্ঘ পাঁচ বছর বৈশাখী কে নিজের আশ্রয়ে সম্মানের সহিত রেখে ডাক্তার বাবু তাকে বিয়ে করতে চলেছে এই খবর চাপা থাকল না । নিজের গ্রামের মানুষ ছাড়াও অন্যান্য পাশ্ববর্তী গ্রামের যারাই শুনলো তারা ডাক্তার বাবুর প্রশংসা করতে লাগল। শুভ দিন দেখে বেশ জাঁকজমক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ডাক্তার বাবু অগ্নিস্বাক্ষী রেখে বৈশাখী র গলায় মাল্যদান করলেন। যা সমাজে বর্তমানে বিরল। আজ তিনি অষ্টম স্যার নন, ডাক্তার বাবু । আরো কয়েক বছর কেটে গেছে। বৈশাখী একটা চাকরি পেয়েছে। গ্রামীণ আশা কর্মী। বৈশাখী একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের মা। ডাক্তার বাবু আর বৈশাখী র জীবন সংগ্রাম কে সকলে সম্মান করে। তারা দুজনেই গ্রামের সেবায় নিয়োজিত। সকলকে আপন করে তারা আজ সুখী।
-------------------------------------
অচিন্ত্য কুমার ধাড়া।
সাহাচক, আমতা ,হাওড়া ,পশ্চিমবঙ্গ ।