ঘটনাটি ১৯৬৫-৬৬ সালের। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর। তখনও পঃ বাংলা তথা ভারতের লোকেরা বা পূর্ব পাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশের) লোকেরা লালগোলা--গোদাগাড়ি করিডর দিয়ে পাশপোর্ট ভিসা ছাড়াই পদ্মার ওপার -এপার দিব্যি যাতায়াত করতো। ওপারে নাকি সুযোগ সুবিধা অনেক। ভারত থেকে বিদেশে কাজের সন্ধানে যাওয়ার তেমন সুযোগ নাই। কারণ, ভারত একটি বিশাল দেশ।এখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু।তাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা উন্নত নয় ।তাদের মধ্যে লেখাপড়ার ও উচ্চশিক্ষার হারও বেশী নয়। আর সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। এই পরিস্থিতিতে , পূর্ব পাকিস্তানে গেলে নাকি অল্প লেখাপড়াতেও সহজে মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপ আমেরিকায় ভালো আয়ের কাজ পাওয়া যায়। শোনাশুনিতে এইসব অনেকেই বিশ্বাস করে।
তাই আব্দুল মালেক, আন্ডার মেট্রিক ,ও তার এক নানা হোসেন আলি শলাপরামর্শ করে , একবার ঢাকা গিয়ে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করলে হয় । আব্দুল মালেকের কোনো কাজকর্ম নাই অথচ তার সংসার আছে। আর হোসেনের বাপের অনেক টাকাপয়সা, তাই সে দোতারা বাজিয়ে আর বাঁশি বাজিয়ে দিন কাটায়। আব্বাসউদ্দীনের গান তোলে আর রেওয়াজ করে । গাঁয়ের লোকজন তার বৈঠকঘরে অনেক সময় ভিড় করে। আব্দুল মালেকও হারমোনিয়ামে তাকে সঙ্গত দ্যায়। সে ভাটিয়ালি ভাওয়াইয়া লালনগীতি নজরুলগীতি ইত্যাদিতে পারদর্শী। হোসেন আলির ইচ্ছা সে রেডিওতে গান করবে। কলকাতায় তো চান্স পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই , তাই তারা পরিকল্পনা করে , তারা একবার ঢাকা গিয়ে চেষ্টা করতে পারে। হোসেন আলি আবার পাশের গ্রামের খোকা মিঞার ঢাকার ঠিকানা জোগাড় ক'রে রেখেছে। চিঠিচাপাটিও দিয়েছে তাদের ইচ্ছা জানিয়ে। খোকা মিঞাও খুব সম্পদশালী পরিবারের ছেলে।সে ভারতে থাকবে না, পূর্ব পাকিস্তানে থাকবে। ওখান থেকে সে আমেরিকায় কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়তে যাবে ,এই উদ্দেশে সে ঢাকায় গিয়ে আছে। সে উদারভাবে ব'লে দিলো, যে কোনো সময় এসে যাও , থাকা-খাওয়ার কোনো চিন্তা কোরো না। ওখানে তার অনেক পরিচিতি হয়েছে, তাদের সাহায্যে সেও তাদের ইচ্ছামতো কাজ পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। খোকা মিঞার এই উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পেয়ে তারা ঢাকা যাওয়ার মনস্থ ক'রে ফেললো আর সেটা জানিয়ে চিঠি দিলো।,
তারা বাড়িতে বললো, কলকাতা ঘুরতে যাচ্ছে। কারণ, ঢাকা যাচ্ছে বললে কিছুতেই দুজনের কেউই যাওয়ার অনুমতি পেতো না । বাড়ি থেকে যাত্রা ক'রে তারা লালগোলা পৌঁছালো তারপর হোসেন আলি বাড়িতে চিঠি দিয়ে জানায় যে সে ঢাকা যাচ্ছে। তার সাথে তা নাতি আব্দুল মালেকও আছে। তারপর লালগোলা হ'য়ে তারা ওপারে রাজশাহির গোদাগাড়িতে পৌঁছলো। তারপর সেখান থেকে খোকা মিঞার ব'লে-দেওয়া রুট ধ'রে ঢাকায় গিয়ে হাজির হলো ।খোকা মিঞা তাদের থাকার ব্যবস্থা ক'রে দিলো সে যে বাড়িতে থাকে সেখানেই। তার চেষ্টায় আব্দুল মালেক গোটা দুয়েক বাড়িতে গান শেখানোর টিউশন পেলো।আর হোসেন আলি বাড়িতেই বিভিন্ন গানের রেওয়াজ আর দোতারা বাঁশি ইত্যাদির রেওয়াজ চালিয়ে যেতে লাগলো। আর খোকা মিঞার পরিচয়ের সূত্রে এখান সেখানে গানের অনুষ্ঠানে বাঁশি দোতারা হারমোনিয়াম সহযোগে দু'জনে তাদের স্বপ্ন সার্থক করার চেষ্টায় লেগে রইলো।
তারা দু'জনে ঢাকা রেডিও সেন্টারে গায়ক ও বাদক হিসাবে অডিশন দেওয়ার আবেদনও ক'রে রাখলো । যখন ওই লোক নেওয়া হবে তখন তাদের অডিশন হবে। সুযোগ আসবে এই অপেক্ষায় রইলো। খাওয়াদাওয়া সব খোকা মিঞার মেসেই চলছিলো। দেখতে দেখতে প্রায় ছ' মাস হ'তে চললো। কিন্তু তারা কোনো কাজের সুরাহা করতে পারলো না।
অন্যদিকে কোনো কাজ নিয়ে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টায়ও তারা লেগে রইলো। কারণ খোকা মিঞা
আমেরিকার কোন্ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে গবেষণা করার স্কলারশিপ পেয়েছে, তাই সেও হয়তো মাস দুয়েকের মধ্যেই আমেরিকায় পাড়ি জমাবে। তখন তারা কোথায় থাকবে ? যদিও খোকা মিঞা আশ্বাস দিয়ে বলেছে, তোমরা চিন্তা করো না । এটা তো আমার বাড়ি, তোমরা এখানেই থাকবে। তোমরা শুধু আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাও। সে নানারকম ভাবে ওদেরকে উৎসাহ দিয়ে যায়। আর সে তার বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত হ'য়ে পড়লো। কিন্তু হোসেন আলি যে টাকাপয়সা নিয়ে এসেছিলো তা তো প্রায় শেষ হ'তে চললো। তাই তাদের কাজের খুব দরকার। তারা ওখানে খোকা মিঞার সূত্রে নাগরিকত্ত্বের আবেদনও ক'রে রাখলো।
অন্যদিকে ভারতে ,অর্থাৎ পঃ বঙ্গে ওদের বাড়িতে আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়ে স্ত্রী পরিবার এরা সবাই দিনরাত পথ চেয়ে থাকে--- এই ওদের চিঠি আসবে, ওরা ফিরে আসবে, কিন্তু কিছুই আর আসে না।
আব্দুল মালেকের হারমোনিয়াম বাজানো ও বিভিন্ন গানের দখলের একটা মোহিনীজাল আছে। তাই ভারতে তার বৌ ছেলেমেয়ে থাকলেও, ওখানেও ঢাকার এক মেয়ে তার প্রেমে প'ড়ে গেলো। সেই মেয়ের কাছে সে যে বিবাহিত এটা সে গোপন ক'রে গেলো। সে ওখানে দ্বিতীয় বিয়ে ক'রে ওপারের নাগরিক হওয়ার ভিৎ মজবুত করার ধান্দায় ছিলো ।
মাস কয়েক পর রমজান মাস এসে গেলো। ওখানে রোজা না করলে খারাপ দেখায়, তাই ওরা নানা নাতিতে মিলে রোজাও করতে লাগলো। রমজান মাস শেষ হলো। সবাই ঈদের দিনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে দেখে তারা ততোটা মন খারাপ করলো না।
ঈদের দিন সকালে বাইতুল মোকার্রম মসজিদ ময়দানে ঈদের নামাজ পড়তে গেলো। দেখলো , ঈদগাহ চত্বরকে কতো সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে । নানা রঙের কাগজের ফুল, ফেস্টুন , তকবির লেখা পতাকা টাঙানো হয়েছে। ছোট ছোট ছেলেরা পাজামা পাঞ্জাবি মাথায় বাহারী বাহারী টুপি প'রে,ছোট মেয়েরা মাথায় রঙীন ফিতের ফুল প'রে ফ্রক প'রে ,সালোয়ার কামিজ প'রে ফিনফিনে জরীর ওড়না জড়িয়ে বেলুন বাঁশি চরখি ও অন্যান্য মন-ভুলানো খেলনা নিয়ে দাপাদাপি করছে আনন্দ করছে। চারিপাশে বড়ো বড়ো মাইক লাগানো হয়েছে। ইমাম সাহেব মাইকে রোজা ও ঈদের ফজিলত নিয়ে তাঁর বক্তৃতা রাখছেন। চারিপাশে এক অভিনব উৎসবের মেজাজ। নানা ও নাতি খুশী খুশী ওদের সাথে বড়ো জামাতে নামাজ পড়লো।
নামাজ শেষ হওয়ার পর যখন সবাই হাতে হাত মিলিয়ে কোলাকুলি আলিঙ্গন করছে, পরস্পরকে সালাম দিচ্ছে, বাড়িতে যাওয়ার দাওয়াৎ দিচ্ছে তখন আব্দুল মালেক ও হোসেন আলি একপাশে দাঁড়িয়ে সেই মনোরম দৃশ্য দেখতে লাগলো। কারণ তখন ময়দানে এতো ভিড় যে সহজে বেরোবার উপায় নাই। হঠাৎ আব্দুল মালেকের মনে অনুভব হলো, তাদেরকে কেউ সালাম দিচ্ছে না, কুশল বিনিময় করছে না,বা আলিঙ্গন করতে এগিয়ে আসছে না। তারা একপাশে অপ্রস্তুত হ'য়ে দাঁড়িয়ে ওই দৃশ্য দেখে যাচ্ছে। তখন মালেকের মনে হলো, ভারতে তার বাড়িতেও তো তার স্ত্রী ছেলেমেয়ে আছে বাপ মা আত্মীয়স্বজন আছে, তারা হয়তো তার ফেরার অপেক্ষায় ব'সে আছে ;তাদের হয়তো ঈদের দিনের কোনো আনন্দ নাই ,তাদের উৎসবও নাই।এই প্রথম সে নিজেকে ঢাকায় বিদেশী অনুভব করলো। তার মনটা গ্রামের জন্য, তার পরিবার আত্মীয়স্বজনের জন্য হুহু ক'রে কেঁদে উঠলো।আরে, জীবন তো আছে ওইখানে যেখানে আত্মীয়স্বজন আছে পরিবার আছে , নিজের গ্রাম আছে,জন্মভূমি আছে ! ম'রে গেলে মাটি দেওয়ার লোক আছে ,কেঁদে ভাসাবার সংসার আছে ! এখানে বিদেশে সে খামোখা কেন প'ড়ে আছে ?
মুহূর্ত্তেই সে সিদ্ধান্ত নিলো , নাঃ, এখানে আর নয় ! এখানে সে আলেয়ার পিছনে ছুটবে না ! এখানে তারা বিদেশী । সে আজই বাড়ি ফিরে যাবে । সে তার হোসেন নানাকে তার মনের কথা জানালো আর ওইখান থেকেই বাসায় এসে তার সামান্য কাপড়চোপড় ঝোলাব্যাগে ভ'রে নিয়ে সে উদ্ভ্রান্তের মতো ভারতে তার গ্রামের বাড়িতে ফেরার জন্য নারায়নগঞ্জের স্টীমারঘাটের উদ্দেশে রওয়ানা দিলো। তার হোসেন নানার গানের অডিশনের চিঠি এসেছে। সে তাকে আটকাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু নাঃ, সে বুঝতে পেরেছে সে এখানে একান্তই বিদেশী। ঈদের জামাতের শেষে তার বুক ফেটে কান্না এসেছে ! সে আর ওখানে এক মূহূর্ত্তও থাকবে না !- - -
সে ফিরে আসার দু'সপ্তাহ পরে হোসেন আলীও ফিরে এলো ব্যর্থ মনোরথ।
-------------------------------------------
© বদরুদ্দোজা শেখু , বহরমপুর
----------------------------‐------
কবির নাম-- বদরুদ্দোজা শেখু
ঠিকানা-- 18 নিরুপমা দেবী রোড , বাইলেন 12 ,
শহর+পোঃ- বহরমপুর , জেলা--মুর্শিদাবাদ,
PIN -742101
পঃ বঙ্গ , ভারত ।
হো• অ্যাপ নং +91 9609882748
----------------------
----------------------------------------