ছোটগল্প।। অহংকার ।। অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায়
অহংকার
অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায়
সকাল বেলায় হারুদার চায়ের দোকানে জমাটি আড্ডায় সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে সুগত বলল , আমাদের শহরটা বেশ উন্নত হয়েছে । তিনটে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল । দুটো মল । দুটো মাল্টিপ্লেক্স আর গোটা কয়েক ফুড সেন্টার । আর কি চাই?
সুজিত এবং বাকি সবাই সমর্থন করলো সুগতকে । ওদের ছেলে মেয়েরা সব পড়ে চিকেন সেন্টারের মত গজিয়ে ওঠা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে । ইংরেজি কতটা শিখছে সেটা অবশ্য বলতে পারবে না এই সব গর্বিত বাবারা । তবে এখন অবশ্য এরা কেউ আর বাবা নেই । সকলেই ড্যাডি কিংবা ড্যাড পদে উন্নীত ।এই সব বাচ্চাদের মায়েরা নতুন প্রজন্মের শিক্ষায় তৃপ্ত । কিঞ্চিৎ অহংকারীও বটে । বাংলা মিডিয়ামের ছেলে মেয়েদের কিংবা তাদের বাবা মা কে এড়িয়ে চলতেই ভালোবাসে ।
আজ শিশু দিবস । ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে শিশু দিবস উদযাপিত হবে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে । পেরেন্টসরাও আমন্ত্রিত । সুগতর স্ত্রী তাপসী সকাল থেকেই ব্যস্ত । সাজগোজটা চেকনাই হওয়া চাই । গত মাসের ফেস্টে সুলগ্না আর মির্ধা ফাটাফাটি ড্রেস করেছিল । সবাই ওদেরকে বলল , দারুন লাগছে । একদম সিনেমার নায়িকাদের মত ।
তাপসীর মনটা খারাপ হয়ে গেছিল । এবার তাই অনেক আগে থেকেই আলাদা ড্রেসারকে দিয়ে ম্যাগাজিন দেখিয়ে ড্রেস বানিয়েছে । হাজার দশেক টাকার ওপরে খরচ হয়েছে । সে নিয়ে স্বামী সুজিতের সাথে কম ঝামেলা হয় নি ।
ঠিক বেরোবার মুখে কাজের মাসি এসে হাজির । সাথে আবার বছর দশেকের ছেলে । ছেলেটা স্কুলে না গিয়ে এসেছে মা কে সাহায্য করতে । এইসব হা ভাতে ঘরের ছেলে মেয়ে দেখলে গা ঘিনঘিন করে তাপসীর । সেদিনকে এই নিয়েই কথা হচ্ছিল স্কুল গেটের বাইরে তেঁতুল গাছতলায় বসে । সবে টিফিনবক্স খুলে স্যান্ডউইচে একটা কামড় দিয়েছে , কোথা থেকে দুটো ভিখিরি মার্কা ছেলে মেয়ে এসে উপস্থিত । কি সাহস ! মাটিতে পাতা চাদরের ওপরে পা তুলে দিয়েছে ।তার পরে বলে কিনা , খিদে পেয়েছে | কিছু দেবে ? নেহাত উর্মিলা ছিল । একদম ঠোঁটকাটা । বলল , ভাগ এখান থেকে । যে তোদের পয়দা করেছে সেই বাপটাকে গিয়ে বল । বোকার মত হা হয়ে তাকিয়ে চলে গেল ছেলে মেয়ে দুটো ।
মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্তের দিকে এক পা বাড়িয়েছে তাপসীদের তিন জনের পরিবার । বড্ড দেমাক । বড়লোক বড়লোক ভাব । অহংকারে পা পড়ে না মাটিতে । হাতের কাছে গরিব মানুষ দেখলেই মন চায় উপহাস করতে । নিজের স্ট্যাটাস দেখাতে কাজের মাসিকে বিদ্রুপ করে তাপসী বলল ,
কি গো মাসি , আজ শিশু দিবস | তোমার ছেলে স্কুলে যায় নি ?
মাসি গরিব মুখ্যু সুখ্যু মানুষ ।
সহজ ভাবেই বলল , সে টা আবার কি গো ? স্কুল তো খোলা ।
ও ভুলেই গেছিলাম , তোমার ছেলে তো আবার সরকারি ফ্রী স্কুলে পড়ে । শিশু দিবসের মানে তোমরা জানবে কি ভাবে ? আমার মেয়ের স্কুলে আজ চিলড্রেন্স ডে । আমি এখনই বেরচ্ছি । আজ ১৪ই নভেম্বর । জওহরলাল নেহেরুর জন্মদিন । এই দেখো না কত গোলাপ নিয়ে যাচ্ছি । এক একটা ফুলের দাম পাঁচ টাকা । গোলাপ ফুল চাচা নেহেরুর অত্যন্ত প্রিয় । আর এই দেখ , নতুন ড্রেসটা বানালাম । দশ হাজার টাকা দাম । কেমন মানিয়েছে আমাকে ?সন্দর লাগছে । তোমরা তো এমনি সন্দর ।
তারপর ছেলেকে বলল , দেখ , দিদিমনি কত নেকা পড়া জানে । তুইও বড় হয়ে দিদিমনির মত নেকা পড়া শিখবি ।ছেলেটা হা হয়ে তাকিয়ে আছে তাপসীর দিকে ।
একটু কিন্তু কিন্তু করে মাসি বলল , ছেলেটার স্কুলের জামাটা ছিঁড়ে গেছে । হাতে টাকাও নেই যে কিনবো । দিদিমনি বলে দিয়েছে স্কুলের পোশাক পরে স্কুলে আসতে হবে । দু-তিন দিন হয়ে গেল স্কুলে যাচ্ছে না । তাই বলছিলাম দুশো টাকা যদি দাও ,তাহলে ভালো হয় । সামনের মাসের মাইনে থেকে কেটে নিও । খিঁচিয়ে উঠলো তাপসী । তোমাদের স্বভাব আর বদলাবে না । একদম জাত ভিখারি । যেই গোলাপের দামের কথা বলেছি অমনি তোমার ছেলের জামা ছিঁড়ে গেল । আর তাছাড়া , তোমার ছেলে লেখা পড়া শিখে করবে টা কি ? চালাবে তো রিকশা , না হলে করবে চুরি চামারি । তোমাদের ঢং দেখলে গা জ্বলে যায় । আমার কাছে টাকা নেই । তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে যাও | আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে ।
গির্জার পাশেই বড় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটা । ওখানেই পড়ে তাপসীর মেয়ে । এখানকার প্রধান ফাদার ড্যানিয়েল । কেরালার মানুষ । খুব দয়ালু কিন্তু স্ট্রিক্ট । বাচ্চাদের ভালোবাসেন । বলেন , প্রভু যীশু শিশুদের ভালোবাসতেন । ফাদার থাকেন শহরের শেষ প্রান্তে । সাইকেল চালিয়ে আসেন । আজকে স্কুলে আসার সময় দেখেন কতকগুলো বাচ্চা খাল থেকে জল সেচে জমিতে দিচ্ছে । জমিতে শীতের সবুজ ফসল । বসির মিঞা ব্যস্ত কৃষক । ফাদারকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলো ।
ফাদার বলল , মাই সান , তোমার ছেলেরা আজকে স্কুলে গেল না কেন ? আজ তো চিলড্রেন্স ডে । শিশু দিবস ।বসির মিঞা বলল , সাহেব , গরিব চাষার ছেলে ওরা । ওসব বড়লোকের ছেলে মেয়েদের জন্য । আমাদের কাছে সব দিবসই এক । কাজের দিবস । আর কথা না বলে চলে গেলেন ফাদার ড্যানিয়েল ।
-----------------------------------------------
অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায়
সংক্ষিপ্ত ঠিকানা : ব্যারাকপুর , উত্তর ২৪ পরগনা
যোগাযোগ : ৯০০৭১ ৩৬৩৮১