সেখ মেহেবুব রহমান
শহর থেকে ফিরতে বেশ সন্ধ্যা হয়েছে। আকাশ মেঘলা। সামান্য ঝড় উঠেছে সাথে হালকা বৃষ্টি। ছাতাও সঙ্গে নিতে ভুলেছি আজ। ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বেলে বাড়ি যাওয়া সম্ভব কিন্তু ভিজতে প্রস্তুত নয়। কিছুদিন আগেই জ্বর সেরে উঠেছি। স্থির করলাম ঝড় বৃষ্টি থামলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেব। ততক্ষণ স্টেশনের বাইরে এই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
স্টেশনারি দোকান। কয়েকদিন ধরেই বন্ধ। শুনেছি দোকান মালিকের মা অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি। বেচারা গত তিন দিন দোকান খোলার সুযোগ পায়নি।
রাস্তাঘাটে লোকজন বেশ কম। শুধু অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে এই জনশূন্যতা মেনে নেওয়া কঠিন। ঝড় বৃষ্টি বিকল্প কারণ হতে পারে।
একাকী দোকানে দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ বিরক্তই লাগছে। উপায় নেই, নিষ্প্রাণ মূর্তির মতো অঝরে নেমে আসা বৃষ্টির দিকে বাধ্য হয়েই চেয়ে আছি।
আমার সাথে একই ট্রেনে আসা কয়েকজন দুর্যোগ উপেক্ষা করেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। হয়তো ওদের তাড়া বেশি। কিন্তু এই অন্ধকারে কোনো অঘটন ঘটলে কি হবে? যদিও সেই ভাবনা ওদের নেই।
অতি ব্যস্ত মানুষগুলোর মধ্যে কয়েকজন আমার পূর্ব পরিচিত। পাশের গ্রামের। অনেক ভেবে ওদের ব্যস্ততার একটি কারণ খুঁজে পেয়েছি। গ্রাম ঢোকার আগে উত্তেজক পানীয়ের আসর বসে। সন্ধ্যের সময় ওখানে সুরাপ্রেমীদের ভিড় চোখে পড়ার মতন। দেরি করে পৌঁছলে যদি নেশার উপকরণ ভাগ্যে না জোটে, সম্ভবত সেজন্যই এই দ্রুততা।
ওদের নিষেধ করে লাভ নেই। তাও পরিচিত দু'একজনকে দাঁড়িয়ে যেতে বললাম। মাথায় সামান্য পলিথিন বেঁধে দাঁত বেড় করে চলে গেল। পলিথিন সত্যিই কি ছাতার কাজ করে? মাথা ভিজল না, কিন্তু দেহের বাকি অংশ। মনকে সান্ত্বনা প্রদানকারী এরূপ আচরণ মনে হাসির উদ্রেক ঘটায়। যদিও এখন মনে বেশ রাগ জন্মেছে। ওদের দাঁত দেখে মনে আগুন জ্বলছে। এইজন্যই বোধহয় বলে কারও ভালো করতে নেই। অহেতুক অপমান ছাড়া কিছুই জোটে না।
দোকানের সামনে সোলার লাইট অন্ধকার ঘুচিয়ে দিচ্ছে উন্নত বিজ্ঞানের সাক্ষী হয়ে। ছোটবেলায় রাতের অন্ধকারে হ্যারিকেনের আলোয় শেষ ভরসা থেকেছে। সন্ধ্যে নামলে গভীর অন্ধকারে আবৃত হত রাস্তাঘাট। তারপর এই বর্ষায় সাপের উপদ্রব, বিপদ আরও বাড়িয়ে দিত। পড়ন্ত বিকেলেই নিজদের ঘরবন্দী করে বৃষ্টিস্নাত দিনের পরিসমাপ্তি দেখতাম। বাইরে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছার মনের মাঝে মৃত্যু ঘটত।
আজ বাইরে রয়েছি। সেই সন্ধ্যা, সেই নির্জনতা। কিন্তু অনুভূতি নেই। বৃষ্টিতে ভিজতে আজ ভয় হয়। মনের মাঝে স্ফূর্তি উধাও। গ্রাস করেছে অজানা শত্রু।
দূরে মিষ্টির দোকানে দুজনকে লক্ষ্য করলাম। ওদের প্রাইভেট গাড়ি রয়েছে। গাড়ি থামিয়ে দ্রুত দোকানে ঢুকল। মিনিট পাঁচ পর বেড়িয়ে আবার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। কতই না ব্যস্ত ওরা। আশেপাশের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় নেই। ওদের অসাবধানতায় একজন বৃদ্ধ পথচারীর মৃত্যু হতে পারত। বেচারা বৃষ্টিতে ভিজে কোনোরকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছে। অনেক্ষণ থেকেই লক্ষ্য করছি। এখানে আসার জন্য চিৎকার করে ডাকলাম। দুর্ভাগ্য উনি শুনতে পাননি। তারই মাঝে বিপদের ঝলকানি। যদিও কোনোরকমে রক্ষা পেলেন।
মনে মনে গাড়ি সওয়ারিদের কুকথা বললাম। এরা আলোর থেকেও বেশি বেগে দৌড়ায়! নিজদের জীবন ব্যাতিত কিছুই বোঝে না।
বৃদ্ধর জন্য মন বিমর্ষ। তাঁর জন্য কিছু করার ইচ্ছাও প্রবল হয়েছে মনে। যদিও বৃষ্টির বেগ বেড়ে যাওয়াতে পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ হয়ে উঠল না। এখন উনি মিষ্টি দোকানের ডানদিকে ঝাঁপ নামানো সেলুনে আশ্রয় নিয়েছেন। সেলুন বন্ধ রইলেও সামনের ফাঁকা অংশে অ্যাসবেস্টর ছাউনী থাকায় এই দুর্যোগে নিরাপদ স্থান বলা চলে।
দূর থেকে বৃদ্ধকে দেখছি। মিষ্টি দোকানের আলোয় বৃদ্ধের শরীর বেশ বোঝা যাচ্ছে। মুখের চামড়া গুটিয়ে এসেছে। মাথায় চুলে ভর্তি, যদিও তাদের যত্নহীন স্থিতি চোখে আসছে। দাঁড়ি গোঁফও লাগামহীন ভাবে বেড়েছে বলেই মনে হল। পড়নে সাদা ধুতি, পাঞ্জাবী। সঙ্গে ছিন্নপ্রায় ব্যাগ। এহেন গড়ন তাঁর অসহায়তাকে স্পষ্ট করে। কিন্তু তিনি বিদ্ধস্ত কেন? এই দুর্যোগে একাকী রাস্তায় কি জন্য বেড়িয়েছেন? প্রশ্ন জাগলো মনে, উত্তর অজানা।
যতই ওনাকে দেখছি মন ভারাক্রান্ত হচ্ছে। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে জল খেতে একপ্রকার যুদ্ধ করলেন। নিজের মনের জোরের সাথে ভগ্ন স্বাস্থ্যের বিরুদ্ধে লড়াই। সামান্য ছিপি খুলতে সময় নিলেন মিনিট দুই! পাশে থাকলে সাহায্য করতাম, হয়তো মিষ্টি দোকান থেকে কিছু কিনেও দিতাম। যদিও সবই কল্পনা।
বৃষ্টি থামার অবকাশ নেই। উনি ওখানে একা নির্জনতার দিকে তাকিয়ে, এখানে আমি। আমরা দুই ভবঘুরে। যাদের সুখ দুঃখ নেই, পরিবার পরিজন নেই, ব্যাথা বেদনা অনুভূতিহীন।
বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ চতুর্দিকে ঝঙ্কার দিচ্ছে। তারই মাঝে কানে আসছে এক্সপ্রেস ট্রেনের হুঙ্কার কিংবা মালগাড়ির পরিত্রাণের আর্তনাদ। একজন ভরা যৌবনের স্বাদ নিচ্ছে, অন্যজন চায়ছে মুক্তি। বৃদ্ধ দ্বিতীয় জনের পথ অনুসরণকারী। সারা জীবন অন্যের বোঝা বয়তে গিয়ে আজ ক্লান্ত। তাঁর বহিরুপ সেই কথায় জানান দেয়।
দীর্ঘক্ষণ এই এক তরফা সাক্ষাৎ চলল। একাকী দাঁড়িয়ে থাকতে মনের মাঝে বিরক্তি প্রকট হয়েছে। অস্বস্তি দূর করতে দোকানের সামনেই পায়চারী শুরু করেছি। এটা আমার অভ্যাস। মনের উত্তেজনা কমানোর বিশেষ উপায়।
বৃষ্টির বেগ মাপতে একবার বাইরে বেরোলাম। বড়ো বড়ো ফোঁটা ইটের টুকরোর মতো মাথায় আঘাত করল। প্রত্যাঘাতের উপায় নেই। ভিতরে ঢুকলাম সঙ্গে সঙ্গেই। জানি না আর কত ক্ষোভের প্রকাশ ঘটবে।
নিজেকে নিরাপদে সরিয়ে নিতেই রাস্তার ওপর হঠাৎ জ্যান্ত কই মাছের লাফানি চোখে এল। কংক্রিটের মাঝে এই প্রাণের উপস্থিতিতে বিস্মিত হলাম। অন্য সময় হলে এতক্ষণে এটি মারা পড়ত। যেখানে আশ্রয় নিয়েছি তার পিছনেই ছোটো ডোবা। ওটাই এদের বাসস্থান। জায়গার মালিক বর্তমানে বাইরে থাকে। সামনের বছর ফিরে এসে ওই জলাশয় বুজিয়ে ঘর করবে। ততদিন অবধি ওরা নিশ্চিন্ত।
মাছটির দর্শন স্থায়ী হল না। বয়ে যাওয়া জলের স্রোতে মুহূর্তে নিরুদ্দেশ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেও বিফল হলাম। এদিকে একরত্তির দেখা পেতে কখন যে দোকানের বাইরে এসেছি হুঁশ নেই। বড়ো বড়ো ফোঁটার আঘাত স্নায়ু উজ্জীবিত করতে পারে নি। বৃষ্টিতে ভিজে নিজের অজান্তেই মনের গ্লানি দূর করেছি। ব্যাধির ভয়ও উধাও। মন সতেজ হয়েছ।
জলের স্রোতে কিছু একটা পায়ে ঠেকল। জায়গাটা নিচু, জল জমেছে বেশ। ভাবলাম সাপ হতে পারে। সেদিকে তাকাতে লাইটের আলোয় স্পষ্ট হল এক টুকরো ভাঙা ডাল জলস্রোতে ভেসে এসেছে। খেয়াল হল ডালের সাথেই ভেসে আসছে ঝড়ে পড়া পাতা। সারিবদ্ধভাবে তাদের গমন যেন মাঝ নদীতে নৌকার সারি। আঁকাবাঁকা পথে বেয়ে চলেছে অনন্তের পথে।
আচমকা ছোটবেলার স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে এল। মহানন্দে বৃষ্টিতে ভিজেছি। কাদা মেখেছি। কাগজের নৌকা বানিয়ে জমির সরু আলের পাশ দিয়ে বাহিয়ে দিয়েছি। ইচ্ছা হল সেই সুমধুর অতীতে পাড়ি দিয়। হাতের কাছে কোনো কাগজ নেই। ভেসে আসা গাছের পাতা দিয়ে এক মানানসই নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিলাম। রাস্তার পাশ দিয়ে সেটি ভেসে চলল বৃদ্ধের দিকে। আমার অপ্রকাশিত শ্রদ্ধার বার্তা নিয়ে।
লাইটের আলোয় দেখতে পাচ্ছি বক্রপথে নৌকার ভেসে যাওয়া। কখনো দুলছে, কখনো প্রায় ডুবন্ত, কখনো আবার মাথা উচুঁ করে হওয়ার পথে বেয়ে চলেছে নিজের ছন্দে। বৃষ্টিস্নাত আমি চেয়ে আছি সেদিকে, একদৃষ্টিতে বিভোর হয়ে।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
----------------------------------------------------
সেখ মেহেবুব রহমান
গ্রাম- বড়মশাগড়িয়া
ডাকঘর- রসুলপুর
থানা- মেমারী
পূর্ব বর্ধমান