গল্প।। আঁকা ভ্রূ, কাজলটানা চোখ দুটো।। উপেক্ষিৎ শর্মা
আঁকা ভ্রূ, কাজলটানা চোখ দুটো
উপেক্ষিৎ শর্মা
- তোকে নিয়ে একটা গল্প লিখব ভাবছিলাম।
- আমায় নিয়ে? তা লেখ না, ভালোই তো!
- না, মানে কীভাবে শুরু করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
- কীভাবে আবার? এভাবে শুরু কর,
ননী একজন বখাটে ছেলে।
- ধ্যাৎ, এ কি কথামালার গল্প নাকি?
- তাহলে, তাহলে লেখ,
ননী নামের ছেলেটা ভীষণ বাচাল।
- ধুর, কি যে বলিস না!
- তাও পছন্দ না? তাহলে এভাবে শুরু করতে পারিস,
এই যে এ পাড়ার ননী, এটা একটা অপদার্থ হলেও খুব সৎ আর পরোপকারী
- আরে ধুর! নিজেকে তুই এত অপগণ্ড ভাবছিস কেন? আর তাছাড়া আমি গল্প লিখব, তোর নিন্দে বা শংসাপত্র তো লিখছি না। তাহলে এসব কথা আসছে কেন?
- তাহলে তোর যেভাবে ইচ্ছে সে ভাবেই শুরু কর বাবা। আমি কিছু বলব না।
- করব? বলছিস? দাঁড়া, দাঁড়া। একটা মুখড়া মনে আসছে। আচ্ছা, এভাবে শুরু করলে কেমন হয়?
- বল। দেখি?
- যেমন ধর,
আলাপ জমাতে জমাতে, কথা বলতে বলতে, খুনসুটি করতে করতে, গায়ে গা ঘেঁষতে ঘেঁষতে কখন যেন একটা প্রেম বোধ জন্ম নেয়। একটা আবেশ, একটু আনমনা ভাব, একটু দিবাস্বপ্ন দেখাদেখি, একটা ফুরফুরে আমেজ আর তার সঙ্গে একটা অস্থির অনিশ্চয়তা আর সংশয়…
- দাঁড়া দাঁড়া। তুই কি বলতে চাইছিস বলত? ঠিক বুঝতে পারলাম না। এটা আমার কথা বলছিস, না কি তোর নিজের কথা?
- না, মানে যে কোন সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রেই এটা হওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়, বয়স লিঙ্গ নির্বিশেষে।
- কিন্তু তুই তো বললি, আমাকে নিয়ে গল্প লিখবি?
- হ্যাঁ, তাই তো!
- তা, এখানে আমার কথা কই? আমার বাবা-মা, আমার জন্ম, লেখাপড়া…?
- আরে বাবা, আমি তো তোর জীবনী লিখব বলিনি। তোকে নিয়ে একটা গল্প লিখব, গল্প। আর তাছাড়া তুই কি এখনও প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠিসনি?
- তা, তোর গল্পে আমি কোথায়? আমি কি শুধু একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক?
- দাঁড়া, একটু অপেক্ষা কর। এক্ষুনি তোকে নিয়ে টানাটানি শুরু করব।
- তা কর। তবে হ্যাঁচড়া হেঁচড়ি করিস না বাবা।
- ঠাট্টা করছিস! কিন্তু আমি তো অন্য কথা ভাবছি।
- কি ভাবছিস?
- ভাবছি, কী ভাবে গল্পটা এগিয়ে নিয়ে যাব?
-কী ভাবে?
- ঐ যে, তুই বললি না?
- আমি? আমি আবার কি বললাম?
- তুই বললি না, তুই যে কোন একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক? হ্যাঁ, তুই, মানে ননীও যেকোন একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবকের মতই এই প্রেম বোধে আবিষ্ট হল।
- আমি? আমি আবার কবে এসবের মধ্যে জড়ালাম ভাই?
- সেদিন, যেদিন তুই, মানে ননী, তোদের সামনের বাড়ির কার্নিশে একটা মৌচাক দেখতে পেলি। তখন সেটা বেশ বড় সড় হয়ে গেছে। অথচ এতদিন তোর সেটা চোখে পড়েনি। তুই ঐ মৌচাকটাকে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে কেমন বিবশ হয়ে পড়লি। কেমন স্থবির মত হয়ে গেলি। ভ্যান্ভ্যান্ করে উড়তে থাকা গুচ্ছ গুচ্ছ মৌমাছিগুলোকে দেখতে দেখতে তুই ওদের দলে ভিড়ে গেলি। তোর পিঠে একটু সুড়সুড়ি মত অনুভূত হল। তারপর আস্তে আস্তে তোর পিঠে দুটো ডানা গজিয়ে গেল। তুই উড়তে সুরু করলি। উড়তে উড়তে তুই ঐ মৌচাকটার কাছে পৌঁছে গেলি। বেশ খানিক্ষণ ঐ মৌচাকটার চারপাশে উড়উড় ঘুরঘুর করলি। তারপর তোর ঐ মৌচাকটার ভেতরে যাবার একটা অদম্য ইচ্ছে জাগতে থাকল। ঐ দলের যে মক্ষিরাণী তাকে দেখবার লোভ সংবরণ করতে পারলি না। ভেতরে ভেতরে একটা জেদ চেপে বসল। দেখতে হবে, তাকে দেখতেই হবে। তাই তুই সুযোগ খুঁজতে থাকলি কীভাবে সেই মক্ষিরাণীর কাছে গিয়ে পোঁছনো যায়।
- এই, দাঁড়া দাঁড়া। তুই এসব কি বলছিস? আমি মৌমাছি হয়ে গেলাম? রূপকথার গল্প নাকি? আচ্ছা, এর মধ্যে আমি কোথায়? কোথায় আমার কথা?
- আমি তো তোকে আগেই বলেছি, আমি তোর জীবনী লিখতে বসিনি। গল্প লিখব, গল্প। তোকে নিয়ে একটা গল্প লিখব। একটু ধৈর্য ধরে শোন।
- আচ্ছা বল। দেখি কোথাকার জল তুই কোথায় নিয়ে যাস?
- তা, কী হল; তুই সুযোগ খুঁজতে থাকলি ঐ মৌরাণীর খাস কামরায় যাবার। ঘুরঘুর করতে করতে ঢুকে পড়লি ঐ মৌচাকের একটা খোপ দিয়ে। ঢুকে দেখলি, ওরে বাবা, এ তো তে-মহলা পাঁচ-মহলা সাত-মহলা বাড়ির মত। একটা খোপ পেরোস আর এদিক ওদিক খুঁজতে থাকিস তোর কাঙ্খিত রাণীসাহেবাকে। এভাবে বেশ কয়েকটা খোপ পেরনোর পর অবশেষে তুই পৌঁছে গেলি মক্ষিরাণীর খাসমহলে। রাণীকে ঘিরে এক ঝাঁক মৌমাছির দল। রাণীকে দেখাই যায় না। ফাঁক ফোকর থেকে তোর চোখে পড়ল "আঁকা ভ্রূ, কাজলটানা দুটো চোখ"। দেখে কেমন মোহিত হয়ে গেলি, কিন্তু বিগলিত হলি না। আচ্ছন্ন হলি কিন্তু মতিচ্ছন্ন হলি না। আবিষ্ট হলি কিন্তু আবেগ তাড়িত হলি না। তবে একটা ঘোর লেগে রইল। কিছুক্ষণ পর ঘোর কাটলে হুড়মুড় করে একুঠরি ওকুঠরি পেরিয়ে বাইরে এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলি। কিন্তু ঐ "আঁকা ভ্রূ, কাজলটানা চোখ দুটো" তোকে আবিষ্ট করে রাখল। তুই এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাবছিলি এর'ম কেন হল? কি এমন দেখলাম? এমন সময় কয়েকটা সান্ত্রী জাতীয় হোঁতকা মৌমাছি ওদের হেঁড়ে গলায় হেঁকে উঠল,
- এই, কে তুমি? এখানে কি করছ? তোমায় দেখে ভিনদাশি বলে মনে হচ্ছে?'
- না, না, আমি এখানেরই লোক। তড়িঘড়ি উত্তর দিলি তুই।
- লোক, মানে লোকালয় থেকে এসেছ? তাই তোমার চোখে লোভ, তোমার চোখে ঘৃণা, তোমার চোখে হিংসা, তোমার চোখে হতাশা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
- তার মানে? তোমরা কি বলতে চাইছ?
- বলতে চাইছি, আমরা 'লোক' নই। আমরা মৌমাছি। আমাদের লোভ, হিংসা, ঘৃণা, হতাশা এসব কিছু নাই। শুধু শ্রম আর শৃঙ্খলা আছে। আর আনুগত্য।
- আর ক্রোধ? বিরক্তি মাখা রাগত স্বরে প্রশ্ন করতেই ওরা সমস্বরে উত্তর দিল,
- ক্রোধ, মানে রাগ? অবশ্যই আছে। তবে তা অকারণে প্রকাশ করি না। যখন কেউ আমাদের আক্রমণ করে তখন আমরা শত্রুকে হুল বিদ্ধ করে রাগ উগরে দিই। তারপর আবার আমরা আমাদের শৃঙ্খলায় ফিরে আসি।
- তা, তোমরা আমার ওপর এত মেজাজ দেখাচ্ছ কেন?
- ভুলে যেও না, এটা তোমার জায়গা নয়। লোকালয়ের লোক লোকালয়ে ফিরে যাও। ধমকের সুরে কথাগুলো বলে তোর চারপাশে ভনভন করে ঘুরতে লাগল। তুই ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলি। গুটি গুটি নিজের গ্রিল আঁটা ব্যালকনিতে ফিরে এলি। কিন্তু ঐ "আঁকা ভ্রূ, কাজলটানা চোখ দুটো" তোকে আচ্ছন্ন করে রাখল।
- ধুর, এটা আমার গল্প নাকি? এসব আজগুবি গল্পের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। প্রচণ্ড ক্ষোভ উগরে দিল ননী। ধুর ধুর, এসব গল্প দাঁড়াবে নাকি? বোগাস।
- দাঁড়াবে দাঁড়াবে। কোথায় দাঁড়াবে জানিস?
- কোথায় দাঁড়াবে, শুনি।
- ঐ যে, "আঁকা ভ্রূ, কাজলটানা চোখ দুটো", ঐখানে।
- ব্যাস! ওখানেই গল্প দাঁড়িয়ে গেল?
- দাঁড়িয়ে গেল কি রে? ওখান থেকেই তো চলা সুরু।
- আমি তো দেখছি সবই অচল, জগদ্দল।
- তুই নিজে একটা জড়ভরত, তাই ও'রম মনে হচ্ছে। নে ধর। ধর। ধর আমার হাতটা। ধর। চেপে ধরিস।
- তোর হাত? চেপে? আচ্ছা, নে, এই তো, এই তো ধরলাম…
হাতটা ধরার সঙ্গে সঙ্গে ননীর শরীরটায় একটা বেসামাল ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। কি একটা হিমশীতল স্রোত যেন শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। শরীরটা অবশ হয়ে এল। চোখ বন্ধ হয়ে গেল। স্থির, নিশ্চল স্থানুবৎ হয়ে গেল ননী। ভেতরে ভেতরে আরও কি সব হতে থাকল ঠিক ঠাহর করতে পারল না ও। মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠল ওর সামনের বাড়ির কার্নিশের নীচের সেই মৌচাকটা। ঐ দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার সেদিনের মত ও একটা ডানাওয়ালা মৌমাছি হয়ে গেল। শরীরটা শিথিল আর ফুরফুরে মনে হতে লাগল। এখন ও দিব্যি একটা মৌমাছির মত ডানা মেলে উড়ে মৌচাকটার চারদিকে ঘুরঘুর করতে লাগল। তারপর ফাঁক ফোকর খুঁজে ঢুকে গেল ভেতরে। এ কুঠরি ও কুঠরি পেরিয়ে পৌঁছে গেল সেই মৌরাণীর খাস মহলে। রাণীকে ঘিরে তোসামুদের দল চারদিকে ভন্ভন্ করছে। উঁকিঝুঁকি মেরে খুঁজতে চাইল সেই "আঁকা ভ্রূ, কাজলটানা চোখ দুটো", কিন্তু খুঁজে পেল না। খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে উঠছিল ননী। দম বন্ধ হয়ে আসছিল ওর। লোভ, হিংসা, ঘৃণা আর হতাশা নিয়ে বিফল মনোরথে ফিরে আসছিল ও। হঠাৎ পেছন থেকে একটা ডাক শুনতে পেল, 'ননী, এই ননী। ননীগোপাল। ননীগোপাল। দাঁড়া, দাঁড়া।' থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাতে চাইছিল ননী। কিন্তু কয়েকটা হোঁতকা মার্কা সান্ত্রী মৌমাছি ঠেলে ঠুলে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাইরে বার করে দিল ওকে। মৌচাক থেকে বেরিয়ে এসে ননী যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। আর তখনই, ঠিক তখনই একটা কাতর অথচ আর্ত আকুতি, "ওফ্, এত জোরে চাপ দিচ্ছিস কেন, হাতে ব্যথা লাগছে যে" শুনে চমকে উঠে ননী ধরে থাকা হাতটা ছেড়ে দেয়।
বই পড়ে যাবার একটা ছ্যাতরা ম্যাতরা আওয়াজ শুনে ননীর দিকে তাকায় ননীর সহধর্মিনী প্রমা। চা তৈরির মনোযোগ ছিন্ন করে ননীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
- কি হল, বইটা হাত থেকে পড়ে গেল যে?
- ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। যেন সম্বিৎ ফিরল ননীর।
- কি এত ঘুম ধরা লেখা পড়ছিলে ?
- ওই, পুরনো বইপত্তরগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে একটা পত্রিকাতে তোমার একটা লেখা চোখে পড়ে গেল। সেটাই পড়ছিলাম।
- কোনটা?
- ওই যে, "আঁকা ভ্রূ, কাজলটানা চোখ দুটো"
- ওহ্ ঐটা! বলে যেন 'কি মজা, কি মজা' এর'ম একটা ফিচেল হাসি মাখা মুখে চায়ের কাপটা সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে ননীর সামনে এসে দাঁড়াল। প্রমার দিকে অবাক জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে ননী বলে,
- আচ্ছা, তোমার এই "আঁকা ভ্রূ, কাজলটানা চোখ দুটো" মক্ষিরাণীটি কে গো?
- বলো কে?
- ঠিক বুঝতে পারছি না।
- ভেবে দেখো? গেস হু (guess who)? বলে যেন একটা কুইজের মধ্যে ফেলে দিল ননীকে।
অনেক ভেবেও কারও কথা মনে করতে পারল ননী। "আঁকা ভ্রূ, কাজলটানা চোখ"-এর কাউকে মনে পড়ল না ওর। অগত্যা প্রমার দিকে অপলক তাকিয়ে (এ ভাবে এর আগে কোনদিন প্রমাকে পরখ করেছে বলে মনে করতে পারে না ননী) কিছু যেন খোঁজার চেষ্টা করল। প্রমার মোটা কাঁচের চশমার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করেও প্রমারও "আঁকা ভ্রূ, কাজলটানা চোখ" কিনা বুঝতে না পেরে হতাশায় পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা প্রমার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে ননী। প্রমার চোখে চোখ রেখে অপলক তাকিয়ে থাকে ও। ধরে থাকা হাতটাতে চেপে চেপে ধরে। এভাবে কতক্ষণ জানে না। হঠাৎ ওর কানে আসে,
- "ওফ্, এত জোরে চাপ দিচ্ছিস কেন, হাতে ব্যথা লাগছে যে", শুনে চমকে উঠে চেপে ধরে থাকা হাতটা ছেড়ে দেয় ননী।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
--------------------------------
উপেক্ষিৎ শর্মা
দমদম,
কলকাতা।