আবু তাহের
দু'জন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ভাগীরথী মেসের দশ হাত দূরেই। মেয়েদের মেস।তাই বুঝি আশেপাশে সবসময় ঘুরঘুর করে। রেজাউল করিম সরণির গা চিরে একটা রাস্তা এঁকেবেঁকে এ-গলি ও-গলি হয়ে চলে গেছে গঙ্গার ঘাটের দিকে। পাশেই একটা মন্দির রয়েছে।একটা নিমগাছের চারপাশে বাঁধানো চাতাল। দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেন পাশ দিয়ে চলে গেছে। বাড়িগুলো এত ঘিঞ্জি যেন মনে হয় দেওয়াল ফুঁড়ে এক অন্যের শরীরে সেঁধিয়ে যাবে।সরু রাস্তার ভেতর দিয়ে দু'জন মানুষ পাশাপাশি সাইকেল চালিয়ে গেলে ঠোক্কর লাগে।
লোক দুটোকে লক্ষ করে স্নিগ্ধা।ভাগীরথীর পাশেই তাদের মেসটা।মেস বলতে একটা দোতলা বাড়ির নীচের তলায় তিনটে ঘর। সেখানে এক একটা রুমে তিনজন করে থাকে।
লকডাউনের সময় সবাই বাড়ি চলে গেছে।দিগন্তা আর মৌসুমি রঘুনাথগঞ্জ,কেয়াদি ইসলামপুরে,তিয়াষা দি বেথুয়াডহরী।দু'জন রয়েছে নীচের তলায় কেবল। স্নিগ্ধার কমার্স কলেজ।এখন তো বন্ধই।নাইসি লালদিঘির কাছে একটা মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবে কাজ করে।
দুপুরের দিকে কাজে বের হয়।ফেরে রাত করে।আজ সন্ধ্যা বেলা থেকেই ঝড় উঠেছে।আকাশ ছেয়ে ফেলেছে অন্ধকারে।অনবরত বাজ পড়ছে কাছাকাছি। মন্দিরের কাছে শিলাবৃষ্টিতে বরফ কুচি জমে ডাই হয়ে আছে। হঠাৎ করে লোডশেডিং। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দরজার আশপাশটা একবার দেখে নিল স্নিগ্ধা।কেউ নেই। এখানে একটা বেড়াল আর একটা কুকুর থাকে। সেগুলো কোথায় গেল এই ঝড়ঝঞ্ঝার রাতে। খুব চিন্তা হচ্ছে ওই দু'টোর জন্য।নাইসি ফোন করেছে।সে আজ আস্তে পারছে না।কোনো টোটো পাচ্ছে না তাদের ল্যাবের নিচ থেকে।এই প্রতিকূল পরিবেশে কেউ বের হবে বলেও মনে হয় না।নাইসিদের ল্যাবে থাকার জায়গা রয়েছে যথেষ্ট।
স্নিগ্ধার মনে কু গাইছে।সে একা থাকবে কী করে সারারাত এই বাড়িতে। বাড়ির মালিক মালকিন ছেলের কাছে কলকাতায় বেড়াতে গিয়েছিল। হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় আর ফিরতে পারে নি।তাহলে এই ঝড় বৃষ্টির রাতে তাকে একাই কাটাতে হবে! স্বপ্নেও এরকম দুঃস্বপ্নের রাত আসেনি কখনো তার জীবনে। মন্দিরের পাশে নিমগাছটা মাথাটা ভূতে পাওয়া মানুষের কালো লম্বা চুলের মাথার মত অনবরত দুলে চলেছে এপাশ ওপাশ।
বাবা-মায়ের সঙ্গে মনোমালিন্য করে আজ দু'বছর সে বাড়ি যায়নি। নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে এই মেস-জীবন কাটাচ্ছে।আজ বাবা-মায়ের অভাবটা কী একটু বেশি অনুভব করছে।নাহ্! যে বাবা-মা নিজের একমাত্র মেয়েকে আজ দু'বছর হলো ঘুরেও দেখতে আসেনি তাদের জন্য মন কেমন করার প্রশ্নই নেই। কেন যে এমন অন্যায় দাবি মনে প্রশ্রয় পেতে চায়।ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চায় এইসব উটকো চিন্তা।
আজ সেই বিয়েটাও তার টেকেনি। বাড়ির লোককে সে জানায়ও সেটা।তারাও গোঁ ধরে বসে আছে। মেয়েকে ঘরে তুলতে চায়না। স্নিগ্ধাও কেবল করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকতে চায়না। শিরদাঁড়া সোজা রেখে দাঁড়িয়ে বাঁচবে। বাবা-মা যেদিন তার মনের ইচ্ছে কে মূল্য দেবে সেদিনই সে ফিরে যাবে।তার আগে কোনোভাবেই নয়।তার বান্ধবীরা কত বুঝিয়েছে,"তুই একটা ভুল ছেলের পাল্লায় পড়ে নিজের জীবনটা নষ্ট করে ফেলিস না! বাড়ি ফিরে যা কাকু কাকিমাকে সব জানা।তারা তোকে ঠিক ফিরিয়ে নেবে!"
"কারও দয়ায় বাঁচতে চাইনা রে,তারা যদি সত্যি আমায় ভালোবাসে তাহলে একবার ফোন করে খোঁজ নিক। একবার আমার মেসে এসে দেখা করে যাক।" দৃপ্ত কণ্ঠে জানিয়ে দেয় সে।
২.
স্নিগ্ধার মেসে মা বাবা এসেছে। কতদিন পর! বাইরে দরজায় বেল দিতেই সে ছুটে গিয়ে দেখে তার ছোটবেলার দুই জগত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। মায়ের কোলে মাথা দিয়ে সে অনেক কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।বাবা তার দুখানা তালুর মধ্যে নিয়ে আদর করছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে বুড়ি কিচ্ছু হয় নি আমরা তো আছি নাকি!
স্নিগ্ধার তবু কান্না থামে না।এই মা-বাবা কে ছেড়ে সে দু দুটো বছর কী করে কাটিয়ে দিল।কীভাবে হেলায় নষ্ট হয়ে পিতা-মাতার স্নেহ ভালোবাসা ছাড়াই এতগুলো ঘন্টা দিন মাসের হিসেব। সে শুধু বেঁচেছিল মেসের বন্ধুদের ভালোবাসায়। ভেবেই বুকে চাপ ধরে আসছে। জোরালো কান্না ভেঙে পড়ছে বছর বাইশের যুবতী। মায়ের পিঠে মৃদু মৃদু আঘাতে উগড়ে দিচ্ছে জমে থাকা ক্ষোভ।
" কেন তোমরা একবার আমার খোঁজ নাওনি,আমি মরে গেছি কি বেঁচে আছি এবারও জানতে ইচ্ছে হয়নি তোমাদের! " তীব্র চিৎকার আর কান্নায় ফেটে পড়ছে স্নিগ্ধা। চোখের কোল বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।মা বাবার মুখ অপরাধীর মতো থমথমে।লম্বা গ্রীবা কেঁপে কেঁপে উঠছে,কন্ঠনালী ওঠানামা করছে অনবরত।মুখ দিয়ে গোঙানির মত আওয়াজ বের হচ্ছে।
"অ্যাই অ্যাই স্নিগ্ধা কী হয়েছে, খুব ভয়ের কোনো স্বপ্ন দেখছিস? ওঠ ওঠ আমি এসে পড়েছি।" সকাল সকাল নাইসির চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গুছিয়ে নিল দরকারি জিনিসপত্র ব্যাগে।
নাইসি জিজ্ঞেস করলোো এই তুই কোথায় বেরোচ্ছিস সকাল সকাল।বাইরে অকারণে বেরোলে পুলিশ ধরে ঠ্যাঙাবে।
আমি বাড়ি যাব নাইসি।
হঠাৎ বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে সে চমকে উঠলো। মুখ দিয়ে কথা সরছে না যেন।তবে কি তার উপর রাগ করেই এমন কঠিন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ! নাহ তা নয়।নাইসির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাই বলছে না।সে সত্যি সত্যি মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে চাইছে।কারও জন্য নয় নিজের জন্য।
কিন্তু এইসময় তো কোনো যানবাহন পাবি না। আবার পুলিশ ও টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে রাস্তায় রাস্তায়।কী করে যাবি? লকডাউন টা শেষ হলে গেলে ভালো হতো না!
নাহ নাইসি আমি আজই মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে চাইছি। বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে রে।
আর হ্যাঁ শুনছিস না পরিযায়ী শ্রমিকরা দু'শো পাঁচ'শ কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে দিনের পর দিন ফিরে আসছে। কিসের টানে জানিস। মাটির টানে। মায়ের টানে। আমিও এই শহরে বাস করতে করতে কেমন যান্ত্রিক হয়ে পড়েছিলাম।শিকড় উপড়ে পড়ে থাকতে চেয়েছিলাম শহরের ব্যস্ততায়।ডুব দিয়ে দেখলাম জল খুব গভীর রে।ছোঁয়া যায় না। স্পর্শ করা যায় না।বাস করা তো অনেক দূরের কথা।স্থান পাওয়া যায় নি রে।
আমাকে কোনো পুলিশ ধরবে না।ফিরে গিয়ে লকডাউন মানব আবার। কিন্তু এই অপরাধটুকু আমাকে করতেই হবে।ক'মাইল রাস্তা নাহয় হেঁটেই যাব। পরিযায়ীদের রাস্তা কেউ আটকানোর কথা নয়।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
------------------------
আবু তাহের
ভগবানগোলা, মুর্শিদাবাদ ।