মহাশ্বেতা দেবীর সান্নিধ্যে পাওয়া কিছু নিজস্ব উপলব্ধি
আশিস মুখার্জ্জী
মহাশ্বেতা দেবী, আমার মতে এক সাদামাটা জীবনের বর্ণময় অধ্যায়। ওনাকে নিয়ে লেখালেখি বিস্তর হয়েছে। বর্তমানে ওনার বিভিন্ন কর্মকান্ড নিয়ে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অনেক গবেষক নিজস্ব গবেষণায় রত। আমি শুধু দিদির বিশেষ দুটি দিক নিয়ে আলোকপাত করছি ।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো মহাশ্বেতা দেবীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় 1996-97 এ কলকাতায় মহামান্য কলিকাতা হাইকোর্ট বিচারপতি ডি ডি বাসুর তত্বাবধানে গড়ে ওঠা LASWEB (legal aid services west bengal ) এর কর্মসূচিতে । ওখানে ছিলেন ওনার স্নেহধন্যা বীথি বাসু মিত্র ( তৎকালিন সেক্রেটারি LASWEB ,Asansol) , আমি আবার ছিলাম বীথি ম্যাডামের প্রিয় পাত্র । তাই হয়ে ছিল প্রাথমিক পরিচয় । পরবর্তীতে অর্থাৎ পরের বছরই আমাদের বার কাউন্সিল অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল এর পরিচালন সমিতি নির্ণায়ক ভোটে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী প্রদীপবাবুর হয়ে অনুরোধ করেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী । তখন আবারও দেখা হয়, খুব সম্ভবত ওনার তখনকার ঠিকানা বালিগঞ্জে । সে সময় আমি আসানসোল- এর যেনে উনি তৎকালিন অবিভক্ত বর্ধমান, দূর্গাপুর , আসানসোল- এর কিছু অসহায় স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের হয়ে খোরপোষ ও দাবী দাওয়া সংক্রান্ত মামলা আমার কাছে পাঠান । আমি তখন একে বারে নবিশ ছিলাম, ২৮ বছর বয়সী । নেশা ছিল সাংবাদিকতা । না তখনও সেভাবে ওনার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করার সাহস ছিল না । যাই হোক ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগ, কলকাতায় যাওয়া আসা কমে যাওয়ায় এবং পাকাপাকি ভাবে আসানসোল-এ স্থায়ী হওয়ার দরুণ । এরপর কেটে যায় দীর্ঘ কয়েক বছর।
হঠাৎ একটা ঘটনা চলে আসে খবরের শিরোনামে । পুরুলিয়ার বুধন শবর হত্যা । হত্যা তো অনেকই হয়ে থাকে , কিন্তু এটি ছিল বিশেষ একটি হত্যা । ছেলেটি যে শবর ছিল তাই নয়, তাকে অন্যায় ভাবে কাস্টডিতে ( পুলিশ ) পিটিয়ে মারা হয় । সাময়িক কিছু হই চই হলেও অন্যান্য অনেক ঘটনার মতন এটিও চলে যেত বিস্মৃতির অতলে । কে কার খোঁজ রাখে অত শত, বিশেষত পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে একজন উপজাতির কিশোরের মৃত্যু কেন্দ্রিক ঘটনা । না , এখানে কিন্তু তা হয়নি । হয়নি কারন সরাসরি সামনে থেকে লড়াইটা চালিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী । সঙ্গে ছিল কলকাতা হাইকোর্টের কয়েকজন আইনজীবী, যার মধ্যে ঐ সময় দিদির সদা বিশ্বস্ত প্রদীপদা ( বর্তমানে প্রয়াত ) । কী ঘটেছিল সেদিন সেটা খবরের কাগজের সৌজন্যে অনেকেরই জানা । তবুও বলি, সেটা ছিল 1998 সাল। ছেলেটি মানে বুধন শবর নিজের সাইকেলে চড়ে ফিরছিল হাট থেকে নিজের গ্রাম অঁকড়বাইদে । মাটির কাঁচা রাস্তায় তার পথ অবরোধ করে কেন্দা থানার পুলিশ । শুরু হয় জিঙ্গাসাবাদ এর নামে অবান্তর প্রহসন । অবশেষে বিনা কারনে ওয়ারেন্ট ছাড়াই ছেলেটিকে ভরা হয় লক আপে। রাতে চলে ছেলেটির উপর অমানবিক ও নৃশংস অত্যাচার । পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা অধিকাংশই ছিলেন মদ্যপ , তাই ছিল না হুঁশ, এরকমই ছিল খবরে প্রকাশ । অত্যাচার যে পর্যায়ে উঠেছিল শ্লীলতা জনিত কারনে তা প্রকাশ সম্ভব নয় । যথারীতি মৃত্যু হয় ঐ কিশোর খেরিয়া শবর ছেলেটির । তারপর,,,,,,,, আমাদের মত গণতান্ত্রিক দেশে যা হয়, দেখছি , দেখব, আস্থা রাখুন, নিরপেক্ষ তদন্ত হবে। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি পাবে । হ্যাঁ, একটা তদন্ত হয়েছিল, তাতে করে শুধু মাত্র একটি আন ন্যাচারাল ডেথ রিপোর্ট লেখা হয়েছিল । আর ঐ হতভাগ্য ছেলেটিকে অপরাধপ্রবন জনজাতির একজন হিসেবে চিহ্নিত করে বেশ কিছু পুরোনো ঘটনার সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল । ডাকাতি ছিল অন্যতম । বলা হয়ে ছিল যা অনত্র বলা হয়ে থাকে , ছেলেটি আহত অবস্থায় ক্ষত নিয়ে অ্যরেস্ট হয় । হঠাৎ করেই রাতে অবস্থার অবনতি হয় , তখন নিকটবর্তী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় । পথেই ছেলেটির মৃত্যু ঘটে জাতীয় কিছু একটা । এখানেই ওঠে প্রশ্ন, সত্যি যদি ছেলেটি আহত বিক্ষত অবস্থায় অ্যরেস্ট হয়ে থাকে, তখনই তার মেডিকেল কেন করা হয় নি । কেন সারারাত তাকে লক আপে ফেলে রাখা হয় । কিছু গোপনাঙ্গের টাটকা ক্ষত হয় কি করে? না , চ্যাপ্টার ক্লোজড করে দিয়েছিলেন কর্তারা । পথে নামেন মহাশ্বেতা দেবী । তৎকালিন বামপন্থী রাজ্য সরকারকে নিরপেক্ষ সি বি আই তদন্তের জন্য করেন অনুরোধ সরকারিভাবে । কাজ না হওয়া মহামান্য হাইকোর্ট এর দ্বারস্থ হন । দীর্ঘ যুক্তি তর্কের শেষে আদালতের রায়ে , ঘটনাটির তদন্ত ভার পায় সি বি আই স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ । যদিও ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে, লোপাট হয়ে গেছে অনেক সাক্ষ্য প্রমাণ, তবুও এক অদমনীয় যোদ্ধার লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়ে তদন্ত শুরু করে দু জন আধিকারিক এর বিরুদ্ধে চার্জ সিট দেয় সি বি আই FIR Regd date --19/02/2001, CBI CASE NO - ( RC- 04/S /1998) ঘটনাটি ঘটে 1998 সালে , আর সি বি আই তদন্তে নামে মহামান্য হাইকোর্ট-এর নির্দেশ পাবার পর 19/02/2001- এ । পুলিশের আধিকারিক দুজনের বিরুদ্ধে চার্জ ছিল ভারতীয় দন্ড বিধির 120 B , r/w 306, 338, 348, 465, 471 ধারায় । সর্বমোট ৮৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সাক্ষ্য তালিকায় রাখা হয় ।
সি বি আই এর সিনিয়র প্রসিকিউটর হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন 2012-13 তে এই মামলাটিতে মাস আটেকের জন্য নিযুক্ত ছিলাম । তখন মহাশ্বেতাদি কে পুরানো পরিচয় এর সুবাদে কিছু জিঙ্গাসা করেছিলাম। দিদি আপনি কেন এত কিছু থাকতে পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত প্রান্তিক উপজাতি গ্রাম এ এসে এদের নিয়ে আন্দোলন এর সাথী হলেন? কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলেন, -- আমি কিন্তু এই ঘটনার অনেক আগে হতেই যুক্ত ছিলাম ওদের সাথে সেই সত্তর দশকের একদম শুরুতে । ভাবতে অবাক লেগেছিল বিশেষ একটি জনগোষ্ঠীকে ইংরাজ সরকার ১৮৭১ সালে " অপরাধ প্রবন জনজাতির তকমা দেয়।" তারা আর কেউ নন , এই খেরিয়া শবর উপজাতি । পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই তকমাটা কিন্তু রয়েই যায়। দীর্ঘদিন ধরে শুরু করেছিলাম সরকারি বিভাগে চিঠিপত্র লেখালেখি । অবশেষে সরকারি নোটিফিকেশন এ বিমুক্ত হয়, অপরাধ প্রবন জনজাতির তকমা । শবর জনজাতি পায় অকারন অত্যাচার ও অ্যরেস্ট হতে মুক্তি । সত্যি ই কি মুক্ত হয়েছে ওরা । এখনও সুযোগ পেলেই চলে অকারন হেনস্থা । দেখলে না বুধন শবরের ঘটনাটা ।
সত্যিই, অবাক হয়েছিলাম সেদিন । জেনেছিলাম শবর জনজাতির সম্পর্কে অনেক কিছুই । পশ্চিম বঙ্গের নোটিফায়েড ৩৮ টি উপজাতির মধ্যে রয়েছে এই শবর বা খেরিয়া শবর উপজাতি । Austric Dravrian প্রজাতির।মুন্ডা, ভীল, বীরহোড়, পাহাড়িয়া মাল-দের মতই শবর ও এক প্রাচীন জনজাতি । শাল, পলাশ, মহুয়া ঘেরা জঙ্গলে বন্ধুর ভূমিকা প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা এই জনজাতি লোকালয়ে কোলাহল হতে দূরে নির্জনতাকেই পছন্দ করে । দারিদ্র্য, কুসংস্কার আর অজ্ঞতা এদের জড়িয়ে রেখেছিল আষ্টে পিষ্টে । খাবার মূলত জঙ্গলের ফলমূল , বিভিন্ন শিকড় বাঁকর, ব্যাঙ, গোসাপ, ঢ্যামনা সাপ, শামুক,মেঠো ইঁদুর, কাঁকড়া, গুগলি, ডিম্ব সহ মৌচাক, এবং তীর ধনুক এর মাধ্যমে শিকার করা খরগোশ, হুড়াল এর মাংস । এই অন্ধকারাচ্ছন্ন জনজাতির মধ্যে সভ্যতার আলো তথা প্রানের স্পন্দন এনেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী ।
২০১২ সালে ওনার সাথে আলোচনার সময় আমার কাছে থাকা কাঙাল মালসাট, বইটা দেখে জানতে চান পড়েছি কিনা। না তখনও পড়া হয় নি বইটা । পড়ব বলে সেদিনই নিয়েছিলাম এক বন্ধুর কাছ হতে , সেকথা জানতে পাল্টা প্রশ্ন তুমি আমার হাজার চুরাশির মা পড়েছ ? সলজ্জে জানিয়েছিলাম না , তবে সিনেমাটা বার দুয়েক দেখেছি। কিছুক্ষন স্তব্ধতার পর উঠবার সময় জেনেছিলাম, ওনার সংসার টেকেনি । 1942 এ বিজন ভট্টাচার্যের সাথে বিবাহ 1962 -63 তে ভেঙে যায় । একাকীত্ব হতে মুক্তি পেতে 1964 তে অসিত গুপ্ত র সাথে দ্বিতীয় বিবাহ, যার 1975-76 এ সমাপ্তি ঘটে। বড় একা ছিলেন । তাই তো নিঃসঙ্গতা কে ভূলতে ছুটে গেছেন আদিম জনজাতির মাঝে ওদেরই একজন হয়ে । কারও দিদি, কারোর মা । পুরুলিয়া স্টেশন-এ নেমেই জড়িয়ে ধরতেন তার ভার, সন্তানদের । খোঁজ নিতেন সবার । নদী দেখলেই জলে নামতেন, ভিজে শাড়িতে কাটাতেন সারা দিন , খেতেন শবরদের বাড়িতেই। চলে আসার আগে শুধু কিছু টুকরো কথায় বুঝতে পারি , উনি ওনার একমাত্র সন্তানকে খুবই ভালবাসতেন । বিচ্ছেদের পর সন্তান হতে আলাদা হবার গভীর যন্ত্রণা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেত অহর্নিশি । 'হাজার চুরাশির মা' বইটিতে সেই নিজস্ব বেদনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। খুবই ভালবাসতেন ওনার সন্তানকে (নবারুণ ভট্টাচার্য , সেদিনই প্রথমবার জেনেছিলাম আর অবাক হয়েছিলাম)। এই ক্ষতই পাকাপাকি উপসম করেছিল ঐ আদিম জনজাতির সন্তানেরা।
তবে কি জানেন তো যে কথা বলছিলাম, ঐ মামলার রায় কিন্তু দেখে যেতে পারেন নি । আর হ্যাঁ, আমাদের দিদি মানে মহাশ্বেতা দেবী কিন্তু একটা কথা রাখেন নি । কি বলুন তো ?
বাংলাদেশের লেখক সাংবাদিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ওনার কিছু কাজ এখনও বাকি । শেষ করতে করতে ২০২৫ হয়ে যাবে। মানে ঐ সাল পর্যন্ত উনি থাকবেন আমাদের সাথে । না, কথাটা রাখা হল না । চলে গেলেন ২০১৬ তেই।।
=======================
*** পুনশ্চ-- মহাশ্বেতা দেবী আমাকে ওনার বালিগঞ্জ এর ঠিকানা সম্বলিত প্যাডে একটা এক পাতার চিঠি পাঠিয়েছিলেন আন্তরিক ভাবে বিশেষ কিছু বিষয়ে । খুব ইচ্ছে ছিল চিঠিটা এই লেখনীতে সংকলিত করার। কিন্তু দুর্ভাগ্য কিছু গোপনীয়তা জনিত কারনে ( যেহেতু সি বি আই মামলা সংক্রান্ত) দেওয়া গেল না ।
( ## লেখনীর স্বত্ব সংরক্ষিত @আশিস মুখার্জ্জী । আইনজীবী, প্রাক্তন পাবলিক প্রসিকিউটর, সি বি আই ।)