মধু মাঝি দাঁড় টানে , নৌকা বায় , যাত্রী পারাপার করে । দেহের মন্দিরে ভরন্ত যৌবন ভক্ত উপচে পড়ার মতো শরীরের পেশীর বাহুল্যে মোচড় মেরে গুঁতোগুঁতি করে । এ বয়েসটা অফুরন্ত তেজের বয়েস । মধুর বাপ ক্ষুদে মানে ক্ষুদিরামও এই নদীতে নৌকা চালায় । মধুর বয়েসে তাগদ ওয়ালা শরীরে সংসারের জোয়াল কাঁধে নেওয়ার পরিবর্তে দাঁড় টেনে টেনে পয়সা উপার্জন করত।
মধু তখন দুধ তোলার মতো এতটুকুন । ক্ষুদে সাঁঝের আঁধার গাঢ় হলে ঘরে সেঁধোয় । হাতে চটের বস্তার তৈরি ঝোলা থোলে । নদীর মাছ , কাঁকড়া , চিংড়ির একটা আলাদা বাঁটার খাপতে ঢোকানো থাকে সে থোলের পেটের মধ্যে । আর মধুর মা বিন্দি যা টেনে টেনে ঝোলা কাবার করে তা হল সের দু'য়েক দুনো চাল , মিষ্টি কুমড়ো , কলমী নয়তো হেলেঞ্চার ঝাঁটি , আর হয়তো তে চোখো কি চার চোখো গোল আলু । মধুদের তিন এক্কে তিনের সংসারে আর যদুর আগমন হলো কই ?
বিন্দি ফোঁকর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে কোলে নালে ঝোলে মাখো মাখা মধুকে চড়িয়ে দেয় বাপের কোলে । আর ম্যাজিকের মতো হাত বদল হয় ঝোলা থলের ভার । এ সংসারের আটপৌড়ে জীবনে তিনজনেই বাঁধা পড়ে গেছে ত্রিচরিত্তিরের ভূমিকা নেভাতে ।
তা এ দিগরে বাপ আর ছেলে এ নদীর জীবনে কতকাল যাত্রী পারাপার করে ভবনদীর অকূল দরিয়ার মাঝিগিরি করে চলেছে তার হিসেব মেলে না ।
প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে হিসেব চলে মাঝি নৌকার গমনাগমনের মধ্যে বাপ আর ছেলের ট্রিপ দেওয়ার ক্ষমতা বয়েসের ফের ফারে কত কার তার চূলচেরা বিশ্লেষণ ।
প্রকৃতি ঝোঁকে মধুর দিকে । মানুষ ঝোঁকে মধুর স্বপক্ষে । মধু জোয়ান বেটা । তো ক্ষুদে বুড়ো হাড়ের হাড়ভাঙা যমের অরুচি ।
ভোরের হাওয়া গতরে মাখতে মাখতে আদুর গায়ের কুন্দফুলের মতো রূপসী যামিনী প্যাসেঞ্জার দলের মধ্যে সুরুৎ করে সেঁধিয়ে নদীর বাওড়ে নেমে চিংড়ি , লাল কাঁকড়া ধরতে যায় হরবখত । মধু , যামিনীর পারানির কড়ি আধলা নিতে গিয়ে চোখ বিঁধে যায় ওর যৌবনের বানে । ভেসে যায় ওর মিষ্টি সলজ্জ হাসির চিলতে রেখায় । হাসির রশি ঠোঁটে ঝুলিয়ে যামিনী জিতে নেয় মধুর উথাল পাথাল ঢেউ তোলা মনটা ।
প্যাসেঞ্জার কম থাকলে ভোরের সদ্য ফোটা সূর্যমুখীর মতো যামিনী যখন চেয়ে দেখে মধুর পানে তখন যেন ফুটন্ত সূর্যমুখী যেমন সূর্যের পানে চেয়ে চেয়ে কাটিয়ে দিতে চায় দিনমান , যামিনীও তেমনি মধুর পানে ভোরের তাজা চাউনি মেলে পার করে দিতে চায় তার গোটা জীবন । মধু বোঝে এ ফুলের নৈবিদ্যি তার জন্যেই মেলে ধরেছে । বলে , " মাছ , কাঁকড়া ধরার কাজ ছেড়ে আমার ঘরনী হবার সখ নেই গো যামিনী ? "
যামিনী বলে না কিছু । শুধু একবারটি আকুল আর্তি মেশানো সুডোল গাল দুটো ফুলিয়ে রক্তাভা ঠোঁট দুটিকে চুম্বনার্ত করে তোলে ।
মধু ফিসফিসিয়ে বলে , " সারাটা দিন শুধু কাজ আর কাজ । ফুরসত নেই দিন গুজরানের কেজো অন্তরে । নইলে প্রাণ ভরে দুটি মন , দুটি প্রাণ , মিলত কথা সাগরে অফুরান । "
" যামিনী , যামু রে , তোর কি সময় নেই রে । আমাকে দেবার মতো একদণ্ড সময়ও নেই কি তোর জেবনে । "
যামিনী বলি বলি করে একদিন উত্তর দেয় । বলে , দিনমান যদি সূর্য দেবতা কেড়ে নেন তবে আঁধার রাতে করে নেব সময় ।
মধু শুনে থরথর করে কেঁপে ওঠে । তার পেশীবহুল শরীরের সংসারে যেন বাস্তু ঘুঘুর বাসায় কে নড়ে চড়ে ওঠে । ঠোঁট দুখানি জিভের লালায় একবার চেটে ভিজিয়ে নেয় মধু । কথাটা পরিষ্কার বলতে ঠোঁটের আড়ষ্টতা কাটানো তো দরকার । দরকারি কথা মধুর জীবনে এবার চরম আতিশয্য ঢেলে বেরিয়ে আসে । বলে , " নদীর ঘাটে নৌকো বাঁধা থাকে জানিস তো । চলে আসিস ভোর রাতের শুকতারাকে সাক্ষী রেখে । রাত শেষের সময়টুকু উজার করে কথাকলি ফোটার পাপড়ি মেলে দেব সূর্য ওঠার অপেক্ষায় । "
এত ভারী কথাও যামিনীর কাছে ইঙ্গিতময় বিহ্বলতা আনে যেন হৃদমাঝারের ঘাটে স্থিরভাবে বাঁধা মন পবনের নাও । শুধু বাতাস , এক বুক ভরা প্রেমের সুপবন বইয়ে দিতে রাতটুকু বাকী রাখার অপেক্ষা ।
মা বিন্দি খনখনে গলার বুড়ি । ক্ষুদের ভোঁস ভোঁস ঘুমের অসার শয্যার পাশে জেগে ওঠে । মধু দরজার হুড়কো খুলে বাইরে এত রাতে কোথায় যায় জানতে চেয়ে মৃদু খনখন করে ওঠে । " ওরে অ মধু , রাত কাবার হতি পারল না । এখনিই উঠলি । জোরাজুরি পারাপার লেগেছে গাঙে বুঝি ।"
মধু নিমেষে জবাব দেয় আধভাঙা ঘুমের বিরক্ত মেশানো গলায় , " হাঁ মাগো । বড় পারানির দাঁও আছে গো । ঠিক সময়ে না যাতি পারলি ফসকে যাবে । আগে থেকে কড়ার করে রেখেছে তো । সময় দেছে এখন । "
বিন্দি ভিতর থেকে দরজা এঁটে নিশ্চিন্ত মনে আবার শুয়ে পড়ে । মধু তার শেষ পারানির নির্ভরযোগ্য কড়ি ।
ঘাটের পথ মধুর হাতের তালুর মতো চেনা । অন্ধকারে শুকতারার জ্বলজ্বলে আলো লক্ষ্য করে পথ হাঁটে মধু ।
নৌকার লগি ঠেলে ভাল করে বসে নেয় পাটাতনে । রিনরিন শব্দ দু'হাতের কাঁচের চুড়ির , খসখস শব্দ সাদাটে মখমলের মতন শাড়ির আঁচলে , পাড়ে ধসটাধসটি করে । মধু মুখ উজিয়ে চাইতেই রূপকথার পরির মতো হাত বাড়িয়ে দেয় যামিনী । অপরূপ সেজে এসেছে যামিনী । মধু উঠে দাঁড়িয়েছে , হাত বাড়িয়ে দিয়ে যামিনীর হাত ধরে । একটু টান দিতেই একেবারে কোলের মধ্যে এসে পড়ে যামিনী । মধুর ঠোঁটে যামিনীর ঠোঁট নরম তুলতুলে ঘষা খায় । যামিনীর বুক দুটোর তীক্ষ্ণ বৃন্ত মধুর চেটালো বুকে বিঁধে যায় । মধু পাঁজাকোলা করে বুকের মধ্যে ভরে নেয় যামিনীকে । দু'জনে পাটাতনে বসে শরীরে শরীর মিশিয়ে বসন্তের কোকিলের মতো ভোর রাতের মধুর কূজনে মত্ত হয় । দূর আকাশের অন্ধকার ফুঁড়ে ভোরের শুকতারা গায়ে আঁধার মেখে তখন আলো ফোটার অপেক্ষায় সময় গোনে ।
শুরু হয় আঁধার রাতের প্রেম কূজনের শুকতারার আলো নেভা ভোরের অপেক্ষা । সূর্য দেবতা হররোজ দিনমানের সময় কেজো প্রবাহে কেড়ে নিলেও , ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায় থাকা শুকতারাটি মধু-যামিনীর নিশি পরির নেমে আসা প্রেম মিলনের সাগরে আলো দিয়ে কত রাত পার করে দেয় তার হিসেব কে রাখে ?
----------------------------------
বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরী
গ্রাম- বিশ্বনাথ পুর
রামনাথপুর
জেলা উঃ ২৪ পরগনা।