ছোটগল্প ।। প্রতিস্থাপন।। সোমা চক্রবর্তী
ছবিঋণ- ইন্টারনেট
মাঝরাতে একটা অস্বস্তিতে ঘুমটা ভেঙে গেলো অজয় বসুর। শুনতে পেলেন বসার ঘরের দেওয়াল ঘড়িতে দুটোর ঘন্টা পড়ছে। পাশের টেবিল থেকে জল নিয়ে খেতে গিয়ে দেখলেন, ঘরের প্রায়ান্ধকার কোণায় কে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের এক যুবক।
অসম্ভব ভয়ে কয়েক মুহূর্ত নিঃশ্বাস ফেলতে পারলেন না তিনি। তাঁর বাড়ি যথেষ্ট নিরাপদ ভাবে তৈরি। এভাবে শোবার ঘরে কেউ চলে আসতে পারবে না সহজে। তাহলে? কোনো মতে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন - কে ওখানে?
মোলায়েম গলায় ছেলেটি বলল,- আমি চন্দ্রচূড়।
নামটা কি চেনা? কে চন্দ্রচূড়? অফিসের কেউ? বিসনেসের সূত্রে চেনা? না কি নামটা অন্য কোথাও..
-ঠিক ধরছেন। দু'মাস আগে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আমার হার্ট ই আপনাকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল।
-ত্-তুমি মানে আপনি তাহলে-
-আমি জীবিত নই।
-কি চান আপনি? কেন এসেছেন?
ভয়ে ঘামতে লাগলেন সুজয় বসু।
-দেখুন, খুব সখ করে আমি আসিনি। কেউ আসতে চায়ও না। মৃতদের নিয়ে যে সব কথা প্রচলিত আছে সেসব বেশীরভাগই ঠিক নয়। আমি নিতান্ত দায়ে পড়ে আপনার কাছে এসেছি।
-কেন? কি দায়?
-বলছি।
হাসল ছেলেটি।
-আমি অনাথ। আত্মীয়ের কাছে বড় হয়েছি। নিজের চেষ্টায় মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। ভালো ছাত্র বলে সুনামও পেয়েছি। অন্যায়ের সাথে আপোষ করিনি বলে কিছু শত্রুও জুটেছিল। হাউস স্টাফ হিসেবে কাজ করতে করতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে নিজের কলেজেই ভর্তি ছিলাম। অবস্থা কঠিন ছিল, কিন্তু সেদিনই হয়তো মারা যেতাম না। তবু কৃত্রিম শ্বাসক্রিয়া খুলে নেওয়া হলো। আমাকে মৃত ঘোষণা করে আমার হার্ট আপনাকে প্রতিস্থাপন করা হলো। আমার নিজের বলতে কেউ নেই, তাই কেউ কিছু জানতে চাইলো না। সহপাঠীরাও কিছু বুঝলো না, কারণ আমি আমার দেহ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবকিছু আগে থাকতেই দান করে রেখেছিলাম। আপনি অর্থবান, প্রভাবশালী। আপনি ক্রমশ সেরে উঠলেন। সবাই খুশীই হলো। কিন্তু তারপর থেকে আমার সমস্যা শুরু হলো।
-কেন?
শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলেন অজয় বসু। তাঁর মনে হচ্ছিল তিনি কোনো রোমাঞ্চ গল্প শুনছেন।
-আপনার শরীরের মধ্যে আমার হার্ট থাকতে পারছে না।
-কেন? আমার শরীরের মধ্যে কি অসুবিধা হচ্ছে?
-আপনার কার্যকলাপ, আপনার চিন্তার সাথে সে একাত্ম হতে পারছে না।
-মানে? আমি ঠিক বুঝলাম না।
-বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। আমি কোনদিন অধর্ম করিনি। মিথ্যা বলিনি। সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। আপনার কাজ ঠিক তার উল্টো।
-ম্ মানে?
-মানে আপনি ব্যবসার আড়ালে যা করেন, যার থেকে প্রকৃত আপনার এতো বাড়বাড়ন্ত, তা আমার হৃদয় মেনে নিতে পারছে না।
অজয় বসু চুপ। ভয়ে তাঁর কথা বন্ধ। এ কে? সত্যিই কি এ মৃত চন্দ্রচূড়? নাকি ব্যবসায় শত্রু কোন দলের গভীর ষড়যন্ত্র!
চন্দ্রচূড় ঠিক তখনই বলে উঠল,
-আমি শত্রু দলের কেউ নই। আমি আপনাকে কোন মিথ্যাও বলছি না। জানেন, মৃতদের আর জীবিতদের জগতের কোনো মিল নেই। এ এক অদ্ভুত অবস্থা। মৃত্যুর পর আমি অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। যেন একটা শূন্যের মধ্যে। আমার বোধ, চেতনা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছিল। একটা পরম শান্তির মধ্যে আমি মিলিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা তীব্র যন্ত্রণা আবার আমাকে সচেতন করে দিল। আপনার কার্যকলাপ, আপনার কথাবার্তা সব আমি বুঝতে শুরু করছিলাম। আমি স্থির থাকতে পারছিলাম না।
-কি সব বলছেন? কি কার্যকলাপ? কি কথাবার্তার কথা বলছেন আপনি?
-মৃদুলা বলে একটি মেয়েকে আপনার নির্দেশে দুদিন আগে..
-চুপ করুন। শাট আপ।
-আপনার ওড়িষ্যাগামী দশটা ট্রাকে...
-কে আপনি? আপনি কি সি আই ডি? পুলিশ? কে আপনি?
-আমি চন্দ্রচূড়। আমার হৃৎপিণ্ড আপনার মধ্যে রয়েছে।
-আমি কি করবো? আমি তো কাউকে বলিনি আপনার হার্ট আমাকে দিতে!
-না। তা আপনি বলেননি। কিন্তু ওটা তো আমার শরীরের অংশ ছিল এতকাল। আমি যা ঠিক মনে করেছি, তাকেই ঠিক বলে ও জানে। আপনার 'ঠিক' এর সাথে ওর মিল হচ্ছে না। আমিও খুব যন্ত্রণা পাচ্ছি।
-আমি বিশ্বাস করি না। আপনি এতো কথা জানলেন কীভাবে আগে সেটা বলুন।
-আপনিই ভেবে দেখুন। এসব কথা কি আর কারো জানবার?
-কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। প্রমোদ? প্রমোদ বলেছে আপনাকে? যাকে আমি নিজের থেকেও বেশী বিশ্বাস করি? দাঁড়ান, আপনি এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবেন না। কিছুতেই না। ছবিলাল... ছবিলাল-
নীচে থেকে দুদ্দার শব্দ করে বন্দুক হাতে ছবিলাল উঠে এলো।
-হুজুর!
-আলো জ্বালাও। শিগগিরই আলো জ্বালাও।
ছবিলাল আলো জ্বালাতেই সুজয় বসু আঙুল তুলে বললেন,
-এই লোকটাকে..
-কোন লোক হুজুর?
ঘরের কোনায় কেউ দাঁড়িয়ে নেই। সুজয় বসু হতভম্বের মতো বললেন,
-লোকটা কোথায় গেল?
-কোন লোক হুজুর?
সেই রাতে প্রচন্ড অসুস্থ অবস্থায় নার্সিং হোমে ভর্তি হলেন সুজয় বসু। যেখানে তাঁর হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়েছিল, সেখানে যেতে রাজী হননি। তাই যে ডাক্তার অপারেশনটি করেছিলেন, তাঁরই ব্যক্তিগত নার্সিং হোমে ব্যবস্থা করা হলো। তিন-চারদিন পরে অবস্থার একটু উন্নতি হল। জ্ঞান হবার পর সুজয় বসুর অদ্ভুত একটা অনুভুতি হলো। তিনি দেখলেন তাঁর উত্তেজনা বা উদ্বেগ কিছুই আর নেই। বেশ শান্ত বোধ করছেন তিনি। নার্স কে বললেন প্রমোদকে খবর দিতে। প্রমোদ অজয় বসুর সর্বক্ষণের সঙ্গী। ব্যবসায় তাঁর ডান হাত বলা যায়। প্রমোদ এলে অজয় বসু তাকে বুঝিয়ে বললেন কোথায় কি করতে হবে।
সাতদিন ধরে নার্সিং হোমের বিছানায় শুয়ে শুয়ে অজয় বসু তাঁর ব্যবসার অন্ধকার দিকগুলো প্রায় সবটাই গুটিয়ে আনার পরিকল্পনা করছিলেন প্রমোদের সঙ্গে। শুরুতে প্রমোদ এসব না করার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি কিছুই শোনেন নি। বলেছিলেন, -এসবে আর মন নেই আমার। অনেক তো হলো।
অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে ধৈর্য ধরে তাঁর কথাই শুনতে হয়েছিল প্রমোদকে। এই সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে রোজ রাতে তিনি চন্দ্রচূড়ের জন্য অপেক্ষায় থাকতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল চন্দ্রচূড় আবার আসবে। কিন্তু সে আসেনি। আর একদিনও আসেনি। চন্দ্রচূড়ের সাথে কথা বলার জন্য মনে মনে রীতিমতো মরিয়া হয়ে পড়লেন অজয় বসু। কথা না বললেই নয়। সেদিন রাত প্রায় আটটা। মৃদু নীল আলো জ্বলছে তাঁর কেবিনে। নার্স ওষুধ খাইয়ে কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। ঘুম আসছে একটু একটু। হঠাৎ চোখে তীব্র আলোর ঝলকানি। বুকে তীব্র ব্যথা। ঘরের কোণায় কে যেন দাঁড়িয়ে। মুখে হাসি। সুন্দর, পবিত্র একটা হাসি। চন্দ্রচূড়? উঠে বসার চেষ্টা করলেন অজয় বসু।
পরদিন সকালে অজয় বসুকে নার্সিং হোমের কেবিনে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। জানা গেল, রাত সাড়ে-আটটার আশেপাশে ঘুমের মধ্যে তাঁর হার্ট-অ্যাটাক হয়। হয়তো মৃত্যুর সময় তেমন কিছু কষ্ট হয়নি ওঁর। কারণ মুখে ছিল তৃপ্তিময় এক অপার্থিব হাসি!
---------------
সোমা চক্রবর্তী।
Kalikapur, Taki road
PO. Barasat, Dist: 24 Pgs (N), WB.