ছোটগল্প।। নিমন্ত্রন ।। বিশ্বনাথ প্রামাণিক
নিমন্ত্রন
বিশ্বনাথ প্রামাণিক
"বিয়ের দিনে সব মেয়েরি দরাজ মন
বিফল প্রেমিক পাবেই পাবে রঙিন খামে
নিমন্ত্রন।।"
কোথায় যেন শুনেছিলাম, আজ আর মনে করতে পারি না। জরায় জরায় আক্রান্ত এই দেহে আর আগের মতো শক্তি নেই। সারাদিন এই একফালি বারান্দায় বসে বই পড়ে নতুবা স্মৃতি রোমান্থনে দিন অতিবাহিত হয়। চোখ বুজলে এখনো যেন দেখতে পাই আমার কৈশোর আর যৌবনের সেই দিনগুলো। সেদিনের কথা ভোলা যায় না। কত শত কথারা ভিড় করে আসে আমার মনের দুয়ারে, তার কুল-কিনারা পাই না। মেঘলা মেদুর বর্ষার মনভারি করা গল্প কথা শুনতে বড় ভালবাসত সে। আজ লিখি মনের খেয়াল খুশি মতো। কোন তাড়া নেই, শেষ করার তাগিদ নেই। কোন জবাবদিহি করাও নেই। তবু লিখি, ভালবেসে লিখি। লিখে আনন্দ পাই তাই লিখি।
আজ কিছুতেই কলম ধরতে ইচ্ছা করছে না। সকাল থেকে সমানে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। এর যেন আর থামবার কোন ইচ্ছাই নেই। মাথার পিছনে দু’হাত রেখে ইজিচেয়ারে আধ শোয়া ভাবে বসে ক্রমাগত বৃষ্টির আওয়াজ শুনে চলেছি। হঠাৎ মনে হল এ তো জলের শব্দ নয়, যেন নপুরের নিক্কন ধ্বনি। আর তখনি আমার স্মৃতির আকাশ জুড়ে মেঘেদের সে কি গর্জন! আমি দু হাতে কান চেপে ধরি। না কিছুতেই সে আওয়াজ কমছে না। না পারি আমি তাকে সহ্য করতে, না পারি এড়াতে! চোখ বন্ধ করতেই ঝর ঝর করে এক পশলা বৃষ্টি আমার বুক ভাসিয়ে নেমে এল। মনে হল কত দিনের অভিমান জল হয়ে আজ ঝরে পড়ছে। পড়ুক, বৃষ্টি ঝরে গেলে আকাশ নির্মল হয়ে রোদ উঠবে আবার শরতের মতো। কিন্তু আজিকার এ দিন যে আমার বড় চেনা। এমনি এক দিনের কথা আজ বড্ড মনে পড়ছে।
সেদিনটাও ছিল গ্রাম বাঙলার আর পাঁচটা বর্ষার দিনের মতো। চির চেনা কাদা প্যাচপ্যাচে বৃষ্টি ভেজা শ্রাবনের সকাল। তখন গ্রামে গ্রামে সবে চাষের কাজ শুরু হয়েছে। সকাল সকাল ঘুম থকে উঠেই আমিও আমাদের জমিতে বীজতলা রোপণের কাজে বেরিয়ে পড়ি। পরনের লুঙ্গিটা ভাঁজ করে কোমরে বেঁধে নিয়ে ও পুরানো আটপৌরে একটি জামা গায়ে গলিয়ে বৃষ্টির জল মাথায় করে ভিজতে ভিজতে চলেছি চাষের কাজে- (পড়াশোনার সঙ্গে গ্রামের প্রায় সব ছেলেদেরি নিজেদের জমির চাষের কাজে নামতে হয়। এতে লজ্জা বা অপমানের বলে কোনদিন মনে হয়নি)। প্রয়োজন মতো (আমার সাধ্য-অনুযায়ী) বীজতলা ভেঙে সাজিয়ে গুছিয়ে কাঁচা তালপাতার পাকানো দড়িতে কষে বেঁধে মাথায় তুলে নিয়ে চলেছি অনেক দুরের একটি জমিতে। অনেকটা পথ হেঁটে যাওয়ার পরেও প্রায় বিশ ফুট চওড়া একটি খাল সাঁতরে পার হতে হয়। আমরা বলি পাচবিঘের দাগ। বর্ষার জলে টইটম্বুর খালটা যেন কেউটে সাপের মতো ভয়ংকর মনে হয়। আশে-পাশে জনমনিশ্যি কেউ কোথাও নেই। ভিজে হাওয়ায় গা শির শির করে উঠে। খালের জলে সেই বীজতলা ভাসিয়ে দিয়ে ঠেলে ঠেলে সাঁতরে পার হতে হয়।
সকাল থেকে আজ মনটা বর্ষার বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেমন উদাস খেয়ালে ভেসে চলেছে। কি এক বিসন্নতায় আনমনা আমি। তখন সদ্য কৈশোর পার হয়ে যৌবনে পা দিয়েছি। মনে হাজারো অনুভুতির রঙিন পাখনা মেলা পাখির কলতান শুনতে পাই। শুনতে পাই আরও একজনের করুন স্নেহ মাখা প্রেমানুভুতির নিক্কন ধ্বনি। রাতদিন মনের মধ্যে সেই আওয়াজ বাজতে থাকে। ঘুরতে-ফিরতে, উঠতে-বসতে, খেলতে বা পড়তে সে ধ্বনি আমার পিছু ছাড়ে না।
সে দিনও তার অন্যথা হয় নি। মন যেন কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কতদিন তাকে দেখিনি। কলেজ ছুটির দীর্ঘ অদর্শন জনিত মানসিক যন্ত্রণা কি আমাকে তখন কুরে কুরে খাচ্ছিল? বর্ষার জলে ভেজা পাখির মতো, মনের পালক বিছায়ে নিজের অনুভুতির শিশুকে সযত্নে লালন করতাম- গোপনে। পাছে তার গায়ে সামান্যতম বৃষ্টির ছাঁট না লাগে- সেদিকে আমার পাহারাদার মন সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখত। বিশেষত মা আর বউদির নজর এড়ানো ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছিল।
আজ মনটা বারবার ছুটে যেতে চাইছিল তার কাছে। কাজের মধ্যে বারে বারে আনমনা হয়ে পড়ছিলাম। মন বারবার বলছিল আজ যেন নিশ্চয়ই তাকে দেখতে পাবো। কীভাবে, কখন, কেন কিছু জানিনা। ক্ষেতের কাজে আমার যখন খুব কষ্ট হতো আনমনা এই ভাবনায় সে কষ্ট লাঘব হয়ে যেত বেশ বুঝতে পারতাম। কাদাজল বৃষ্টি মাখামাখি আমি বীজ ধানের চারা রোপণ করতে করতে হারিয়ে যাই মান অভিমান, পাওয়া না পাওয়ার যন্ত্রনাহত ভয়ংকর এক খেলায়। চোখের সামনে দেখতে পেতাম আমার পাশে বসে সেও আমার হাতের আঙ্গুল গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ছল ছল চোখে চেয়ে আছে। অভিমানী সেই চোখ, সেই যন্ত্রণাদগ্ধ মুখ আমি কোনদিনও ভুলিনি। আমাদের মিলন ছিল বিরহের রসে স্নিগ্ধ। পাওয়ার থেকে হারানোর ভয় ছিল বিস্তর। যার জন্য প্রেমের আকর্ষণ ছিল দুর্নিবার। হয়তো সেই জন্য মনটা এমন বিষণ্ণতায় মাখা বর্ষার মেঘ হয়ে থাকত সব সময়। একা থাকতে ভালো লাগতো আমার। একা একা ভাবতে বেশ লাগত। কাজ সেরে বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল বিস্তর। কেন জানিনা সেদিন বারবার মনে হচ্ছিল সে নিশ্চয়ই আসবে। আমার ঘর আলো করে আমার জন্য প্রতীক্ষা করছে হয়ত বা।
প্রকৃতির খেয়াল বোঝা বড় দায়। কখনো বা দুপুরের ভাঙ্গা ভাঙ্গা কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্য উঁকি দিচ্ছে, আবার পরক্ষণেই সেই জলভরা মেঘ তার মুখ ঢেকে শয়তানি খেলায় মেতে উঠছে। কখনো মেঘ ভাঙা বৃষ্টি, আবার কখনো বা ঝলমলে রোদ্দু্র। তারই নীচে আমি মাথা নিচু করে কোমর বাঁকিয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে একমনে ধানের বীজতলা রোপণ করে চলেছি। পাশের জমিতে এরশাদ দাদা দুটো বলদ জুড়ে লাঙ্গল ঠেলতে ঠেলতে ক্রমাগত হেট হেট করে তাড়া দিচ্ছে, আর মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে গল্প জমানোর বৃথা চেষ্টা করে চলেছে। আমার মন তখন স্মৃতি রোমন্থনেই বেশি আনন্দ পাচ্ছিল। চাষের কষ্টকর এই বিরক্তিময় যন্ত্রণা লাঘব হতো আমার এই ওষুধে। সে আর এরশাদ দাদা কেমন করে জানবে? আমার দিক দিয়ে কোন উৎসাহ না পেয়ে একসময় সেও থেমে যায়। জমিতে এক মনে লাঙ্গল ঠেলতে থাকে সে- হেট হেট হেই…
দেখতে দেখতে বেলা বাড়তে থাকে। বাড়িতে জানিয়ে এসেছিলাম তাড়াতাড়ি ফিরব। সে আর হল কই? হাত চালাতে থাকি দ্রুত। এবার ফিরতে হবে যেমন করেই হোক। সমস্ত কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। এখন আর বৃষ্টি পড়ছে না। মেঘের ফাঁক দিয়ে অপরাহ্ণের সূর্য উঁকি দিচ্ছে। খালের দুপাশে গাছেরা ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ। ওদের এই মৌনতা আর খালের জলের স্রোতে ভেসে আসা কচুরি পানার চুপি চুপি চলে যাওয়া দেখতে দেখতে এক মুহূর্তে আমার বুকটা যেন কেঁপে উঠল। তবু মনে জোর এনে খালের পাড়ে শুয়ে পড়া তে-পলতে গাছটার ডাল বেয়ে নেমে আসি আমি। সেই ভয়ংকর নির্জন খালের জলে গা ভাসিয়ে দিই। জলটা বেশ গরম। আমার আরাম লাগছিল খুব। ধীরে ধীরে সাঁতরে পার হয়ে যখন বাড়ি ফিরে আসি, তখনো বিকেলের আলো ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের ঘরের পিছনে তেঁতুল গাছটার মাথার উপর।
চমকে উঠি। আমার পড়ার ঘরে ও কে বসে আছে! বুকের ভেতর মুহূর্তে হাজার বিদ্যুৎ ঝলকের সেই শিহরণ আমার সারা মন তড়িতাহত করে দিয়ে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। ইচ্ছা করছিল ছুটে গিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি ওকে। কিন্তু আমি সে সব কিছুই করতে পারিনি। আবেগ সামলে নিয়ে ভালো মানুষের মতো মা বৌদির সন্ধিগ্ধ চোখকে ফাঁকি দিয়ে বলে উঠলাম – কি রে তুই কখন এসেছিস?
-এই তো ঘন্টা খানেক। যা তুই আগে চান করে খেয়ে নে তারপর……
-বেশ তো। বস, আমি আসছি।
দুপা বাড়ালেই আমাদের স্নানের ঘাট। নির্মল হিমশীতল পুকুরের জলে ডুব দিয়ে ঘসে ঘসে গায়ের কাদামাটি ধুয়ে ফেলতে থাকি। কেন জানি না সেই জলের নিচের অন্ধকার দেশ আমায় টানছিল খুব। সেদিন হারিয়ে যেতে চাইছিলাম খুব। মনে হচ্ছিল আমি ফিরলে সে যে আবার ফিরে যাবে। আর আমি যদি আর কখনো না ফিরি তাহলে আমার জন্য প্রতীক্ষায় বসে থাকবে সেও। আর সেজন্য জলের নিচের সেই অন্ধকার দেশ ছিল আমার জন্য সব থেকে ভালো। মন ভরে জলে সাঁতার কাঠছিলাম, ঢুবছিলাম, ভাসছিলাম। অপরাহ্ণের নির্জন পুকুর ঘাট আমার ক্ষ্যাপামিতে হয়ত চমকে উঠেছিল। সে দিন এক অদ্ভুত আনন্দে মনটা নেচে উঠলো। ভুলে গিয়েছিলাম জঠরাগ্নির যন্ত্রণা।
তারপর বাড়ি ফিরে চলনসই শুকনো জামাকাপড় পড়ে, খাওয়া সেরে ভাল মানুষটির মতো তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাশে বসলাম। দুজনে গল্প হল কত। মনে হল আমার অপরাহ্ণের আকাশ আলোয় আলোয় ভরে দিয়েছে কেউ।
বাইরে অন্ধকার করে সন্ধ্যা নেমে আসছে দ্রুত।
ও এবার ফিরতে চাইছিল, অনেকটা পথ ফিরতে হবে
ওর। আমি আর আপত্তি করতে পারিনি। সেই দুপুর থেকে ও আমার অপেক্ষায় বসে। বলে রাখি আপনাদের
(ও মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়িতে আসতো, আমিও যেতাম
ওদের বাড়িতে। এ নিয়ে আমাদের দুই বাড়ির মধ্যে কোন আপত্তি ছিল না)।
আজ কিছুতেই আমার মন চাইছিল না ওকে ছাড়তে।
তবু তো ছাড়তে হলো। ফেরার সময় একটা চিঠি ভরা রঙিন খাম আমার হাতে দিয়ে বলল - আমি চলে যাওয়ার
পর খুলিস।
-কি আছে এখানে?
-এখন নয়। পরে…
-বেশ।
ওকে বড় রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে গাড়িতে তুলে বাড়ির পথে রওনা করে দিয়ে ফিরে আসি। আমার কৌতুহল যেন আর কিছুতেই বাঁধ মানতে চাইছিল না। ঘরের আলো জ্বেলে সবে চিঠিখানা খুলবো বৌদি এসে সামনে দাঁড়ালে, মৃদু হেসে জানতে চাইলে- কবে?
আমি চমকে উঠে বললাম- কি?
-বিয়ে ।
-মানে…
-মানে সুমনার বিয়ে কবে?
আমার মুখে কথা সরে না। ফ্যাল ফ্যাল করে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম সেদিন। তারপর হাতে ধরা খামখানা নিয়ে আনমনে নাড়াচাড়া করতে করতে বলেছিলাম- জানি না। মানে এখনও জানা হয়নি।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
------------
৯/৭/২১
সকাল
সোনারপুর।
খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন