Click the image to explore all Offers

ভ্রমণালেখ্য।। এবং মাদারিহাট ।। শংকর লাল সরকার


এবং মাদারিহাট

 শংকর লাল সরকার 

 

ঘন জঙ্গল, চা বাগান, নদী আর দূর দিগন্তে নীল পাহাড়ের উদ্ভাস--সমগ্র ডুয়ার্স প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকের স্বর্গরাজ্য। অরণ্য আর চা বাগানের আনাচে-কানাচে অথবা কোন নদীর ধারে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লেই মনে হবে এটা কোন অপরূপ ট্যুরিস্ট স্পট। কটা দিন কাটানো যায় সবুজ প্রকৃতি, চেনা অচেনা অসংখ্য পাখি আর বন্যজন্তুদের সাহচর্যে। পশ্চিমে তিস্তা থেকে পূর্বে সঙ্কোশ নদী, তোর্ষা, রায়ডাক, কালজানি, মূর্তি, জয়ন্তী ছাড়াও অসংখ্য ছোট ছোট ঝোরা বয়ে চলেছে লাস্যময়ী ডুয়ার্সের উপর দিয়ে। গরুমারা-চাপড়ামারি-জলদাপাড়া তিন অভয়ারণ্য আরও মোহময়ী করে তুলেছে ডুয়ার্সকে। এবারে আমাদের গন্তব্য জলদাপাড়া, ঘুরব মাদারিহাটকে কেন্দ্র করে।    

জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের ঠিক মাঝখান দিয়ে তোর্ষা নদী বয়ে গেছে। বিস্তীর্ণ অরণ্যের একটা অংশের নাম চিলাপাতার জঙ্গল। কোদালবস্তি গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম আদিম সেই ঘন অরণ্যে। বর্ষার জলে ধোয়া ঘন সবুজ জঙ্গল। চারদিকে সবুজ, সবুজ আর সবুজ। সবুজের যে কত রকমফের! আকাশের দিকে চাইতে দেখলাম পাতার জালি কাজ করা অপূর্ব সুন্দর কারুকার্য। চলতে চলতে একদিকে চাইলে মনে হয় আর একদিকের দৃশ্য বুঝি দেখা হল না! এককালে এখানে লোকবসতি ছিল। তারই সাক্ষ্য বহন করছে নল রাজার গড়। ঐতিহাসিকদের মতে বানিয়া নদীর তীরে এই গড়টি তৈরী হয়েছিল গুপ্তযুগে। আবার কিংবদন্তি অনুসারে জড়িয়ে আছে নল-দময়ন্তীর কথাও। জঙ্গলে ঢাকা ইটের দুটো বড়ো বড়ো খিলান আর খানিকটা ইটের প্রাচীর ছাড়া আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমাদের স্বাগত জানাল কয়েকটা ময়ূর আর বন মুরগীদূর থেকে দেখলাম একটা বার্কিং ডিয়ারকে। তবে চোখে দেখে নয় আওয়াজেই চিনলাম।

বিখ্যাত হলং বন বাংলোয় জায়গা হল না। আসলে অনেক দিন আগে থাকতে বুকিং না করলে হলংতে রাত কাটানোর দুরাশা না করাই ভালো। অনেক বলে কয়ে হাতি-সাফারির বুকিং জোগাড় করলাম। মাদারিহাটের অন্য একটা হোটেলে রাত কাটিয়ে সকালেই চলে আসব।    

রাত থেকে মুসলধারে বৃষ্টি নামল। ভাবলাম বৃষ্টি থামবে তো? কাল যে আমাদের জঙ্গলে হাতি-সাফারি বুক করা আছে। অনেক কষ্টে জোগাড় করা টিকিট। সারারাত ধরে আমাদের আশঙ্কা বাড়িয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে চলল। বৃষ্টির কী বেগ! উত্তরবঙ্গের বৃষ্টির অভিজ্ঞতা বোধহয় রবীন্দ্রনাথের ছিল না তাহলে মেঘমল্লার না হয়ে হত মেঘমুষল! আমাদের ভাগ্য বলতে হবে, বৃষ্টি থামল ভোর সাড়ে পাঁচটার সময়ে; রিপোটিং টাইম সকাল সাতটায়। হলং বাংলোয় আধঘন্টা আগে পৌছে শুনলাম আমাদের ট্রিপের দেরী আছে। বৃষ্টির জন্য সকালের প্রথম ট্রিপ শুরু হতেই অনেক দেরী হয়েছে।

হলং বাংলোর সামনের প্রশস্ত প্রাঙ্গনের মধ্যে বসলাম। সামনে দিয়ে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে ছোট্ট হলং নদী। ওপারের সল্টলিকের আশপাশে তখন কয়েকটা ময়ূর ঘোরাঘুরি করছে। পায়রা-ঘুঘু -ছাতারে-টিয়া হরেক রকমের পাখপাখালির সরব চিৎকারের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ধনেশ পাখির উড়ার আশ্চর্য বন্ বন্ সুরমুর্ছনা। দূর থেকে আলাদা করে চেনার উপায় নেই আমাদের সচকিত করে মাঝেমধ্যে সামনে দিয়ে এক আধবার উড়ে যাচ্ছিলঅনেকক্ষনের চেষ্টায় একটা ধনেশ পাখিকে ক্যামেরার মেগাপিক্সেলে বন্দী করলাম।

ঘন্টা দেড়েক সময় কোথা দিয়ে যে কেটে গেল বুঝতে পারলাম না। সকাল সাড়ে আটটায় শুরু হল আমাদের হাতি সাফারি। হলং নদী পেরিয়ে ঘন জঙ্গল আর কাদা মাটি মাড়িয়ে দুলকি চালে হাতি এগোতে লাগল। জঙ্গলকে গভীর ভাবে উপভোগ করার জন্য সবথেকে ভালো হাতির পিঠে চেপে ঘোরা। জঙ্গল যেন নিবিড় করে আমাদের জড়িয়ে ধরল। গাছের ডাল পাতা সরিয়ে সরিয়ে এগোচ্ছি। গাইডের দৃষ্টি অনুসরন করে একজায়গায় দেখলাম বিশাল বড়ো একটা গণ্ডার। গাছপালার আড়ালে কালো শরীরটা লুকিয়ে আপন মনে চরে বেড়াচ্ছে। হাতি কাছাকাছি আসতেই আড়াল থেকে বেরিয়ে একদম আমাদের সামনে। কিছুতেই জায়গা ছেড়ে নড়বে না ছবির জন্য পোজ দিয়েই দাঁড়াল বোধ হয় জঙ্গলের মধ্যে আর একটা গণ্ডার দেখলাম। গাছপালার মধ্যে নিশ্চিন্তে বসে ছিল। আমাদের দু'তিনটে হাতি কাছাকাছি আসতে বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়াল।

জঙ্গল সাফারি করতে করতে একটা কথা কেবলই মনে হচ্ছে। পর্যটকরা নিজেদের আমোদের জন্য বন্যজীবদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধার সৃষ্টি করে। আমাদের ক্যামেরায় বন্দী হবে বলেই যেন ওরা জীবনধারন করে। ফিরতি পথে দেখলাম একটা বার্কিং ডিয়ার দূর থেকে আমাদের লক্ষ করছে। অপেক্ষা করছে কখন আমরা চলে যাব, ও নিশ্চিন্তে দুটো ঘাস খেতে পারবে। একটু দাঁড়িয়েছি ওমনি ডাকতে ডাকতে ঢুকে পড়ল ঝোপঝাড়ের আড়ালে।


 

সকালে হলংতে জঙ্গল সাফারি করে হোটেলে বিশ্রাম। বিকালে গাড়ি করে রওনা হলাম দক্ষিন খয়েরবাড়ি। বাঘ চিতাবাঘদের রেসকিউ সেন্টার। বাংলায় বলা যায় উদ্ধার আশ্রম। জঙ্গল ছেড়ে যেসব চিতাবাঘ বা বাঘ লোকালয়ে চলে আসে তাদের ধরে এনে এখানে রাখা হয়। মানুষের হিংস্রতায় অনেক বাঘ জখম হয়। জঙ্গলের কঠিন জীবনে তখন আর তারা মানিয়ে নিতে পারে না। হয়ে পড়ে মানুষখেকো। অথবা সেই সব অনাথ বাঘের বাচ্ছা যাদের মা হয়তো কোন চোরা শিকারীর হাতে মারা পড়েছে।

দক্ষিন খয়েরবাড়িতে পরিচয় হল পার্থ সিনহা নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। কলকাতার বাসিন্দা, কর্মসূত্রে এখানকার বিট অফিসার। উনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন উদ্ধার আশ্রমের বাঘ চিতাবাঘদের সঙ্গে। বড়োসড়ো চেহারার একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে দেখলাম, পিছনের ডান পা টা হাটুর নীচ থেকে কাটা। সুন্দরবনের এই বাসিন্দা চোরা শিকারীর পাতা ফাঁদে আটকা পড়েছিল। এতটাই শক্তিমান যে পিছনের পা ছিঁড়ে পালিয়ে এসেছিল। পা কেটে যাওয়ায় স্বভাবতই শিকারে অক্ষম হয়ে পড়ে। হয়ে উঠে আদমখোর। এমনই বুদ্ধিমান জানোয়ার যে গ্রামের কাছে এসে হুঙ্কার ছাড়ত। গ্রামের লোকজন তখন ছুটে যেত বাঘ তাড়াতে। সেই অবসরে ও অন্যদিক থেকে এসে হামলা চালাত। পার্থবাবুর মুখে ওর গল্প শুনছিলাম আর মনেমনে তারিফ করছিলাম ওর সাহস, বুদ্ধি আর শক্তির।

পার্থবাবু দুটো চিতা বাঘ দেখালেন। ওদের নাম রাখা হয়েছে শচিন সৌরভ। যখন এতটুকু তখন এসেছিল উদ্ধার আশ্রমে। ফিডিং বোতলে ওদের দুধ খাওয়ানোর ছবি দেখালেন আমাদের। এখন ওরা তেইশ বছরের পূর্ণ যুবক। শীঘ্রই জঙ্গলে ছাড়া হবে। এক একটা খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে পার্থবাবু আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন, মোহন, মিঠু এ রকম সব নাম ধরে ডাকছিলেন। একএকজনের এক এক ইতিহাস, এক এক রকমের চরিত্র


বাঘের কানের পিছনের দিকের দুটো ব্যাক আই আমাদের দেখালেন উনি। কালো বর্ডার দেওয়া সাদা চোখের মতো। জঙ্গলের মধ্যে ওই ব্যাক আই দেখেই বাঘের উপস্থিতির কথা জানতে পারা যায়। পার্কের মধ্যেই বেশ খানিকটা বিস্তৃত জঙ্গলকে ঘিরে রাখা হয়েছে মেঘলা চিতাবাঘদের জন্য। অরুনাচলের নামদাফা থেকে মেঘলা চিতাবাঘ এনে প্রজননের ব্যবস্থা করা হয়েছেসংখ্যা বাড়িয়ে তারপর ছাড়া হবে জঙ্গলে

ফালাকাটা ব্লকের মধ্যে খয়েরবাড়ির পার্কটি বেশ সুন্দর। পর্যটকদের সুবিধার জন্য সবরকম ব্যবস্থা আছে। একরাত কাটাতে পারলে সেটা হয়ে উঠতে পারে পর্যটক জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। পার্থবাবু বলছিলেন নদী পেরিয়ে বন্য হাতিরা হরদম পার্কের মধ্যে চলে আসে। গত বছর বর্ষায় খুব জল বেড়ে গিয়েছিল। হাতিরা সে সময়ে সাঁতরে নদী পার হয়ে পার্কের মধ্যে চলে আসে। শুড়ে করে পার্কের বসার আসনগুলো সব ভেঙে ফেলেছিল। সেগুলোকে আবার নতুন করে তৈরী করতে হয়েছে।

খয়েরবাড়ি থেকে যখন মাদারিহাটের দিকে রওনা দিলাম বাইরে মুসলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ঘন সবুজ জঙ্গলের বুক চিরে এঁকেবেঁকে বিশাল এক ময়াল সাপের মত চলে গেছে কালো পিচের রাস্তা। গাড়ির কাঁচের ভিতর দিয়ে জঙ্গলের জলছবি দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। এবারের মতো ডুয়ার্সকে বিদায়। তবে একবার যে এই সৌন্দর্যে মজেছে তাকে তো ফিরে ফিরে আসতেই হবে।

 

------------------------------ 

শংকর লাল সরকার। 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.