রমলা মুখার্জী
ক্রিং, ক্রিং, ক্রিং- 'ফোনটা ধর গো, যা কষ্ট পাচ্ছে, ছেলেমেয়ে যা হয় হোক," বলেন রাধাশ্যামবাবু।
'তোমার ছেলে যা বাড়াবাড়ি করছে, মনে হচ্ছে যেন ছেলেটা তারই হবে।' বলতে বলতে ফোনটা ধরতে উঠলেন দুর্গাদেবী।
'কি হল? কথা বলছ না কেন? কার ফোন? ছোট বৌমা ভাল আছে তো?' উদ্বিগ্ন হয়ে রাধাশ্যামবাবু জিজ্ঞেস করেন।
'মেয়ে হয়েছে অরূপের', নিরুৎসাহ গলায় দুর্গাদেবী বলেন।
'ওরে, শাঁখ বাজা, শাঁখ বাজা,' মহানন্দে বলেন রাধাশ্যামবাবু।
'আদিখ্যেতা, মেয়ে হয়েছে তাতে আবার শাঁখ বাজানো, জন্মে শুনিনি বাপু।' ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন দুর্গাদেবী।
'এখন তো মেয়েদের জয় গো। আর তুমি নিজে মেয়ে হয়ে কন্যা সন্তান জন্মানোটা পছন্দ করছ না'?
'নিজে মেয়ে বলেই তো মেয়েদের যন্ত্রণাটা বুঝি। যতই জয় জয়কার কর বিয়ে দেবার সময় ঠিক একগাদা টাকার শ্রাদ্ধ, দশবার দেখতে এসে নাজেহাল করা'।
'আরে আমি ওসব ভেবে শাঁখ বাজাতে বলিনি'।
'তবে কি ভেবে একেবারে খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলে শুনি?'
'চোখের সামনে ভেসে উঠল রবীন্দ্রসদনে দেখা ছোট বৌমার নাচের অনুষ্ঠানটা। সত্যি অপূর্ব! তার যদি কিছুটাও মেয়েকে শেখাতে পারে…'
'কি মেয়ে হয়ে নাচবে? ওসব বাঈজীপনা এ বাড়িতে চলবে না।'
'তোমার এই হীনমন্যতার জন্যে তুমি ছোট বৌমার জীবনটা নষ্ট করেছো, দয়া করে আর তার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করো না। ভাবতেও খারাপ লাগে ওর ঐ নাচ দেখেই মুগ্ধ হয়ে অরূপ ওকে বিয়ে করেছিল।'
'থাক, থাক আর ছোট বৌমার গুণকীর্তন করতে হবে না। তা, আলমারী খুলে কি বার করছ শুনি?'
'সেই আমার জামাই আশীর্বাদের সোনার হারটা- সেটা দিয়েই দিদি-ভাইয়ের মুখ দেখে আসি।'
'নাতনী হয়ে যে একেবারে আহ্লাদে মাটিতে পা পড়ছে না, ওকে সোনা দিয়ে মুখ দেখবেন, ভবিষ্যতে নাকি বিরাট নাচিয়ে করে তুলবেন, মরে যাই আর কি!'
কিন্তু রূপসীকে নিয়ে শ্রেয়সী যখন বাড়ি এল তখন সুন্দরী নাতনীকে দেখে দুর্গাদেবী সব ভুলে গেলেন, দিনরাত নাতনীকে নিয়েই ব্যস্ত।
'কি গো? খুব তো নাতনী হয়েছে বলে মনে দুঃখ হয়েছিল, এবার নাতনীকে নিয়ে সব সময় কে বসে থাকে শুনি?'
'তা কেমন নাতনী দেখতে হবে তো। একবারে রূপে আলো করা, তোমার দেওয়া রূপসী নামটা সব দিক দিয়েই বেশ মানানসই হয়েছে।'
'যেমন তোমার নামটা তোমার রূপের সাথে মানিয়েছে।'
'আর বুড়ো হয়ে মরতে চললাম, এখন আবার রূপ।'
'তা তোমার রূপের ছটাই তো রূপার ওপর পড়েছে। তাই তো ছেলে-বৌ এর সঙ্গে মিলিয়ে ঐ নামকরণ'- সহাস্যে বলেন রাধাশ্যামবাবু।
সাহিত্যের শিক্ষক রাধাশ্যামবাবু পাড়ার সদ্যোজাত শিশু থেকে সদ্যোজাত দোকান সবারই সুন্দর নাম দেন। উদার স্বভাবের এই মানুষটিকে সবাই ভালবাসে।
রূপসী যত বড় হয় ততই যেন রূপ উপচে পড়ে, খুব তার স্মরণ শক্তি। ঠাকুমার মুখে ছড়া একবার শুনেই বেশ মনে রাখে। অরূপ-শ্রেয়সীর খুব ইচ্ছে মেয়ে পড়াশোনার সাথে নাচও শিখুক। সবাইকার অনুরোধে দুর্গাদেবীও আর না করলেন না।
কিন্তু হায়! শ্রেয়সী শত চেষ্টা করেও রূপসীকে নাচ শেখাতে পারছে না। ঘরকুনো মেয়ে বই নিয়ে থাকতেই বেশি ভালবাসে। দুর্গাদেবী তো একদিন শ্রেয়সীকে বলেই ফেললেন, "রূপা শিখতে পারছে না, না তুমিই ওকে শেখাতে পারছ না।" শ্রেয়সীও অত সহজে হাল ছাড়তে চাইল না, তাই সে বলল, 'পাড়ার অনেকেই তো আমার কাছে নাচ শিখতে চায়, আপনি যদি মা অনুমতি দেন তাহলে ওদের সঙ্গে রূপাকে শেখাই, একা একা নাচ করতে হয়তো ওর ভাল লাগে না।' অগত্যা নাতনীর জন্যে দুর্গাদেবীর আর রাজী না হয়ে উপায় কি!
পাড়ার সব মেয়ে নাচ শিখে যায়, কিন্তু রূপসীর সবার সামনে এলেই পা জড়িয়ে যায়, আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই রূপসীকে নাচ শেখানো গেল না। অরূপ শ্রেয়সীকে বলল, 'শ্রেয়া এবার রূপাকে ছেড়ে দাও, নাচ ওর হবে না'। শ্রেয়সীও বুঝতে পেরেছিল রূপসীর নাচে মোটেই ঝোঁক নেই কিন্তু ওর বাবার মত রূপসীর ঝোঁক লেখাপড়ায়। অরূপ পদার্থবিদ্যায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ডক্টরেট করে কলেজে পড়ায়। তবে শ্রেয়সীর একটা লাভ হল তার নাচের স্কুলের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল, কারণ সে প্রমাণ করেছিল সে নিজেই শুধু ভাল নাচতে পারে না, ভাল নাচ শেখাতেও পারে। এখন তার প্রচুর ছাত্রছাত্রী, বহু জায়গায় বহু অনুষ্ঠান, একবারে হিমসিম অবস্থা।
# # #
এভাবে দেখতে দেখতে দশটা বছর কাটল। শ্রেয়সীর দ্বিতীয় সন্তান আসছে। সবাই বলে, 'মেয়েই হোক'। নাচের স্কুলটার হাল ধরবে কে? শ্রেয়সীর তো বয়স বাড়ছে। শাশুড়িকে মাস গেলে শ্রেয়সী ভালই হাতে তুলে দেয়, দুর্গাদেবীও এখন বুঝতে পারছেন কন্যা সন্তানও সন্তান।
শ্রেয়সীর হল পুত্র সন্তান। মেয়ের কোলে ছেলে যতটা খুশি হওয়ার কথা ততটা খুশির হাওয়া বইল না। তবু ছেলে তো ঘটা করেই অন্নপ্রাশন হল। সবাই বলে গেল, 'মেয়ে হলে কাজে দিত। মায়ের অত বড় নাচের স্কুলটা ধরে রাখতে পারত। প্রথমটার তো নাচ হল না।'
আর নাম মিলিয়ে কে নাম রাখছে? শ্রাবণ মাসে হয়েছে আর দিন রাত কাঁদে, রাধাশ্যামবাবু নাম রাখলেন শ্রাবণ। রোগাটে শ্রাবণ তাড়াতাড়ি হাঁটতে শেখে, তীরবেগে দৌড়তে আরম্ভ করে। ওমা শ্রাবণ যে ছুটে খালি মায়ের নাচের ঘরে ঢুকে পড়ে। ভারি দুষ্টু তো! না ঢুকতে দিলেই কেঁদে রসাতল। অগত্যা দুর্গাদেবী নাতিকে কোলে নিয়ে নাচের ঘরে একপাশে গিয়ে বসে থাকেন। নাচ দেখলেই শ্রাবণ চুপ করে যায়। বছর তিনেকের শ্রাবণ বেশ তালে তালে পা ফেলে। ওমা দেখ কাণ্ড! চার বছরের শ্রাবণ যে ভারতনাট্যমের কটা আডাউ তুলে ফেলল স্রেফ দেখে দেখে। শ্রেয়সী বুঝল তার ছেলের নাচে দারুণ ঝোঁক। প্রবণতা না থাকলে জোর করে কোন জিনিস শেখানো যায়না। তাই শ্রেয়সী সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে শ্রাবণকে নৃত্য শিক্ষা দিতে লাগল। অতি অল্প বয়েসেই শ্রাবণ নাচের অনেক শক্ত মুদ্রা, তাল অনায়াসেই আয়ত্ত করতে পারল। শ্রেয়সীও শ্রাবণকে নিয়ে নিয়মিত যেতে লাগল বড় বড় নৃত্যশিল্পীদের কাছে তালিম নিতে।
আজকে শ্রাবণ সেন একজন সার্থক নৃত্যশিল্পী। দেশে বিদেশে তার খ্যাতি। রূপসীও মস্ত ইঞ্জিনিয়ার, জলসেচ বিভাগের পদস্থ অফিসার। মুমূর্ষু দুর্গাদেবী মৃত্যুশয্যায় শুয়ে ভাবতে থাকেন, "সে যুগের থেকে এ যুগই ভাল, এ জন্মে তো আমার কিছুই হল না! ভগবান, পরের জন্মে ছেলেমেয়ে যাই হই না কেন বিরাট প্রতিভা নিয়ে যেন জন্মাই, আর আমার প্রবণতা যেদিকে, সেদিকে যেন এগিয়ে যেতে পারি, সে পরিবেশ আমাকে ঈশ্বর তুমি দিও।" দু ফোঁটা জল গাল বেয়ে তাঁর নেমে আসে।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
--------------------------------------
ডঃ রমলা মুখার্জী
বৈঁচী, বিবেকানন্দপল্লী, জেলা হুগলী।