পর্ণা বসু
তুলসী তলায় প্রদীপ দেখিয়ে ঘরে এসে ঠাকুরের সামনে শাঁখ বাজিয়ে ঘর গুলোতে ধূপ দেখাতে লাগল অসীমা। শাশুড়ি মার ঘরে আসতে ই উমা দেবী বলেন,"বৌমা তুমি লাল পাড় সাদা শাড়িতে যেন সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী"।
অসীমা অল্প হেসে নিজের ঘরে ফিরে আসে।
তিন জনের সংসারে যা কাজ তা তার সকালে সারা হয়ে যায়। কোথাও সে বেরোয় না বাড়ি থেকে,গ্ৰামের লোকজন তাকে দিনের আলোয় খুব কমই দেখেছে। বাড়ির বাইরে সে কারো সাথেই কোন কথা বলে না। উমা দেবী প্রথমে অবাক হলেও ভেবেছেন এই ভালো বাইরে পরচর্চা - পরনিন্দা না করে ঘরোয়া বৌ হয়ে থাকুক।
সুজয় এখনো ফেরেনি,এই চাঁপাডাঙা খুবই প্রত্যন্ত গ্ৰাম।এখান থেকে প্রায় এক ঘন্টা সাইকেল করে গিয়ে তবে স্টেশনে ট্রেন ধরে কলকাতা যেতে হয় সুজয় কে।তার আসার সময় হলে অসীমা চা বসায়।
( ২)
আলোর রোশনাই, তবলার আর তানপুরার আওয়াজ ,আতরের গন্ধে মাতোয়ারা চারদিক। ঝাঁ চকচকে শহরের একপ্রান্তে এই অন্ধকার অংশ রাত বাড়ার সাথে সাথে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে।আর বিশেষ একটি ঘরে যেন সবার আনাগোনা বেশি। অন্য সব ঘরে এ ঘরের মতো সুরে র ঝংকার ওঠে না।এ ঘরের রোশনি বাঈ এর গলায় যেন সরস্বতীর বাস।যেমন গজল, ঠুমরী গায়, তেমনি বাংলা আধুনিক গান। তখন যে যুবক রা ভিড় জমাতো তার ঘরে তারা ঐ সব কলের গান শুনতে পছন্দ করতো।
আজ যেন সুরের মূর্ছনায় ঘর মেতে উঠেছে, সামনে বসে আছে জনা ছয়েক যুবক। রোশনি বাঈ এর গলায় তখন,
"পথেই শুধু পথ হারালাম, নিরুদ্দেশে গেলাম না
ভালো-বাসা অনেক পেলাম, ভালোবাসা পেলাম না।....
এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না যাতে মুক্তো আছে।"
অত জনের মাঝে ও একজনের মুগ্ধ দৃষ্টি রোশনি বাঈ লক্ষ্য করেছেন। শুনেছেন উনি তিন দিন হলো আসছেন,যার সাথে আসছেন তার সাথে এক ই মেসে থাকেন। নতুন চাকরি নিয়ে এসেছেন।
দিন কয়েক যাবার পর রোশনি বাঈ লক্ষ্য করেছেন সবাই চলে গেলেও নতুন মানুষটি কিছুক্ষণ বসে থাকেন।আর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন। এ ভাবে একদিন কথা শুরু,আর কি করে যেন দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছেন সেটা বুঝলেন।
রোশনি বাঈ বললেন," আমায় ভালবাসো কিন্তু আমায় বিয়ে করে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে? আমার পরিচয় জানলে তোমার সমাজ তোমায় একঘরে করবে। পারবে সেই সমাজের সাথে লড়তে?"
(৩)
জানলার বাইরে তাকিয়ে অসীমা এতোটা আনমনা হয়ে গেছিল,কখন যে সুজয় এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে সে বুঝতে পারে নি।
সুজয় অসীমা র মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে,সে কি ভাবছিলো, তাই বলে,"আবার তুমি ভাবছো জীবনের সেই কালো দিনের কথা, সেই জীবন থেকে মুক্তি দিতে আমি সেখান থেকে অনেক দূরে নিয়ে এসেছি তোমায়। যেখানে কেউ জানবে না রোশনি বাঈ কত অগ্নিপরীক্ষা পার করে শুদ্ধ হয়ে আজ অসীমা হয়ে উঠেছে।যে গান সবাই কে মুগ্ধ করতো ,যে গান ভালোবেসে আমি তোমাকে চেয়েছিলাম সে গানকে হয়তো ত্যাগ করেছো আমায় ভালবেসে। কিন্তু তার বদলে জীবনের মূল স্রোতে তোমায় আনতে পেরেছি যা আমার কাছে তুমি চেয়েছিলে।"
সুজয়ের এতো কথার পর দু- চোখ ভরা জল নিয়ে অসীমা বলে ওঠে," তুমি আমার জীবনের ধ্রুবতারা, নাটকের সংলাপ শোনালেও এটাই সত্যি।যেসব মানুষ রা আমাদের গায়ে কালিমা ছেটায় তারা চায় না আমরা ভালো থাকি। তোমার মতো মানুষ এর জন্যে তাদের বলতে ইচ্ছা হয়,
তোমাদের মনের শহরে অন্ধকার আর কালো,
তার থেকে বাঁচার আশা নিয়ে আমার জীবনে
জ্বালাই বসন্তের সুন্দর স্নিগ্ধ আলো।।।"
--------------------------
ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
-------------------------------
Parna basu
Mumbai, Maharashtra