ছোটগল্প ।। প্রতিহিংসার প্রেম ।। সুপ্তা আঢ্য
ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড সেমিস্টারের শেষ পরীক্ষার শেষের দিন বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে চন্দন, আবীর, বিশাখ , রেশমা আর সোহিনী খোশগল্পে মেতে উঠেছিল।ওরা প্রত্যেকেই ইউনিভার্সিটি হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। এখনো তৃতীয় সেমিস্টারের ক্লাস আর দ্বিতীয় সেমিস্টারের রেজাল্টের একটু দেরী থাকায় ওরা পাঁচজন নিরুদ্বেগেই আড্ডা দিচ্ছিল। কথার মাঝখানে সোহিনী বলে উঠল "চল্ না রে - - - কোথাও একটা ঘুরে আসি।" "হ্যাঁ, কিন্তু হস্টেল থেকে গেলে হবে না। আগে বাড়ি যাব - - - - তারপর সবাই একসাথে বেরিয়ে পড়ব।" "এটা কিন্তু চন্দন ঠিকই বলেছে রে---। হস্টেল থেকে একসাথে গেলে অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে।" "সে তো বুঝলাম - - - কিন্তু সোহিনী, কোথায় যাবি সেটা আগে ঠিক করে নে! " " আচ্ছা বিশাখ - - - সুন্দরবন গেলে কেমন হয় বলতো? " " দূ--র্ বাচ্চাদের মত বাঘ দেখতে যাব না! " " তাহলে বড়োদের মতো কী দেখতে যাবে মা রেশমা---হাঁউ মাঁউ খাঁউ--" চন্দনের কথায় সকলে হেসে উঠলেও রাগে মুখ ফুলিয়ে রেশমাকে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখে আবীর বলল"আহা! তোরা রেশমাকে এবার তো একটু বড়ো ভাব্। বেচারী কত্তো রাগ করেছে। " " মার খাবি কিন্তু আবীর! আমি কোথাও যাব না - - - তোরাই যা। " " আঃ রেশমা! তুই কী মজাও বুঝিস না? শোন্ না, বিষ্ণুপুর যাবি?" "এত জায়গা থাকতে বিষ্ণুপুর? ইতিহাস দেখতে হলে মুর্শিদাবাদ চল্। " " দূর---ওখানে তো সবাই যায়। বিষ্ণুপুর চল্ না রে, প্লিজ - - -" " ঠিক আছে, অবলা নারীর কথামতো বিষ্ণুপুরই যাওয়া হোক। " "আচ্ছা চন্দন, তুই কী মজা ছাড়া চলতে পারিস না। আমরা অবলা----পিঠে দুটো পড়লেই অ এর বদলে স বলবি। বুঝলি---" " আচ্ছা বেশ বেশ - - - তাহলে মিস সোহিনীর ইচ্ছানুযায়ী আমরা বিষ্ণুপুর যাচ্ছি সামনের শনিবার। ওকে - - - কোনো প্রবলেম নেই তো কারুর? " জায়গা ঠিক হওয়ার পর পাঁচজন আলোচনা করে ঠিক করল, শনিবার সকাল আটটায় ওরা বর্ধমান স্টেশনে অপেক্ষা করবে। আর তারপর বিশাখের বাবার বোলেরো গাড়িটা নিয়ে ওরা রওনা দেবে আর শনিবার রাত্তির ওখানে থেকে রবিবার ফিরে আসবে ওরা। সেই মতো শুক্রবার ওরা যে যার বাড়ি চলে যায়। শনিবার ঠিক সাড়ে আটটা নাগাদ দলটা রওনা দেয় বিষ্ণুপুরের পথে। সময় নষ্ট করবে না গাড়িতেই ওরা হাল্কা টিফিন করে নেয়। সোনামুখী জঙ্গল পেরোনোর সময় হঠাৎই রেশমা বলে উঠল "একটু দাঁড়া না রে?" "এই জঙ্গলে কী করবি রে----হাতির পিঠ চুলকোবি বুঝি?" "না রে গর্দভ - - - - ছবি তুলব।" "দেরী হয়ে যাবে কিন্তু। তোরা নামলে সহজে যে উঠবি না সেটা আমি জানি।" "না রে বিশাখ - - - বেশী দেরি হবে না - - - প্রমিস - - - সোহিনী চল" সোহিনী আর রেশমার লেগপুলিং করলেও সকলেই নেমে বসন্তের নবপল্লবের সাজে সজ্জিত জঙ্গলের সৌন্দর্য উপভোগ করে জঙ্গলকে সাথী করে বেশ কিছু ছবি তুলে গন্তব্যের দিকে রওনা দিল। প্রায় বারোটার কাছাকাছি পৌঁছে ওরা সরকারী লজে আগে থেকে বুকিং করে রাখা ঘরে ঢুকেই হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ল "কীরে রেশমা---তুই এরকম ভাবে বসে পড়লি যে! বেরোবি না?" "আজ তো আমরা আছি। একটু রেস্ট নিয়ে বিকেলে বেরোলে হতো না?" "এটা তো তোর মামাবাড়ি----যখন খুশি গেলেই হলো। নে ওঠ - - - একটা সময়ের ব্যাপার আছে তো নাকি?" ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে নক্ করতে আবীর, চন্দন আর বিশাখ বেরিয়ে আসতেই সকলে এসে পৌঁছল রাসমঞ্চের সামনে। ওখান থেকে সরকারী গাইড নিয়ে টেরাকোটার কাজ, বিবর্ণ হয়ে আসা পঙ্খের কাজ করা মন্দিরগুলো ঘুরতে ঘুরতে পুরোনো গল্পেগাথা কাহিনী শুনতে শুনতে সায়েন্সের স্টুডেন্ট হয়েও মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল ওরা। "আর কোনও জায়গা নেই?" "আর কী দেখতে চান? সবই তো দেখিয়েছি - - -" "এমন কোনো জায়গা - - - যার গল্পে কিছু রহস্য রোমাঞ্চের ছোঁওয়া পাওয়া যাবে।" "তেমন জায়গা - - - - বলতে গেলে - - - তাহলে লালদিঘী চলুন।" "লালদিঘী? কী আছে ওখানে?" "চলুন যেতে যেতে সবটা বলবো। " এরপর রাস্তায় যেতে যেতে গাইডের মুখে রাজা রঘুনাথ মল্লের লালবাঈয়ের প্রতি প্রেম, নৌকা সফর আর শেষ পরিণতি নৃশংস হত্যার কাহিনী শুনতে শুনতে ওরা পৌঁছে গেল জঙ্গলের কোলে প্রায় চারশো একর জায়গা নিয়ে তৈরী এই প্রেমের স্মারকে । লজে ফিরে লাঞ্চের পর সোহিনীদের রুমে সকলে বসে আড্ডা দিতে দিতে আবীর জিজ্ঞেস করল"কীরে, যাবি নাকি রাত্তির বেলা---রাজামশাই আর লালবাঈয়ের অভিসার দেখতে?" "এই শোন, ওগুলো নিয়ে ঠাট্টা করিস না।" "হ্যাঁ রে রেশমা - - - তুই না সায়েন্সের স্টুডেন্ট?" "দেখ চন্দন, সায়েন্সের স্টুডেন্ট তো কী! ভূত তো ভূতই - - - বল" "রেশমার কথা ছেড়েই দিলাম - - - ওই জলা জায়গায় রাতের বেলা অনেক বিপদ থাকতে পারে। আমার মনে হয় না যাওয়াই ভালো। " " বেশ তো---তাহলে তোরা থাক্, আমি একাই যাব। " আবীরের কথা শেষ হবার সাথে সাথেই সোহিনী আর চন্দন একসাথে হাত তুলে বলে উঠল" শোন্, আমরাও যাব---এতগল্প শুনলাম আর সত্যিটা জানব না - - - সেটা হয় না ।" বাকীদের কথা শেষ হতেই বিশাখ আর রেশমা একে অপরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে উঠল" দেখ্, এক যাত্রায় পৃথক ফল তো আর হতে পারে না। আমরাও যাব।" ওদের সম্মতি পেয়ে সকলে রেডি হতে লাগল আজকের নৈশাভিযানের জন্য।
ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতের গণ্ডী পেরোতেই ছেলেমেয়েদের দলটা চুপিসারে লজ থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল গন্তব্যের পথে। প্রথম প্রথম অন্ধকার রাস্তায় বারবার হোঁচট খেলেও কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ সয়ে যাওয়ায় অমাবস্যার কালো রঙে চোবানো পথে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিল না ওদের। বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পরেই ওরা লালদিঘীর বাঁকটা দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল ওদিকে। প্রতিপদের বেশ কয়েকদিন পরের একফালি চাঁদের আবছা আলোয় বিশাল দিঘীর রহস্যময়তা আরও বেড়ে উঠেছে। তামস ঘেরা ঢেউ খেলানো দিঘীর জলে একফালি রূপোলী চাঁদের সৌন্দর্য্যে গরবিনী লালদিঘী অন্ধকারকে সঙ্গী করে সেই অহংকারের উদযাপনে ব্যস্ত । আর পাড়ে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অরণ্যানির নিকষ কালো রেখা পরিবেশটা আরও রোমাঞ্চকর করে তুলেছে। চারিদিকে এক অস্বাভাবিক নীরবতা - - - নিশ্বাসের সঙ্গে বাতাসের ফিসফিসানিও যেন শোনা যাচ্ছে। পরিবেশের অস্বাভাবিকতায় ওরা নিজেরাও কখন যেন চারপাশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চুপ করে গেছে আপনা থেকেই। রাত একটু গভীর হতেই বেশ কিছু মানুষের কথা - - - - হই হট্টগোল - - - অদূরে মন্দির থেকে ভেসে আসা কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল ওরা। সচকিত হয়ে চারপাশে তাকাতেই দেখল---বড়ো রাস্তা থেকে একটা পাইক বরকন্দাজ পরিবেষ্টিত সুসজ্জিত পালকি এদিকেই আসছে। শশব্যস্ত হয়ে ওরা রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ালেও ওদের প্রতি কোনও ভ্রূক্ষেপ না করে পালকি এসে লালদিঘীর পাড়ে থামতেই ঘাটের কিনারে এক সুসজ্জিত বজরা এসে দাঁড়াল। পাইক পথ করে দিতেই পালকি থেকে মহারাজা রঘুনাথ মল্ল নেমে এসে সযত্নে প্রেয়সী লালবাঈকে নামিয়ে বজরার দিকে এগিয়ে গেলেন। রাজা লালবাঈকে নিয়ে বজরায় উঠতেই বজরা এগিয়ে গেল মাঝদিঘীতে।দূর থেকে যুদ্ধে নিহত পাঠান সর্দার নিহত রহিম খাঁয়ের বেগম লালবাঈয়ের সুরেলা কণ্ঠের জাদুতে মোহিত হয়ে যাচ্ছিল চারিদিক ।অপূর্ব সুরের মূর্চ্ছনায় হারিয়ে গিয়েছিল ওরাও। হঠাৎই ওদের চোখের সামনে ভেসে উঠল রাজ্অন্তঃপুরে স্বামীর স্বেচ্ছাচারীতার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা রানী চন্দ্রপ্রভাকে। নিঃসন্তান মহারাজ শুধুমাত্র ওনার সাথেই অন্যায় করছেন না----ওনার ঔরসে লালবাঈয়ের গর্ভে জন্মানো সন্তানকে এই বংশের উত্তরাধিকার করে শেষ করে দিতে চাইছেন এই মল্ল বংশকে। এই অনাচার কীকরে সইবেন উনি। তাই মহারাজের ভাইয়ের সাথে গোপনে চুক্তি করে লালবাঈয়ের বাসভবন 'নতুন মহলে' যাওয়ার পথেই বিষ মেশানো তীর দিয়ে নিজের হাতে হত্যা করেন স্বামীকে। একদিকে রাজকার্য বাদ দিয়ে প্রমোদে মত্ত রাজার লালবাঈকে সঙ্গে নিয়ে প্রত্যহ নৌকাবিহার------অন্যদিকে রূপের জাদুতে ভুলিয়ে রাজাকে নিজের করতলগত করে স্বামী হত্যার প্রতিশোধের রক্তে ছেলের সিংহাসন রঞ্জিত করে ক্ষমতা চরিতার্থের লালসার স্বপ্ন দেখা লালবাঈ! আর একদিকে স্নিগ্ধ রূপের অধিশ্বরী রানী চন্দ্রপ্রভা - - - - স্বামীকে পাঠান পত্নীর কণ্ঠলগ্না দেখে চুপ থাকলেও রাজকার্যে মহারাজের অনীহা আর প্রেমোন্মত্ত রাজার লালবাঈয়ের সন্তানকে যুবরাজ ঘোষণার সিদ্ধান্তে খেপে ওঠা প্রজাদের নিয়ে রানীর গোপন চক্রান্তের সাক্ষী হয়ে হতবুদ্ধি পাঁচজন দাঁড়িয়ে রইল স্থানুবৎ। নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল ওরা। হঠাৎই এক গগনবিদারী আর্তনাদে চমকে তাকাতেই দেখল রানী চন্দ্রপ্রভার আদেশে উন্মত্ত প্রজারা পলায়নোদ্যত লালবাঈকে সুসজ্জিত বজরায় পুত্র সহ উঠিয়ে দিল। হতভাগ্য লালবাঈ জানতেও পারেনি - - - কী গভীর চক্রান্তের শিকার ও। বজরায় ওরা উঠতেই হু হু করে জল ঢুকতে লাগল আগে থেকেই মাঝখান ফুটো করে রাখা বজরায়। আর পুরো চত্বর ভরে উঠছিল জলের অতলে তলিয়ে যেতে থাকা লালবাঈয়ের গগনবিদারী আর্তনাদ আর অভিশাপে। স্বামীর হত্যার বদলা নিতে আসা পাঠান বেগমের কাছে এই মুহূর্তে সন্তানের জীবন অনেক বেশী দামী - - - - নাই বা হল সে পাঠান পুত্র! কিন্তু সেদিনের উন্মত্ত প্রজারা দেবীরূপা রানী চন্দ্রপ্রভার আজ্ঞাবহ মাত্র - - - - সেই ছোট্ট শিশু আর তার মায়ের কান্না তাদের কানে না পৌঁছলেও আকাশ বাতাস ভারী করে রাখে এখনও। শেষ মুহূর্তে জলের অতলে যাওয়ার আগে লালবাঈয়ের বাঁচার আকুলতা স্থবির করে দিয়েছিল ওদের। বাকি রাতটা কোথা দিয়ে কেটে গেল বুঝতেই পারল না ওরা। ভোরের আলো ফুটে দিঘীর জলে তার কিরণ পড়ে ঝিকমিক করে উঠতেই সম্বিত ফিরল ওদের ।সায়েন্স স্টুডেন্ট হলেও গতরাতের ঘটনার কোনও সায়েণ্টিফিক ব্যাখ্যার কথা মাথাতেই আসছিল না ওদের। পায়ে পায়ে লালদিঘীকে ইতিহাসের জিম্মায় রেখে ওরা এগিয়ে গেল লজের দিকে।
------------------------------