ছবিঋণ- ইন্টারনেট
ত্রিকোনমিতি
প্রিয়ার চিঠি
___________
শঙ্খ, অনেকদিন পরে তোমাকে আবার চিঠি লিখছি। সেই যেবার ,বিয়ের পরে তুমি অফিস ট্যুরে গেলে, হায়দরাবাদে, তখন আমাদের বিরহে ভরা চিঠির আদান প্রদান হত!
তুমি ভাল আছ তো? অফিস থেকে কি আগের মতোই দেরী হয় বাড়ী ফিরতে?
কবে যে আবার তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে, জানিনা! আদৌ কি হবে?
হিয়া কে আমার ভালবাসা জানিও। ও কেমন আছে, জানতে ইচ্ছে করে।
এদের এখানে ব্যবস্থা খুবই ভাল, যত্ন নেয় খুব!এখানে রোজ সন্ধেবেলায় একটা গানের ক্লাস হয়, আমি ওখানে যাই। জানো, একসময় খুব ইচ্ছে হতো, আমার প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত গুলো একলা তোমার পাশে বসে শোনাই!কিন্ত আমার গান তুমি কখনোই শুনতে চাওনি!এমনকি যখন অন্য কেউ আমার গান শুনে প্রশংসা করত, তুমি উঠে চলে যেতে!আমার যে বড় বড় অয়েল পেন্টিং গুলো দিয়ে বাড়ী সাজিয়ে ছিলাম, সেগুলোর কোনও প্রশংসা তুমি কোনও দিন করোনি!অথচ তোমার বাবা মা আমার একটা ছবির এক্সিবিশন দেখতে এসেই আমাকে পছন্দ করে গেছিলেন তাদের একমাত্র ছেলের জন্য!ওরা এত রুচিশীল মানুষ যে বিয়ের পরে ওদের সল্টলেকের বাড়ীতে আমি ওদের সঙ্গেই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্ত তুমিই জোর করে তোমার অফিস থেকে পাওয়া সাউথ সিটির ঐ আকাশ ছোঁয়া ফ্ল্যাটে এনে তুলেছিলে!বেশ জমিয়ে, গুছিয়ে সংসার করতে আমার চিরদিনই ভাল লাগত!বিয়ের আগেও ঘর বাড়ী গুছিয়ে রাখার কাজ টা, মা আমার ই দায়িত্বে ছেড়ে দিত! কারণ হিয়া র স্বভাব ছিল বাড়ী, ঘর দোর অগোছালো আর নোংরা করে ফেলা!
বিয়ের পরে আস্তে আস্তে সংগীত চর্চা করার থেকে ডাস্টিং করার কাজটাই আমার বেশী প্রিয় হয়ে উঠেছিল। নিঁখুত করে সাজানো ধুলোহীন একটা সংসারে প্রথম দশ বছর নোংরা করার মত কেউ ছিলও না! যদিও প্রথম দিকে, একটা দুষ্টু বাচ্চা এসে আমার সব কিছু ওলোটপালোট করে দেবে, এ আশা ছিল! কিন্ত সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা র পরে যখন বোঝা গেল অক্ষমতা টা তোমার ই ছিল, আমি কিন্ত তোমাকে দোষী মনে করিনি বরং একবুক ভালবাসা দিয়ে তোমাকে আড়াল করতে চেয়েছি।জীবনে, সবকিছুই প্রমাণ সাপেক্ষ, এই থিওরী তে আমি বিশ্বাস করিনা!সন্তান না হলে কি আমাদের ভালবাসা কমে যাবে? দু একবার বলেছিলাম অবশ্য, দত্তক নেবার কথা, তবে তুমি বা তোমার বাবা মা যখন বললে, তোমাদের নামী বংশে অন্য কোনও রক্তের বীজ ঢোকানো যাবে না তখন তাই মেনে নিলাম।
হিয়ার কথা ও খুব মনে পড়ে! হিয়া ছেলেবেলায় ছিল গোলগাল একটা মিষ্টি মেয়ে, কত আদর করতাম ওকে! তারপর ধীরে ধীরে কেমন সব বদলে গেল বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে!ওর আর আমার মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে গেল!আমি এটা বুঝতে পারতাম যে ও আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে নজর করে, আমার সঙ্গে একটু ব্যঙ্গ করে কথা বলে কিন্ত এর কারণ টা যে কি, সেটা বুঝে উঠতে পারতাম না।
আমার বিয়ের পর থেকেই ও আমাদের ফ্ল্যাটে এসে মাঝে মাঝে থাকত। বাবা মা তখনও বেঁচে! হিয়া কে তুমিও কত ভালবাসতে, প্রথম থেকেই!আমাদের স্বভাবের পার্থক্য টা ছিল চোখে পড়ার মত!আমি বরাবরই একটু নিজের মনে থাকতে পছন্দ করি, আমার বন্ধুর সংখ্যা হাতে গোনা!কিন্ত হিয়া আমার ঠিক বিপরীত! উচ্ছল, আমুদে স্বভাবের হিয়ার অগুন্তি বন্ধু বান্ধবের আসা যাওয়া আমার বাপের বাড়ীতে লেগেই থাকত!
তোমার আর হিয়ার আড্ডা যখন জমে উঠত, তখন আমার নিজেকে একটু অপাংক্তেয় মনে হত!একদিন যখন আমি জলখাবারের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকছি তখন হিয়া তোমার বুকের ওপর মাথা রেখে শুয়েছিল, আমি দরজায় এমন হোঁচট খেলাম যে হাতের ট্রে পড়ে গেল, সে কি লজ্জা! হিয়া দেখলাম, খুব বিরক্ত, তুমিই দৌড়ে এসে আমায় ধরলে!তার পরেই তো আমার হাত কাঁপা শুরু হল, আজও ঠিক হলনা!
তারপর হঠাৎই একদিন চোখে পড়ে গেল, হিয়া আমাদের দুজনের বড়ো করে বাঁধানো ছবিটা দেওয়াল থেকে খুলে নিয়ে স্টোরে গিয়ে রেখে আসছে! হিয়া অবশ্য আমায় দেখতে পায়নি!সেদিন থেকেই আমার কীরকম একটা দমবন্ধ লাগত!
আমি যেন ধীরে ধীরে একটা বিষন্নতার গুহায় প্রবেশ করছিলাম, আর কিছুতেই সেখান থেকে বেরোতে পারছিলাম না! তুমি অবশ্য অনেক ডাক্তার দেখালে, আমার ঘরের টেবিল ওষুধে ভরে গেল!
শঙ্খ'র কথা
____________
হিয়া বেলা ন'টার আগে বিছানা থেকে উঠতেই পারেনা!তাই ব্রেকফাস্ট টা কাজের মাসী বানিয়ে দেয়। প্রিয়া সব কিছু করে দিয়ে দিয়ে আমার অভ্যাস এত খারাপ করে দিয়েছে যে এখন আর নিজে কিছু করতে গেলে প্রতি পদে পদে হোঁচট খেতে হয়।আগে অফিসে প্রিয়া র বানানো রকমারী লাঞ্চ নিয়ে যেতাম, এখন ক্যান্টিনেই খেয়ে নি, কারণ কাজের মাসী অনেক দেরীতে আসে বলে আর আমার লাঞ্চ টা বানাতে পারেনা।
এখন প্রিয়া র অনুপস্থিতি গা সওয়া হয়ে গেছে। আর মেন্টাল অ্যাসাইলাম থেকে সুস্থ হয়ে কটা লোক ই আর বাড়ী ফেরে?যতদিন বাঁচবে, ওর ব্যয় বহুল খরচা আমাকেই টানতে হবে!
হিয়া আমার থেকে অনেক ছোট, ওর প্রতি আমার ভালবাসা টা বরাবরই স্নেহমিশ্রিত!খুব হাসিখুশি, চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে! আমার ওপর ওর দাবী সেই প্রথম দিন থেকেই। আজও, জেদ করে হলেও যেটা চাইবে সেটা আদায় করেই ছাড়বে। আমিও ওর কোনও আবদার ই ফেলতে পারিনা।
কোনরকমে ব্রেকফাস্ট সেরে চুপি চুপি রেডি হই,কোনও আওয়াজ না করে,যাতে হিয়ার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে!অফিসে গিয়ে ও আজকাল ওর কথা ই খালি মনে হয়, বারবার ফোন করে খোঁজ নিই। আমার কামনার রঙ গাঢ় হয়ে উঠেছে, হিয়া'র হাত ধরে, প্রিয়ার শীতলতার পরে এই আগুন টা আমার দরকার ছিল!
প্রায়দিনই অফিস থেকে ফিরে আবার গাড়ী বার করে ওর পছন্দ মত শপিং মল হয়ে, নামী দামী হোটেল রেস্তোঁরায় ডিনার সেরে বাড়ী ফিরি। রোজ রোজ নাকি কাজের মাসীর সাদা মাটা রান্না খেলে ওর মাথা ধরে, একথা যখন ও নিজেই চোখ পাকিয়ে, মুখ বেঁকিয়ে বলে তখন ওর ছেলেমানুষী দেখে আমার হাসিই পায়!মলে অন্তত একশো টা দোকান ঘুরে ঘুরে দুটো জিনিস কেনে। আমার অফিস ফেরতা ক্লান্ত লাগে, কিন্ত ওর উৎসাহে বাধা দিই না।আমার নাকি ফ্যাশন সেন্স বলে কিছু নেই, তাই নতুন ফ্যাশনেবল শার্ট পরিয়ে আমাকে সাজাতে চায়!
তবে রোজই বাইরে থেকে এসে প্রথম বাড়ী ঢুকেই আমার প্রিয়ার মুখটা মনে পড়ে।অনেক দিনই ওকে আমরা কেউ ই দেখতে যাইনি! একটা অপরাধ বোধ কাজ করে, কেন বুঝিনা! ওর এই অবস্থার জন্য আমার দায় কতটুকু?পারতপক্ষে তাই আর ওমুখো হইনা।
হিয়া অবশ্য ওর দিদির কথা একদমই বলেনা!ও বলে, ও খুব প্র্যাকটিকাল, তাই কোনও ফালতু ইমোশনে ও বিশ্বাস করেনা।
হিয়ার ডায়েরী
_____________
শঙ্খ 'দা আর দিদির ছবি টা আমি কালকে স্টোর রুমে লুকিয়ে রেখেছি। বড় করে বাঁধানো ঐ ছবি টা ড্রইং রুমে ঢুকলেই চোখে পড়ে, আমি প্রথম দিন থেকেই ওটা দুচোখে দেখতে পারিনা! দুজনের মুখে খুশীর হাসি উপছে পড়ছে। শঙ্খ দা'র ঐ রোমান্টিক চাউনি টাই আমার সবচেয়ে প্রিয়!
দিদির বিয়ের সময় শঙ্খ শুভ্র চ্যাটার্জি যেদিন বর বেশে আমাদের বাড়ী এল, সেদিন থেকেই আমি ওর প্রেমে পড়ে যাই। এবার ঠিক ঐরকম পোজে আমার আর শঙ্খ দা'র একটা ছবি তোলাব আর ঐ দেওয়ালেই টাঙিয়ে রাখব।
আমাদের ছোট বেলার দুটো অ্যালবাম আছে,যেগুলো বাবা মা মারা যাবার পর আমি দিদির বাড়ীতেই নিয়ে এসেছি। বাবার ছিল ফটোগ্রাফির শখ! সেই সব পুরনো সাদা কালো ছবি গুলো মাঝে মাঝে দেখি, আর মনে মনে বলি, "দ্যাখ, দিদি, শেষ পর্যন্ত আমি কিন্ত তোকে হারিয়েই দিলাম!
জন্মের পর থেকেই শুনে এসেছি, দিদি র মত মেয়ে জগতে হয় না!যত আত্মীয় স্বজন, স্কুলের টিচার রা,এমনকি মা যে মা,সেও যেন হাবেভাবে, কথায়, তাই বলত!দিদি খুব সুন্দরী,পড়াশুনায় ব্রিলিয়ান্ট, অপূর্ব গান গায়, অসাধারণ ছবি আঁকে!স্কুলের ডিবেটে ফার্স্ট প্রাইজ বাঁধা,দিদি নাহলে পাড়ার নাটক হবেনা! দিদি যখন ক্লাস থ্রি, তখন আমার জন্ম। জন্মাবার পর থেকেই বোধহয় টের পেতে শুরু করি, আমার বাবা-মা অন্য কারো জন্য সদা ব্যস্ত, আমি যেন কিছুটা অবহেলিত, এলেবেলে গোছের! দ্বিতীয়বার, বাবার পুত্র সন্তানের চাহিদা মেটাতে না পারায়, আমার প্রতি বাবার মনোযোগ কোনদিন ই টের পাইনি!যখন একটু বড় হতে শুরু করলাম তখন এই মনোযোগ আকর্ষণের জন্য শুরু হয়ে গেল আমার দৌরাত্ম্য!দিদি ছিল শান্ত, ধীর স্থির, বাধ্য মেয়ে। আর আমি ক্রমাগত আরও দুষ্টু, শেষ পর্যন্ত ডানপিটে গোছের মেয়ে হয়ে উঠলাম। বাড়ী তে আমার নামে কমপ্লেন আসত রোজই, বাবা-মা তাই নিয়ে ব্যতিবস্ত হয়ে যেত, আমাকে বকাবকি, এমনকি মারধোর ও চলত!দিদি তখন ছুটে এসে আমাকে বাঁচাতে চাইত, এমন ভাব করে, যেন আমাকে কত ভালবাসে!কিন্ত আমি ওসব ভ্রূক্ষেপ করতাম না!
পড়াশুনায় চিরকাল অ্যাভারেজ, কোনও বিশেষ গুণ ও নেই, তবে হ্যাঁ, স্কুলের আর পাড়ার স্পোর্টসের প্রাইজ পেতাম সবসময়ই!দেখতে সাধারণই, কিন্ত বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু সাজগোজ করলে আমাকে বেশ অ্যাট্রাকটিভ দেখাত!পাড়ার বহু ছেলের মাথা ঘুরিয়ে অবশেষে দিদির বিয়ের পর থেকে, শঙ্খ 'দার ওপরে আমার নজর পড়ল!আমার সঙ্গে ঠাট্টা গল্প, এমনকি অশালীন জোকস্ করতে শঙ্খ'দা ও খুব পছন্দ করত!আমাদের স্বভাবের মিলে আমরা পরস্পরের আরও কাছাকাছি চলে এলাম!বুঝতে পারতাম, শঙ্খ 'দা ,দিদির কাছে যা পায়না, সেটা আমার কাছে পেতে চায়!আর আমি ও তো শঙ্খ' দা কে সেই ভাবে ই পেতে চাই! শঙ্খ'দা হবে আমার নিজের, সেখানে আর কেউ থাকতে পারেনা! সারাজীবন দিদিই আমার থেকে সব বিষয়ে জিতে যাবে, সেটা হতে পারেনা!
মেন্টাল অ্যাসাইলামে দিদি চলে যাবার পরে আমার সেই স্বপ্ন, এখন বাস্তব! শঙ্খ দা এখন শুধুই আমার, দ্যাখ, দিদি শেষ পর্যন্ত আমি কিন্ত জিতে গেলাম।
--------------------------------
কাকলী দেব
কলকাতা
Tata Housing Avenida, Tower D 1602,Action Area II,
Newtown, Kolkata-700160