বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গল্প ।। অভিমানিনী ।। শেফালি সর

                                                                       ছবিঋণ- ইন্টারনেট
 

অভিমানিনী

   শেফালি  সর


বৃন্দাবনের এক নির্জন পরিবেশে একতলা একটি বাড়ির  মালকিন রাধিকা  সেন। অবসরপ্রাপ্ত  শিক্ষিকা  রাধিকা  সেন আজ ঘরের দোর বন্ধ  করে  তার  প্রিয় জানালার  ধারে বসে দেখছিল তার  বাগানের নিষ্পাপ মল্লিকার নির্মল সৌন্দর্য্য, কেমন বৃষ্টিতে ভিজে  ভিজে  হাসছে। বাইরে ঘন কৃষ্ণকালো মেঘের ঘনঘটা। চারদিক  কেমন  নিস্তব্ধ। শুধু বাহিরে  বৃষ্টির  ঝমঝম শব্দ  আর তার  মনের  ঘরে  অতীত  স্মৃতিরা মেঘ হয়ে  অনবরতঃ বৃষ্টি  ঝরিয়ে যাচ্ছে।মনে পড়ে  যায় মল্লারপুর গ্রামের সেই  মস্ত বাড়িটা -যেখানে তার শৈশব কেটেছে। ওরা ছিল  দুই  বোন এক ভাই।ডাক্তার সোমেশ সেন ও আরতি সেনের বড় মেয়ে রাধিকা  সেন, ছোটো বোন লতিকা ও ভাই রাজীব। সেদিনটা এমনি এক বিকেলবেলা। স্কুল বন্ধ  হয়ে গেছে বৃষ্টির জন্য।দশম শ্রেনীর ছাত্রী রাধিকা  বাড়িতে  বসে পরের দিনের  পড়া তৈরী  করছে।এমন সময়  মামা এসে  একথা ওকথা বলতে বলতে হঠাৎ  রাধিকাকে জড়িয়ে  ধরে।রাধিকা বারণ করে  এবং  পালাবার চেষ্টা  করেও ব‍্যর্থ হয়। তাকে জোর পূর্বক ধর্ষণ  করে। রাধিকা  কিছু  বলার আগেই  এই  অভাবনীয় ঘটনাটি  ঘটে যায়

আসলে রাধিকার  অগাধ  বিশ্বাস  ছিল মামার প্রতি। কয়েকদিন হল মামা এসেছে  তাদের  বাড়িতে। মামারও কলেজ  বন্ধ। কত আনন্দ করলো,কত গল্প গুজব করলো সবাই  মিলে  অথচ এই  ছিল  তার  মনে রাধিকা ভাবতে  পারেনি।রাধিকার জীবনে ঘটে গেল  এমন একটা  দুর্ঘটনা যা সে কখনও  কল্পনা  করেনি! ধীরে ধীরে  বর্ষণ  মুখরিত সন্ধ‍্যা আঁধার জড়িয়ে এক পা এক পা করে নেমে  এল প্রকৃতিতে,এমন কি রাধিকার  জীবনেও।রাধিকা অসুস্থতা  বোধ করছে। তাই ঘর থেকে  বেরোয়নি রাধিকা।রাধিকার কী হয়েছে  মা জানতে চাইলে,রাধিকা মা-কে জড়িয়ে ধরে  কাঁদতে  কাঁদতে সবকিছু  বললো। মা-তো শুনে একেবারে রেগে আগুন  ভাইয়ের  উপর,কিছুটা লজ্জিতও বটে।মা রাধিকাকে সান্ত্বনা দিয়ে  বলল-কাঁদিস না মা আমি  ওকে শাস্তি  দেবো নিজের  হাতে। আর কাউকে  এসব কথা  বলিসনে মা। রাধিকার  মা যখন ভাইয়ের  খোঁজ করে  তখন  ভাই পালিয়ে গেছে  তার  বাড়ি  থেকে।মা রাধিকার কথার সত‍্যতা আছে  বুঝতেই  পারলো।মা আরতি দেবী খুব  লজ্জিত বোধ করল। সেই থেকে বাপের বাড়ির  সাথে চিরতরে  বিচ্ছেদের  দাঁড়ি টেনে  দিল।

 এরপর  আরতি  দেবী ভাবতে লাগলো কীভাবে কথাটি  চাপা  দেওয়া যায়! কথাটাকে পাঁচ কান হতে দেওয়া যাবে না। শেষ-মেশ স্বামী  ডাক্তার সোমেশ সেনকে বলতে বাধ্য  হল।কারণ এই  বিপদ থেকে  উদ্ধার যে তাকেই  করতে হবে।ডাক্তার সোমেশ সেন আরতির প্রতি  ক্ষুন্ন  হলেও  পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ব‍্যবস্থা নিতে  বাধ‍্য হল।সবকিছু ঠিকঠাক হলেও রাধিকার  মন থেকে  সরানো  গেল না  দুর্ঘটনার  কালো ছায়া।রাধিকা আজকাল  একটু  গম্ভীর  প্রকৃতির হয়ে  গেছে।মা বোঝালো-সব মন থেকে সরিয়ে  দিয়ে পড়াশুনাতে মন দাও মা।রাধিকাও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য  মরিয়া। উচ্চশিক্ষা লাভের  পর চাকুরী র জন্য  একের পর  এক পরীক্ষা  দিতে  থাকে।বাবা মা ওর বিয়ের ব‍্যবস্থা করছে জেনে  একদিন রাধিকা  বললো-সে আগে  নিজের  পায়ে দাঁড়াতে চায়  তারপর  সে ভেবে  দেখবে।কিছুদিনের মধ‍্যে রাধিকা  একটি উচ্চ বালিকা  বিদ‍্যালয়ে শিক্ষিকার চাকুরীটা পায়। আবারও  বিয়ের প্রসঙ্গ  উঠলে রাধিকা  রাজী হয়নি। মা বোঝালো মা, মেয়েদের জীবনে একটা  অবলম্বন  থাকা  দরকার,তা নাহলে নানান  অসুবিধার সম্মুখীন  হতে  হবে। রাধিকা বললো-মাগো,আমি স্বাবলম্বী। আমারও তো একটা  স্বাধীন  মতমত আছে। 

পরপর ভাইবোনদের সকলের বিবাহ  অনুষ্ঠানে  উপস্থিত  থেকেছে অথচ  কাউকেই  বুঝতে  দেয়নি রাধিকা  নিজের  মানসিক  যন্ত্রণার কথা।রাধিকার মনে সবসময়  একটা দ্বন্দ্ব,জীবনটা তার  অভিশপ্ত।কেউ না  জানলেও  সে জানে সে ধর্ষিতা,তার জীবনে স্বাভাবিকতা  নেই।রাধিকা ভাবে তার  এই অপবিত্র জীবন নিয়ে সে কোনো সুস্থ ভালো  জীবনের সঙ্গে জড়াবে না।তাই তো সেদিন  সে প্রনয়কে ফিরিয়ে  দিয়েছিল। প্রনয় রাধিকাকে ভালোবাসে।সে বিয়ে  করতে  চেয়েছিল। রাধিকা প্রনয়কে কিছু  না বলে - আপন মনে  বলছিল - অপবিত্র ফুল  দিয়ে  কখনও  দেবতার পূজা হয় না। মায়ের  মৃত‍্যুশয‍্যার পাশে  বসে  কান্নাকাটি করছিল  রাধিকা।মা বললো- ভগবান  তোমাকে  সর্বদা রক্ষা  করুক।বাবাও কিছু দিন  পরে মারা গেলে ভায়ের  সংসারে থাকতে  চাইল না রাধিকা। সে গোপনে বৃন্দাবনের এই   বাড়িতেই পাকাপাকি ভাবে  চলে আসে। এই  জায়গাটাও  কিনেছিল বাড়ির  কাউকে  না জানিয়ে। ভাই অনেক  খোঁজ  করেও  দিদির  সন্ধান  পায়নি। এভাবেই প্রায় ৮৫ বছর জীবিত  ছিল  রাধিকা। তার জীবিত কালেই এই বাড়ি টাও তার  অর্জিত  কিছু  অর্থ ঐখানের ধর্মীয়  প্রতিষ্ঠানকে  দান করে যায়।রাধিকার মৃত‍্যুর পর তার  দেহের  সৎকার করে  ঐ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। জীবন  উদ‍্যানে ফোটা  একটি ফুলের মতো  একটা  সুন্দর জীবন   কীভাবে  নষ্ট  হয়ে  যায়  শুধু ক্ষণিকের দুর্ঘটনায়,তা রাধিকা  সেনের  জীবন পর্যালোচনা  করলেই  বোঝা  যায়। জীবন -উদ‍্যানে ফোটা  একটি  কুসুম  যেন রাধিকা  সেন, সে দগ্ধ  হল পুরুষের  কামনার আগুনে। তার  ডায়েরির পাতায়  লেখা ছিল - আমি  সেই  ধর্ষিতা  নারী  যে সমাজ  সংসার  থেকে  স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিলাম  চরম  অভিমান বুকে  নিয়ে। শুধু বিধাতার কাছে প্রশ্ন ছিল  রাধিকার কেন এবং কোন অপরাধে----?
-------------------:---------------------
 
                       শেফালি  সর
                       জনাদাঁড়ি
                        গোপীনাথপুর
                         পূর্ব মেদিনীপুর 
                             ৭২১৬৩৩

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.