ম্যাঙ্গো মিষ্টি
অনিন্দ্য পাল
লিপি একহাতে ঝাঁটা অন্য হাতে দুধের প্যাকেট দুটো ধরে নিয়ে আসছিল। লেখা সেটা দেখে একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। চিৎকার করে বলল, --আরে তোকে তো কিছুই শেখানো যায় না দেখছি! ঝাঁটা ধরেছিস যখন দুধটা পরে নিতে পারতিস তো! রাখ, দুধের প্যাকেটটা রাখ।
কথাগুলো বলে লেখা হাতের তালুতে থাকা আটার লেচিটা আটার গামলায় ফেলে দিয়ে ছুটে এল দুধের প্যাকেট দুটো নিতে।
লিপির হাত থেকে দুধের প্যাকেট দুটো রীতিমতো ছোঁ-মেরে নিয়ে বড় ফ্রিজের মধ্যে রাখবে বলে ফ্রিজের ঢাকনাটা খুলতেই একটা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারল লেখার। প্রথমটা ঠিক বুঝতে পারল না লেখা গন্ধটা কিসের! এটা-ওটা সরাতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল একটা পলিথিন ক্যারিতে মোড়া কয়েকটা ল্যাংচা। "এ বাবা একদম ভুলে গেছি! পরশুদিন মিলির বাবা নিয়ে এসেছিল! বের করাই হয়নি একেবারে। কাউকে দেওয়াও হয়নি, এটাও মনে হয় গেল রে লিপি!"
ল্যাংচার প্যাকেটটা বের করে সিঙ্ক এর পাশে স্টোন স্ল্যাবের উপরে রেখে আবার কাজে লেগে গেল দুজনে। কদিন পরেই 'অরন্ধন'। এখানে সবাই বলে রান্না পুজো, তার আগে ঘরদোর সব পরিষ্কার করে রাখাটাই প্রথা। লিপি আর লেখা সেই কাজেই ব্যস্ত।
ঘরদোর পরিষ্কার করা, সমস্ত বাসনপত্র গোছানো, ঝুল ঝাড়া--এসব করতে করতে কখন যে বেলা দুপুর গড়িয়ে বিকেলের এদিকে চলেছে ওদের খেয়ালই ছিল না। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল লেখার। চমকে উঠে লিপি কে বললো,
--বেলা প্রায় তিনটে বাজে রে লিপি! যা, তুই এবার বাড়ি যা, বাকিটা আমি টুকটুক করে সেরে ফেলেছি। আবার সন্ধ্যে সন্ধ্যে চলে আসবি বুঝলি?
লিপিকে চলে যেতে বলে আবার মশলাপাতির কৌটো গুলো গোছানোতে মন দিল লেখা। লিপি চলেই যাচ্ছিল, একটুখানি গিয়ে আবার ফিরে এসে লেখার পাশে দাঁড়ালো চুপ করে। লেখা নিজের কাজেই ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ পাশ ফিরে কিছু একটা নিতে গিয়ে লিপিকে দেখে চমকে উঠে বললো,
-- এই লিপি, কি ব্যাপার রে- এখানে খাম্বার মত দাড়িয়ে আছিস কেন? বললাম তো বাড়ি যা! সন্ধ্যায় কিন্তু আসতেই হবে, নাহলে আমি কিছুতেই পেরে উঠব না। আর কামাই করলে হবে না, যা বাড়ি যা! এবার একটু ইতস্তত করতে লাগল লিপি। লেখা তার দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে এবার বলল,
--কিরে কিছু বলবি? এখন কিন্তু এডভান্স দিতে পারব না। ক'দিন আগেই তো নিলি তিনশ টাকা।
--না বৌদি অ্যাডভান্স চাইছি না।
লিপি একটু জড়ানো স্বরে কথাগুলো বলে চোখটা মেঝের দিকে নামিয়ে রাখল।
--তবে?
একটু বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করল লেখা। এখনো অনেক কাজ পড়ে আছে, সেগুলো সেরে তবে স্নানে যাবে, তাই লিপির এই রহস্য তার এখন পছন্দ হলো না। লিপি কয়েক মুহূর্ত একটু চুপ করে থেকে বলল, --বৌদি বলছিলাম ওই ল্যাংচাগুলো কি তুমি ফেলে দেবে?
--কোন ল্যাংচা? সিঙ্কের উপর চোখ পড়তে তখনই মনে পড়ল লেখার। বলল,
-- ওই ল্যাংচাগুলো? হ্যাঁ , ওগুলো তো টক হয়ে গেছে ও আর কি হবে?
--বলছিলাম ওগুলো কি দেবে আমাকে? নিয়ে যাব। কথাগুলো বলে লজ্জায় যেন মাটির সঙ্গে মিশে গেল লিপি।
গ্রামের মেয়ে লিপি। বাবার দৈন্য-দারিদ্র লিপির ভাগ্যটাকেও ছন্নছাড়া করে দিয়েছে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর স্কুলে আর যাওয়া হয়নি তার। চোদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এখানে স্বামীর ঘর করতে এসে ও সেই একই নেই নেই অবস্থার মধ্যে পড়েছে। লিপির বর আগে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করত। কি যে হলো, মদ খাওয়া, জুয়া খেলা, খারাপ পাড়ায় যাওয়ার মতো বদ অভ্যাসগুলো জুটে গেল। চাকরিটাও চলে গেল। এখন জন খাটে, তাও মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে বাড়ি বসে থাকে। সংসার চালানো দায় হয়ে ওঠায় যখন নিত্য অশান্তি শুরু হল, তখনই লেখা লিপিকে নিজের বাড়িতে পরিচারিকার কাজে নিয়ে এসেছিল।
সম্পর্কে লিপি লেখার বর রাজুর এক দুঃসম্পর্কের পিসির নাতবৌ। লিপি আর লেখার মধ্যে সম্পর্কটাও খুব সুন্দর। ঠিক যেন দুই বোন। লেখা মাস মাইনে ছাড়াও লিপিকে যখন যেমন পারে সাহায্য করে, লিপিও যতটা পারে গতরে খেটে লেখাকে সাহায্য করে। লিপিকে বোনের মতো স্নেহ করে লেখা, তাই ওর কথাটা শুনে একটু যেন থতমত খেয়ে গেল। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল, বলল
-- কিন্তু ও তো টক হয়ে গেছে রে লিপি! ও মিষ্টি তো কেউ খেতে পারবে না! কি করবি ওগুলো নিয়ে গিয়ে?
লিপি একটু নিজের বাম হাতের তালুর মধ্যে ডান হাতের তালু টা ঢুকিয়ে কচলাতে কচলাতে জড়ানো গলায় বললো,
--বৌদি ও তো মদ খেয়ে পড়ে থাকে। মিষ্টিগুলো দিয়ে দেবো, বলবো ম্যাংগো মিষ্টি। টক বুঝতে পারবে না। ঠিক খেয়ে নেবে। কতদিন ও মিষ্টি খায় নি, ও ঠিক খেয়ে নেবে। আর একটু টকই তো হয়েছে, পচে তো যায়নি!
লেখার মুখটা ম্লান হয়ে এলো। লিপির কথাগুলো শুনে বুকটা হু হু করে উঠলো লেখার। কত খাবার নষ্ট হয় তাদের বাড়িতে। পুকুরে ফেলা যায় কত ভাত-তরকারি। কত অপচয়! এই ল্যাংচাগুলোও তো সেই খাতাতেই নাম তুলেছিল, লিপি সেগুলো নিজের মাতাল বেকার স্বামীর জন্য নিয়ে যেতে চাইছে। লেখা বুঝতে পারল না এতে তার খুশি হবার কথা না কষ্ট পাওয়া উচিৎ।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে লিপিকে একটু অপেক্ষা করতে বলে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল লেখা। কয়েক সেকেন্ড পর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লিপির হাতে পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে বলল,
--যা পাঁচটা ল্যাংচা কিনে দিস। আর সন্ধ্যেবেলায় আজ আসতে হবে না। বিকেলে না হয় বাজারে গিয়ে কিনে নিয়ে আসিস মিষ্টিটা। যা এখন বাড়ি যা।
লিপি করুন চোখে কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু লেখাটা টাকাটা তার হাতে গুঁজে দিয়ে আর কিছু বলতে দিল না বাড়ি পাঠিয়ে দিল।
লিপি চলে যাওয়ার পর ঘরে এলো লেখা। পলিথিন ক্যারিটা থেকে ল্যাংচাগুলো একটা প্লেটে তুলে নিয়ে তার মধ্যে থেকে একটা নিয়ে মুখে দিল। আহ কি স্বাদ! চোখে জল এসে গেল লেখার।
লিপি জানেনা এক ছাদের তলায় থাকলেও গত একবছর লেখা আর তার স্বামী রাজুর মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। বিরল স্নায়ুরোগে শারীরিকভাবে অক্ষম রাজুকে লেখা শারীরিক-মানসিকভাবে প্রায় ত্যাগ করেছে বললেই চলে। আর এখন রাজু ও জড় পদার্থের মত শুধু উপার্জনের দায় কাঁধে নিয়ে বেঁচে আছে। সকাল আটটায় দোকানে বের হয়ে যায় রাত এগারোটায় ফেরে। ফেরার সময় রোজই লেখার পছন্দমত কিছু না কিছু সে নিয়ে আসে। লেখা ল্যাংচা ভালবাসে, তাই রাজু এই ল্যাংচাগুলোও এনেছিল সেদিন।
ল্যাংচাগুলো খেয়ে আবার কাজে লেগে পড়ে লেখা। রাজুর ফিরতে এখনো সাত-আট ঘণ্টা বাকি সময়টা আজ বড্ড দীর্ঘ মনে হচ্ছে লেখার।
===============================
ঠিকানা*
======
অনিন্দ্য পাল
প্রজত্নে -- বিশ্বনাথ পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত