ছবিঋণ- ইন্টারনেট
সোনালি শরতের মায়াবী আকাশে পুঞ্জীভূত সাদা মেঘের পুলকিত বিচরণ। শিউলিতলার সুবাসে উদাসী মন।কাশফুলের দোলার ছন্দে হৃদয়ে অব্যক্ত আনন্দের আগমন। এমনি এক মনোরম দিনে উথাল পাথাল শ্রমণার মন। হয়তো মৃন্ময়েরও। দীর্ঘপ্রায় দশ বছর পর প্রথম সামনাসামনি হবে ওরা। অনেক আবেগের অনুসন্ধানের অপেক্ষায় ছিল দুটি মন এতদিন । আজ বন্ধুসম কাকা আর একান্ত অনুগত ছোটো বোন সুতপার সাথে মেঠোপথে একটু অবসরের আমেজ নিতে ঘুরতে বেরিয়েছে। রোজই বের হয় ওরা। তবে আজ গোপন সূত্রে খবর পেয়ে শ্রমণার ইচ্ছাকে স্বাগত জানাতে নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষারত মৃন্ময়। মুখোমুখি দুজন। কাকা আর বোন পাহারায় যাতে পরিচিত কারো নজরে না আসে। কিছুক্ষণের বাক্যালাপ। এই কিছুক্ষণ দুটি অতৃপ্ত হৃদয়ের না পাওয়ার করুণ আকুতি একটু হলেও যেন শান্তি পেল । মৃন্ময় বেশিক্ষণ দাঁড়াল না।শুধু শ্রমণার হাত ধরে কী যেন বলল। তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেল সাইকেলে উল্টোপথে। শ্রমণার বুকের কষ্টটা এতদিন চাপা ছিল হতাশার পাহাড়ে।আজ যেন আবার কেমন বেড়ে উঠল।
শ্রমণা আর মৃন্ময় ছোটোবেলার বন্ধু ,একই পাড়াতে থাকে। শ্রমণা নিজের বাড়িতে আর মৃন্ময় মামারবাড়িতে। শ্রমণার বাবার পাইকারি ব্যবসা। বাজারে বড়ো মুদির দোকান । সাথে আছে সুদের কারবার। পাড়ায় 'বড়ো বাড়ি' বলে পরিচিত ওদের দোতলা বাড়িটা। দু বছর বয়সে মাকে হারানোর পর মৃন্ময়ের ঠাঁই হয় মামার বাড়িতে। বাবা আবার সংসার পেতেছেন। দিদিমা আর একমাত্র মামার সান্নিধ্যেই বড়ো হয়ে ওঠে মৃন্ময়।মামার ছোটোখাটো একটা কাপড়ের ব্যবসা, মধ্যবিত্ত পরিবার।
শ্রমণা অপরূপা, মৃন্ময়ও সুন্দর। দুজনেই ধীর,স্থির, মিতভাষী--বেশ মানানসই। কিন্তু একদিন এসব নিয়ে কেউ ভাবতো না। ওরা দুজন ছোটো থেকে একই ক্লাসে পড়েছে। প্রাইমারি থেকে হাই স্কুল--হাই স্কুল থেকে কলেজ। যখন হাইস্কুলে পড়ত এই মেঠোপথ ধরেই স্কুলে যেত। দুই দিকে মন দোলানো ধানের ক্ষেত, দূরে দু-একটা দোচালা বাড়ি, রাস্তার ধারে ছোটো ছোটো ডোবা আর তাতে নিশ্চিন্তে ভেসে বেড়াতো রংবেরঙের হাঁসের দল।প্রকৃতির অকৃত্রিম মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে যেত ওদের অনুপম বন্ধুত্ব। স্কুলে যাওয়া,টিফিন খাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান--সবকিছুতেই ওরা ছিল জুটি।ইতিমধ্যে কেটে গেছে বেশ কয়েকটি বছর। দুজনেই বড়ো হয়ে উঠেছে। হাই স্কুল থেকে কলেজে ভর্তি হয়েছে। বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে না কলেজ--মিনিট কুড়ির হাঁটাপথ।পাড়ার আরো কয়েকজনও কলেজে ভর্তি হয়েছে।শ্রমণা এখন বেশ সুন্দরী। ওর মা এখন আর ওকে একা ছাড়তে চান না। তাই কাকা মাঝে মাঝে সাথে যান। তবে ফেরার সময় অন্যদের সাথেই ফেরে সে।
আজকাল শ্রমণা যেন নিজের মধ্যে কেমন একটা পরিবর্তন অনুভব করছে। সব সময়ে মৃন্ময়ের কথাই মনের মধ্যে যেন পাক খাচ্ছে।মৃন্ময় একদিন কলেজে না এলে শ্রমণার একদম ভালো লাগে না। পড়ায় মন বসে না। রাতের ঘুমেও মৃন্ময়ের মুখ।
শ্রমণার মা সুচরিতাদেবী ভীষণ দাম্ভিক ও রাগী। নিজে যেটা বলেন সেটা করেই ছাড়েন। বাড়ির সবাই তাকে এক প্রকার ভয়ই পায়।শ্রমণার বাবা দিবাকরবাবু বুদ্ধিমতী গিন্নির হাতে সংসার ছেড়ে নিশ্চিন্তে ব্যবসায় মনোযোগী।একদিন উদাসীন শ্রমণার মাথায় সজোরে ধাক্কা দিয়ে ওর মা বললেন--কি বইয়ের পড়া বুঝি ওই গাছের ডালে লেখা আছে?পাখি গুনছো?কটা এসেছে আর কটা আসবে?অনেক হয়েছে।আমি পই পই করে বারণ করেছিলাম--মেয়েকে কলেজে পড়ানোর দরকার নেই ,মেয়ে সন্তান এত পড়ে কী হবে? কেউ শুনল না আমার কথা। তারপর বড়ো বড়ো চোখ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন--এই যদি পড়ার শ্রী হয় তাহলে পরীক্ষায় নম্বর বাড়বে না শুধু বয়স- টাই বেড়ে যাবে।আজই নমিতাকে বলে ঘটককে খবর পাঠাতে হবে। মান থাকতে চার হাত এক করি বাবা নাহলে কবে আবার........
শ্রমণা মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে-- মাগো আমি পড়াশুনা করব তুমি পিসিকে কিছু বলো না। সত্যি বলছি মা আমি কারো কথা ভাবছি না। কার কথা ভাববো বলো?
-------হ্যাঁ,আমারও তো সেটাই প্রশ্ন--কার কথা ভাবছিস তুই?
মাস দুয়েকের মধ্যে পরপর বেশ কয়েকজন পাত্রপক্ষ শ্রমণাকে দেখে গেলেন। সবারই মেয়ে পছন্দ কিন্তু কোথাও পাকা কথা বলেননি শ্রমণার মা। শ্রমণা ভাবল--না,এবার মৃন্ময়কে না জানালে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে।কলেজে একদিন সব বলল মৃন্ময়কে।শেষে বলল--আমি তোকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। তুই পারিস না আমাকে বিয়ে করতে?
মৃন্ময় চুপ করে থাকে।হয়তো এই কষ্টটা ওরও চেনা। তবুও পাহাড় সমান প্রতিবন্ধকতার কথা ভেবে নীরব কিছুক্ষণ। তারপর শান্ত ভাবে বলে-- আমাকে বিয়ে করলে তোর বাড়ি থেকে মেনে নেবে না। আমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই। তাছাড়া আমি এখনও বেকার। একই পাড়াতে থাকি। কেউ জেনে শুনে এই বিয়ে মেনে নেবে কি? নেবে না। তুই এসব এখন ভাবিস না।বরং বাড়ির সবাইকে বুঝিয়ে বল যে তুই আরো পড়তে চাস।কাকাকে জানা সব কথা। উনি অন্তত বুঝবেন তোকে।
--------- নারে, আমাদের বাড়িতে মা-ই শেষ কথা বলে তা তুইও তো জানিস। আর মা যখন বলেছে যে আমাকে বিয়ে দেবে তো দিয়েই ছাড়বে।
একরাশ হতাশা নিয়ে এভাবে আলাপ-আলোচনা চলে কিছুক্ষণ। কলেজ থেকে যে যার বাড়ি ফিরে আসে।মনের মধ্যে এক ভীষণ অস্থিরতা। দুজন ক'দিন ধরে কী ভাবল কে জানে!এক মাস পর একদিন কয়েকজন কলেজের বন্ধুকে নিয়ে কলেজ থেকে মাইলখানেক দূরে এক কালী মন্দিরে গিয়ে ওরা বিয়ে করে।হাতে সাদা শাঁখা,লাল পলা, পরনে দামি সিল্কের শাড়ি--শ্রমণাকে এদিন ভীষণ সুন্দর লাগছিল।চোখ সরানো যাচ্ছিল না।মৃন্ময়ও সুন্দরী বউ পেয়ে বেশ খুশি। সবাই মিলে মিষ্টিমুখও হল।এরপর একটা ট্যাক্সি চেপে মৃন্ময় শ্রমণাকে নিয়ে বাড়ি আসে বিকেলে। বন্ধুরা ইচ্ছে হলেও ওদের সাথে আসেনি কারণ শ্রমণার মাকে সবাই ভয় পায়। ওনার মেয়ের এরকম পালিয়ে বিয়ে করাকে প্রশ্রয় দেওয়ায় কী শাস্তি জুটবে কপালে তাই-ই ভাবছে ওরা।যাইহোক গাড়ির আওয়াজে মৃন্ময়ের দিদিমা বাইরে এসে ওদের দেখে তো হতবাক। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ওদের দুজনের মধ্যে যে একটা ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে তা তিনি বুঝতেন তবে এভাবে কাউকে কিছু না বলে বিয়ে করে বাড়ি আসাতে তিনি কেমন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।মৃন্ময়ের কাকা সমীরবাবু বাড়িতে নেই। ক'দিন হলো শ্বশুরবাড়ি গেছেন সপরিবারে। শেষে মৃন্ময়ের কথামতো নতুন বউকে বরণ করে ঘরে তুললেন দিদিমা।
নাতি-নাতবৌকে ঘরে রেখে তিনি বাইরে উঠোনে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন কী ভয়ানক কান্ড হতে চলেছে ভেবে। হয়তো তিনি ভীষণ ভীত-সন্ত্রস্ত। এদিকে একান্ত নিরিবিলিতে ভয়, লজ্জা ভুলে মৃন্ময় আর শ্রমণা একে অপরের আলিঙ্গনে আবদ্ধ। চেনা মানুষের অচেনা অন্তরের আদান-প্রদানে বেশ তৃপ্ত দুটি তরুণ মন। যেন এক কাঙ্ক্ষিত কল্পনার বাস্তব রূপায়ন।
তবে একান সেকান করে ওদের বিয়ের খবরটা বড়ো বাড়িতে পৌঁছাতে সময় লাগে নি। সাত-আট জন সৈন্য নিয়ে সেনাপতি যুদ্ধ যাত্রা করলেন। লম্বা লম্বা পা ফেলে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে সবাই। দরজার বাইরে থেকে মৃন্ময়ের দিদিমা ডাকলেন--বাবু, শ্রমণার মা আসছে সাথে অনেক লোকজন। ঘর থেকে মৃন্ময় বলল--ঠিক আছে আসুক, তুমি পাশের ঘরে চলে যাও। আমি কথা বলব। ------কী করবে?আমরা প্রাপ্তবয়স্ক, বিয়ে করতেই পারি। এতে মা-বাবার কী বলার আছে? শ্রমণা একথা বলে মৃন্ময়কে সাহস দেয়।তারপর আসন্ন ঝড়ের গতি বুঝতে ঘরের মধ্যে চুপ করে থাকে ওরা। সুচেতনাদেবী একেবারে ভৈরবী রূপে মৃন্ময়ের বাড়িতে এসে জোরে জোরে মৃন্ময়কে ডাকতে থাকেন। দরজা বন্ধ দেখে ভেঙে ফেলতে হুকুম দেন। সঙ্গের শাকরেদরা জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করে। অবস্থা বেগতিক বুঝে মৃন্ময় দরজা খুলে দেয়।শ্রমণার মা তীব্র বেগে ঘরে ঢুকে মেয়ের হাত ধরে খাটের গায়ে ধাক্কা দিয়ে শাঁখা-পলা ভেঙে দিলেন। তারপর হাত দিয়ে ঘষে যতটা পারেন সিঁথির সিঁদুর তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন।
শ্রমণা বলল-- এ কী করছো তুমি? আমি বড়ো হয়েছি মা।
-----------সপাটে মেয়ের গালে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে হাত ধরে টেনে বাইরে বেরিয়ে আসলেন আর মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বললেন---তুমি এত বড় বিশ্বাসঘাতক তা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। তুমি জানো না তোমাদের সাথে আমাদের গোত্র মেলে না? তুমি শ্রমণার ভালো বন্ধু ভাবতাম। তোমার মা নেই বলে তোমাকে ভালোবাসতাম। আমার বাড়িতে গেলে যত্ন করে খাওয়াতাম। আর তুমি আজ আমাদের এত বড়ো সর্বনাশ করলে? আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের ভিন গোত্রে বিয়ে হয় না--একথা বলে মেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলেন।
মৃন্ময় যেন পাথর হয়ে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। জীবনে এত বড়ো ভুল করে ফেলল! নিজেকে ধিক্কার দিল মনে মনে। দিদিমা এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন---কেন তুই ওই বড়ো বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করলি? জানিস না ওদের কত পয়সা? আমাদের মত গরিব ঘরে কি ওরা মেয়ের বিয়ে দেয়?
মৃন্ময় কোনো কথা বলল না। চুপচাপ খাটে বসে পড়ল। সারা পাড়ার উপর দিয়ে যেন কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেল। সকলের যেন মৃন্ময়ের জন্য কেমন কষ্ট হচ্ছে। মা-বাবা নেই, শান্ত স্বভাবের ছেলেটা এরকম একটা কান্ড ঘটিয়ে বসল! বড়ো বাড়ির বড়ো বউ-এর এই দম্ভের পরিণাম ভালো হবে না দেখে নিও---ওই বাড়ির উপর বীতশ্রদ্ধ কয়েকজন মহিলার এরকম মন্তব্যও শোনা গেল। কয়েকজন প্রতিবেশী আবার মৃন্ময়ের বাড়িতে গিয়ে ওকে বোঝাতে থাকেন যাতে মন্দ কিছু না ঘটিয়ে বসে ছেলেটা।মৃন্ময় একেবারে চুপ। শুধু শুনেছে সবার কথা, কোন উত্তর দেয়নি।
রাতে শ্রমণার উপর কী অত্যাচার চলেছে সেটা শ্রমণাই জানে। পরদিন ভোরে সপরিবারে বেরিয়ে পড়েন সুচেতনাদেবী প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে কোলকাতায় ননদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওখান থেকেই পাত্র দেখা শুরু হয় এবং কয়েক দিনের মধ্যেই শ্রমণাকে পাত্রস্থ করা হয়। ছেলে নাকি ওদের দূর সম্পর্কের কেমন আত্মীয় হয়। বিয়ের পর শ্রমণার বাবা আর কাকা বাড়ি ফিরে আসেন। মাস তিনেক পর মেয়ে, জামাই আর ছোটো মেয়েকে নিয়ে ফেরেন সুচেতনাদেবী। ভীষণ হাসি খুশি যেন কিছুই ঘটেনি। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনে পরিপূর্ণ। সারা পাড়া নিস্তব্ধ।সবার মনে যেন একটাই কথা--পয়সা থাকলে মানুষ কি না করতে পারে!
এদিকে মৃন্ময় নিজেকে অনেকটা শক্ত করে নিয়েছে। আর কষ্ট হয় না ওর। কেন কষ্ট হবে? যে শ্রমণা বলেছিল মৃন্ময়কে ছাড়া বাঁচবে না, সেই যদি আবার বিয়ে করে সংসার করতে পারে তাহলে ও কেন কষ্ট পাবে? অবশ্য এ ব্যাপারে মৃন্ময়ের মামার ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ি ফিরে সব শুনে একটুও ভেঙে পড়েননি বা মৃন্ময়কে বকাবকি ও করেননি। বরং নিজের ব্যবসার সঙ্গী করে নিয়ে কাজে ব্যস্ত রেখেছেন ছেলেটাকে। ভুল মানুষ মাত্রেরই হয়--এটা নিয়ে ভাবিস না, এগিয়ে চল--এরকম নানা কথা বলে মৃন্ময়কে বোঝাতেন। এ ভাবে দিন কাটতে থাকে। বছর দুই পরে শ্রমণা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। তবে ছেলে হওয়ার পর শ্রমণা বাপের বাড়িতেই থেকে যায়। ওর স্বামী মাঝে মাঝে আসতেন। ছেলেটি দাদুর বাড়িতে পরম আদরে বড়ো হতে থাকে। একই পাড়াতে থাকলেও কোনোদিন মৃন্ময় শ্রমণার সামনে আসেনি। বরং যে পথে চললে শ্রমণার ছায়াও চোখে পড়বে না সেই পথ ব্যবহার করত।
শ্রমণার মা মেয়েকে নিয়ে চিন্তামুক্ত কারণ মেয়ে এখন ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে বেশ সংসারী। বাপের বাড়িতে থাকে। অলস সময় আর কাটতে চায় না। শেষে শ্রমণার কাকা কোলকাতায় একটি বেসরকারি সংস্থায় ওর চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। কাকা যদিও চাকরি করেন না, পরিবারের ব্যবসাই দেখাশোনা করেন দুই ভাই মিলে। বিয়ে করেননি।শ্রমণা এখন রোজ সকালে বেরিয়ে যায় আর রাতে ঘরে ফেরে। বেশ খুশি খুশি লাগে ওকে এখন।দেখতে দেখতে ছেলের বয়স আট বছর হল। স্কুলে যায় রোজ। ভারী মিষ্টি দেখতে হয়েছে।
তবে মৃন্ময় আর বিয়ে করেনি।সারাদিন কাকার সঙ্গে থাকে ব্যবসা নিয়ে আর সন্ধ্যায় পাড়ার ক্লাবে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়-- এই ভাবেই দিন চলে যায়।একদিন ক্লাবে যাওয়ার পথে হঠাৎ শ্রমণার বোন সুতপা এসে হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে বলল---মৃন্ময়দা, দিদি পাঠিয়েছে, কাউকে বলো না প্লিজ। আমি আসছি--বলে দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির দিকে চলে গেল।
------এতদিন পর আবার শ্রমণা! বুকের ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। খুলব চিঠিটা, না ফেলে দেবো? না, খুলেই দেখি। এইসব ভেবে শেষে চিঠিটা খুলে দেখে তাতে সেই পরিচিত হাতের লেখা---তোকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। কাল বিকেল 5 টা 30 মিনিটে পঞ্চানন স্কুলের কাছে আসিস যদি আমায় ক্ষমা করে থাকিস।
এই স্কুলটার সাথে ওদের অনেক আবেগের সম্পর্ক। ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত এই স্কুলেই পড়েছে যে। বুকের মধ্যে যেন একটা অস্ফুট কান্না অনুভব করল। না, কাঁদবে না একদম। পুরুষ মানুষ চোখের জল মানায় না। চিঠিটা শতখণ্ড করে ছিঁড়ে ফেলে দিল। হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি বুকে আঁকড়ে রেখে আর কষ্ট পেতে চায় না ও। ক্লাবে বেশিক্ষণ কাটালো না সেদিন মৃন্ময়।সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। কী করবে? যাবে দেখা করতে? আবার কোন অশান্তি দানা বাঁধছে না তো? কিন্তু এতদিন পর শ্রমণার মুখটা একবার দেখার লোভটাও সামলাতে পারছে না। চোখের সামনে শাঁখা-সিঁদুর পরা সেই চকচকে সুন্দর মুখটাই বারবার ভেসে আসছে।
----আজও শ্রমণা সেইরকম সুন্দরী আছে?ঠোঁটে আজও হালকা লিপিস্টিক দেয়? সেই পারফিউমটাই ব্যবহার করে যেটা আমার পছন্দ নাকি এখন অন্য......।আমি ঠিক আছি তো? আমার মুখের দাঁড়ি বোধহয় ওর ভালো লাগবে না। সকালে সেলুনে যেতে হবে---এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে রাতটা কখন শেষ হয়ে গেল। সারাদিন আলমারি খুলে জামাকাপড় ঘাটাঘাটি করল আর কী যেন ভেবে চলল মৃন্ময়ের অস্থির মন। অবশেষে একটা সাইকেল নিয়ে নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট স্থানে।
শ্রমণা আসছে। অনেকটা পিছনে দাঁড়িয়ে ওর কাকা আর বোন সুতপা। শেষ আলিঙ্গনের মর্মস্পর্শী স্পর্শ আজ আবার কেমন সারা শরীরে প্রচ্ছন্ন আবেশ ছড়িয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের দেখা। কী ভীষণ মায়াময় চোখ দুটো একে অপরের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্থির। মুহূর্তে সামলে নিয়ে বাক্যালাপ। সে বাক্যালাপের সাক্ষী ছিল সেই মেঠো পথ, সবুজ ঘাস, অনন্ত আকাশ আর হৃদয় দোলানো বাতাস।
আজকাল শ্রমণার ফিরতে একটু রাত হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে বলে অফিসে একটু চাপ আছে। যেহেতু ছেলের জন্য ওকে কিছুই করতে হয় না সেই অর্থে তাই বাইরে বেশিক্ষণ থাকলেও দুশ্চিন্তা হয় না ওর। একদিন অনেক রাত হল। শ্রমণা ঘরে ফিরছে না। ফোন সুইচড্ অফ্। বাড়ির সবাই খুব চিন্তিত। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কোনো বিপদ ঘটল না তো? শ্রমণার বাবার শরীরটাও ভালো নেই। কাজের প্রচুর চাপ। রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন। বাচ্চাটাও ঘুমাচ্ছে। সুচেতনাদেবী বারবার দেওরের ঘরে যাচ্ছেন আর বলছেন---বিনয় কিছু একটা কর। বিনয় নির্বাক। ভাবছেন--- শ্রমণা আবার মৃন্ময়ের সাথে......না না, সে কী করে হয়?শ্রমণার ঘরে ছোটো বাচ্চা আছে, স্বামী আছে। এতদিন পর কেন ও মৃন্ময়ের সাথে থাকার কথা ভাববে---এসব ভাবতে ভাবতে হাতে ফোনটা তুলে---হ্যালো (নাম্বারটা শ্রমণাই দিয়েছিল) ।
-------হ্যাঁ, হ্যালো।
--------শ্রমণা কোথায়?
--------আমি মৃন্ময় বলছি।
--------জানি তুমি মৃন্ময়। তাই তো বলছি শ্রমণা কোথায়? মৃন্ময় কথা না বাড়িয়ে ফোনটা শ্রমণার হাতে দিল। শ্রমণা ফোনটা হাতে নিয়ে -----হ্যালো।
-----এই তোরা কোথায় আছিস রে? এত রাতে ফিরবি কী করে?
-----আমি আর বাড়ি ফিরব না কাকা।
-----মানে?
-----হ্যাঁ কাকা, আমি আর অভিনয় করে মিথ্যে সংসারের চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে পারছি না। বাবানকে তোমরা দেখো। আমি মৃন্ময়ের সাথে কোলকাতায় থেকে যাব।
-----তোর মাথা ঠিক আছে তো? কোলকাতায় কোথায় থাকবি?
-----এখানে মৃন্ময়ের বন্ধুর একটা ফ্ল্যাট আছে। কেউ থাকে না। আমরা আপাতত ওখানেই আছি।
-----ঠিক আছে আজ রাতটা থেকে কাল বাড়ি ফিরে আয়। দেখ লোকে কী বলবে বল তো। তোর স্বামী আছে, সন্তান আছে।
-----লোকের কথা কি তোমরা ভেবেছিলে? তাছাড়া প্রতাপকে আমার একদমই পছন্দ ছিল না। মা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। আমায় আর ফোন করো না। আর হ্যাঁ এবার যদি তোমরা মৃন্ময়ের বাড়িতে গিয়ে কোনো ঝামেলা করার চেষ্টা করো তার ফল ভালো হবে না বলে দিলাম।
ফোনটা কেটে দিল। শ্রমণার কাকা বিনয় ধপ্ করে বিছানায় বসে পড়লেন, যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল মাথায়। মৃন্ময়ের বাড়ি থেকে শ্রমণাকে জোর করে বের করে নিয়ে আসাটা তিনি ভালোভাবে নেননি ঠিকই তবে মাতৃসমা বৌদিকে কিছু বলতেও পারেন নি কারণ তিনি গুরুজন এবং মা-বাবাকে হারানোর পর এই বৌদিই তাকে মাতৃস্নেহে বড়ো করেছেন।মৃন্ময়ের সাথে যদি মাঝে মাঝে কথা বলে তাতে দোষের কী আছে বরং উভয়ের মনটা একটু হালকা হবে--এই ভেবে তিনি ওদের দেখা করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন কিন্তু তার পরিণাম যদি এই হয় তাহলে.........
শ্রমণার মা হন্তদন্ত হয়ে বিনয়ের ঘরে আসতেই---বৌদি শ্রমণা আর ফিরবে না। মৃন্ময়ের সাথেই থাকবে কোলকাতায়।
-----মানে?
জ্ঞান হারালেন সুচেতনাদেবী। সুতপা মায়ের চোখে মুখে জল দিতে থাকে। জ্ঞান ফিরতেই সুচেতনাদেবী হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন----জামাইকে কী বলব? আত্মীয়-স্বজন,প্রতিবেশীরা কী বলবে---এই ভেবে তার কান্না আর কিছুতেই থামছে না।পরদিন সবাই আলোচনা করে জামাই প্রতাপকে ডাকলেন।প্রতাপবাবু দিদির বাড়িতে থাকেন। মা-বাবা কেউ নেই।অপ্রত্যাশিত এই খবর শুনে হতভম্ব তিনি। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। শুধু শাশুড়ি কে বললেন যে বাচ্চাকে নিয়ে চলে যেতে চান। তা শুনে শাশুড়ি ঘনঘন জ্ঞান হারাতে থাকেন। শেষে বাড়ির সকলের অনুরোধে তিনি শ্বশুর বাড়িতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নেন।বাচ্চাটা কয়েকদিন মা-মা করল ঠিকই কিন্তু আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে গেল আবার।
শ্রমণা আর মৃন্ময় কোলকাতাতেই আছে। দুজনে একই অফিসে কাজ করে। শ্রমণাই ঢুকিয়ে দিয়েছে চাকরিতে মৃন্ময়কে। বেশ চলছে সংসার। এক বছর পরে শ্রমণা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়।মেয়ের বয়স ছ-মাস হলে শ্রমণা আবার কাজে যোগ দেয় কয়েক মাসের ছুটির শেষে।বাচ্চা আয়া মাসির কাছে থাকে।মেয়ের বয়স যখন ন-মাস একদিন দুজনে বাড়ি ফিরে এসে দেখে মেয়ের ভীষণ জ্বর।মৃন্ময় বোঝে বাচ্চার দেখাশোনা ভালো হচ্ছে না। তাই রাতে শ্রমণাকে বলে---তুই চাকরিটা ছেড়ে দে। মেয়েটা একটু বড়ো হলে না হয়.......
-----কেন? শ্রমণা রেগে উত্তর দেয়।
-----মেয়ের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না। ------চাকরি করা লোকেদের বাচ্চারা এইভাবেই বড়ো হয়। সহ্য করতে না পারলে তোকে চাকরিটা ছাড়তে হবে।
-----আমি বাড়ি বসে বাচ্চা দেখাশোনা করলে লোকে বলবে---ঐ যে বউ-এর পয়সায় বসে বসে খাচ্ছে। বরং তুই থাকলে এসব কথা উঠবে না।
------লোকে কী বলবে সেটা ভাবলে আমি এখন তোর সঙ্গে এক ছাদের নীচে থাকতাম না।
এইভাবে মাঝে মাঝে চাকরি নিয়ে ওদের দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি চলতে থাকে। একদিন অশান্তি চরমে ওঠে। নিজেকে আর সামলাতে পারেনি মৃন্ময়---সজোরে শ্রমণার মুখে চড় কষিয়ে দেয়।শ্রমণা মুখে হাত দিয়ে বসে পড়ে--স্থির দৃষ্টি মৃন্ময়ের দিকে। মৃন্ময় বুঝল যে রাগের বশে ও একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইল। কিন্তু শ্রমণার যুক্তি--তোর হাত যখন একবার উঠেছে আমার গায়ে আগামী দিনে বারবার উঠবে। আর আমি কারো অত্যাচার সহ্য করে সংসার করতে পারব না। তোরা সব ছেলেরাই সমান--টাকার এপিঠ আর ওপিঠ।মেয়েদের স্বাধীনতা তোরা মন থেকে মেনে নিতে পারিস না। আসলে সমস্যাটা মেয়েকে নিয়ে নয়,আমাকে নিয়েই। অফিসে সবাই আমার কাছে এসে মাঝে মাঝে আড্ডা মারে,গল্প করে সেটা তুই মেনে নিতে পারছিস না। আমি বুঝি সব। আমি আজই কাকাকে বলব।
মৃন্ময় অনেক বার অনুরোধ করলো বাড়িতে না জানানোর জন্য কিন্তু শ্রমণা শুনল না। পরদিন কাকাকে সব জানাল মৃন্ময়ের অনুপস্থিতিতে। স্বামী-সন্তান রেখে মৃন্ময়ের সঙ্গে থাকাটা কাকা একেবারেই মেনে নেন নি। তাই তিনি শ্রমণাকে জানিয়ে দিলেন-- এ ব্যাপারে তার কিছুই বলার নেই।
শরীর ভালো নেই বলে শ্রমণা সেদিন অফিসে গেল না।মৃন্ময় রাতে ফিরে দেখে ঘরে তালা ঝুলছে।নিজের কাছে থাকা অতিরিক্ত চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে দেখে চারদিক কেমন ফাঁকা ফাঁকা । খাটের উপর একটা ডায়েরি রাখা।সেটা খুলে দেখে তাতে লেখা---এতদিনে বুঝলাম ছোটোবেলায় একসাথে খেলা করা, একসাথে স্কুলে যাওয়া, এক টিফিন বক্সে হাত ঢুকিয়ে টিফিন খাওয়া আর জীবন- যুদ্ধে একসাথে এগিয়ে চলা এক জিনিস নয়। আজ ফিরে যাচ্ছি আমার বাপের বাড়ি-------------শ্রমণা।
মৃন্ময়ের খুব কষ্ট হচ্ছে বিশেষ করে মেয়ের জন্য। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সামান্য একটা ভুলের জন্য এভাবে সংসারটা ভেঙে যাবে ভেবে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল চাপা স্বভাবের ছেলেটা। কী বলবে বাড়িতে? এদিকে শ্রমণাকে দেখে ওর ছেলে ভীষণ খুশি। আর মায়ের কোলে ছোট্টো বোনকে পেয়ে তাকে নিয়ে কী আদর! মা-বাবা কাকা সবাই ঘরে ডেকে নিলেন শ্রমণাকে। হাজার হলেও সন্তান তো! প্রতাপবাবু কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ঘরেই ছিলেন। স্ত্রীর সামনে যান নি। তবে বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে খেলতে দেখা গেল একসময়।
দিন অতিবাহিত হতে থাকে। একদিন শ্রমণা আর মৃন্ময়ের ডিভোর্স হয়ে যায়। মৃন্ময় মামার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে নতুন করে প্রেমের সংজ্ঞা খোঁজে।
শ্রমণা বড্ড একা হয়ে যায়। সবাই যেন তাকে কেমন এড়িয়ে চলে। তবে সে যে মস্ত বড়ো ভুল করে ফেলেছে তা বুঝে সবার সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক করে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। আর রোজ বিকেলে হাঁটতে বের হয় সেই মেঠো পথ ধরে--একা--এক্কেবারে একা।
হয়তো মনে মনে সেই সুন্দর ছোটোবেলায় রোজ একবার ঘুরে আসে।ওই মধুর স্মৃতিগুলোই হয়তো ওর বেঁচে থাকার প্রেরণা। জীবন তো আর থেমে থাকে না।।
---------------------------------