চিত্তরঞ্জন গিরি
"ছেলেটা চলে গেল আমেরিকায়। বড্ড একা লাগছে। কত করে বুঝালাম একটু কম টাকা হলেও এইখানে চাকরি কর। কে শুনে কার কথা।" বাড়ির ওঠানে প্রফুল্ল গারু হুকোর শেষ টান দিয়ে পাশে রেখে আনমনা হয়।
তা দেখে পাশে বসে থাকা রসুল বলে "কাকু আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। অনেক বেশি পড়াশোনা করেছে। তাই বিদেশে গেছে। আপনারও তো গর্ব হচ্ছে। প্রায় সবাই বলে বেশি পড়াশোনা করে প্রফুল্ল বাবুর ছেলে আমেরিকায় চাকরি করে।"
কথাটা শুনে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রফুল্ল। মাথা নেড়ে হাঁ বলল। "তোরা বুঝবি না যন্ত্রণাটা কি ?"
রসুল বলে "আমি অনেকটাই বুঝি। ২৫ বছর ধরে তোমার বাড়িতে চাষের কাজ করছি। কিছুটা হলে তো বুঝি। ছেলের জন্য কিইনা পরিশ্রম করেছ। অনেক জমি জায়গা বিক্রি করেছ।"
কথাটা শুনে মুখ থেকে দুঃখের হাসি গড়িয়ে পড়ে।
দুশ্চিন্তার মেঘ গুলো চোখেমুখে গ্রাস করে ফেলেছে। স্ত্রী বাসন্তী যদি থাকতো অনেকটা হলেও দুঃখ দুশ্চিন্তা কম থাকতো। তাকে অতটা দুশ্চিন্তা পেতে হয়নি। যতদিন সে বেঁচে ছিল, ছেলে কন্টাইতে চাকরি করতো। তখন ঘরের সুখ-শান্তি সবই ছিল। ওর মৃত্যুর দু'বছর পর বিদেশে চলে গেল। বারবার করে যেতে না বলতেই ও ঘরে অশান্তি করল। এখানে সে বেশ ভালো টাকারই বেতনে চাকরি করতো। তাতেই এত বড় বাড়ি তৈরি করতে পারলো। এত বড় বাড়ি আজ যক্ষের মতো পাহারা দিচ্ছি। তখন ঘর ছিল টালির ।বৃষ্টি হলে জল পড়তো। একটু বাতাস জোরে বইলে জড়োসড়ো হয়ে সবাই এক জায়গায় বসে থাকতাম। তবুও তখন হাসিখুশি ছিলাম। কিন্তু আজ! ভাবতে ভাবতে দুশ্চিন্তা যেন চোখ মুখকে গ্রাস করে নিচ্ছে।
প্রফুল্লের চোখ মুখের ভাব দেখে বলে"ওইসব না ভেবে ,বল, কালকে বরজের পশ্চিম দিকে ওই জায়গাটায় কি বীজ ফেলে দেবো ?
--না। আগে ওই স্যালুর কাছে যে তিন বিঘায় পাওয়ারটেলার দিয়ে মাটিটা কুপিয়ে নে। তারপর অন্যটা ভাবা যাবে।
---ঠিক আছে।
রসুল চলে যাওয়ার পর ঘরের মধ্যে ঢোকে। দেয়ালের গায়ে স্ত্রীর ছবি দেখে দাঁড়িয়ে যায়। একদৃষ্টিতে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। বাসন্তী যতদিন ছিল শান্তিতে ছিল। ছোটখাটো বাকবিতণ্ডা লেগেই থাকত। তবুও ঘরে বিশাল শান্তি ছিল। একমাত্র নাতিটা আমার সাথে ছোটাছুটি করতো। স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনেকটা দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছিল। আজ সেও নেই। বাবা-মার সাথে বিদেশে। কতবার মানা করলো ছেলেকে। কিন্তু না একটুও মন গললো না। রেগে গিয়ে ছেলে বলে "জমি বিক্রি করে এত টাকা দিয়ে আমাকে পড়ালে এইখানে কি আটকে রাখার জন্য ? কথাটা শুনে চুপ থেকে যায় প্রফুল্ল। অশান্তি আর বাড়াতে দিল না। ভাবতে গিয়ে চোখের এক ফোটা জল বেরিয়ে আসে। ওখান থেকে সরে যায়। আবার কাজে নিজেকে নিয়োগ করে।এই রসুল ও সিরাজদের নিয়ে একসাথে কাজে থাকে বলে সময়টা খানিকটা কেটে যায়। এরাই তার আপনজন।
দুপুরে খেতে খেতে এখন তার প্রায় মনে পড়ে । খাবার সময় ছেলেকে পাশে বসিয়ে প্রায় নিজের পাতে মাছ বা ভালো খাবার তার পাতে তুলে দিতো। সে আনন্দে খেয়ে নিতো। কোন কোন দিন অন্যমনস্ক হয়ে ছেলের পাতে দিতে ভুলে গেলে, ও তাকিয়ে থাকতো বাবা কখন দেবে। যখন ছেলে বড় হয়ে যায় তখন তার পাতে খাবার দিলে যখন খুশিতে খেয়ে নিত তখন তার মা বকুনি দিয়ে বলতো এত বড় হয়েও বাবার কাছ থেকে নিচ্ছ। মায়ের কথায় মুখ শুকনো করে ফেললে বাবা বলতো ছেলে যত বড়ই হোক না কেন আমার কাছে সব সময় ছোটই ।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখে জল চলে আসে।
এমনি করে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। বর্ষা গেল শরৎ এলো। মাঠে মাঠে কাশ ফুল ফুটল। শিশিরে শিশিরে আগমনীর বার্তা। বাবা ফোন করে নাতি বৌমাকে নিয়ে আসতে বললে ছেলে বলে "বাবা আমি প্রতিমাসে টাকা অ্যাকাউন্টে পাঠাচ্ছি। সব পাচ্ছ তো? বাবা বলে--"টাকা আমার দরকার নেই। একবার তোরা আয়।" ছেলে বলে- এখানে প্রচুর ব্যস্ত কাজ আমার প্রচুর। তোমার নাতিও পড়াশুনায় ব্যস্ত। পরে সময় করে যাব।"
পরে ওর আর সময় আর হয় না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে প্রফুল্লর।
চোখের জল পড়তে পড়তেই মানুষের মন শক্ত হয়ে যায়। প্রায় সময় প্রফুল্ল- রসুল সিরাজ গদাইয়ের ছেলে মেয়েদের হাতে টাকা ধরিয়ে দেয়। পুজোর সময় কাপড়। বা তাদের দরকার মতো বই খাতা পেন কিনে দেয়। বাড়ির বাগানের সবজি অনেক সময় এমনি ওদের হাতে দিয়ে দেয়। কাজের সময় ছাড়াও ওরাও যখন তখন ছুটে আসে।
সিরাজ তো যখন তখন বলে "কাকু, আমার মা-বাবা নেই। আপনি আমার মা-বাবা। আপনার বাড়িতে কাজ করি বলেই ছেলেমেয়ে বউকে নিয়ে স্বাচ্ছন্দে আছি।"
তার কথা শুনে রসুল বলে --আমার ক্ষেত্রেও সেই রকম। ঘরে ঘরে খাবার অভাবে ভিক্ষা করে করে বেড়িয়েছি। তা দেখে কাকুই আমাকে কাজ দিয়েছে। সেই বাচ্চা কাল থেকে।
ওদের কথা শুনে প্রফুল্ল বলে-তোরা আছিস বলেই তো এখনো বেঁচে আছি।
স্রোতের মতো সময় গড়িয়ে যায়। বার্ধক্য শরীরকে আরও ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। প্রেসার সুগার সব আঁকড়ে ধরেছে।
ছেলেকে বলে "বাবা শরীরটা আমার ভালো নেই। তোদেরকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। একবার আয়।"
ছেলে শুধু উত্তর দেয়" হ্যাঁ যাবো সময় পেলেই যাব। তুমি সাবধানে থাকো। সব সময় ডাক্তারের পরামর্শে চলো।"
ফোন কাটার আগেই বাবা বলে"এইটুকু যে বলেছিস আমার কাছে পরম প্রাপ্তি।"
এর দু তিন দিন কাটার পর সিরাজদের সাথে বাগান বাড়িতে কাজ করতে করতে চারদিকে অন্ধকার দেখে।হঠাৎ উল্টে পড়ে।সিরাজেরা সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার বাবু পালস দেখে বলে। না" হার্ট অ্যাটাক! "ডাক্তারবাবু বুকে অনেক মেসেজ করে কয়েকটা ইনজেকশন দেয়। তারপর সিরাজরা ডাক্তার বাবুর কথা মত হসপিটালে ভর্তি করান। হার্ট এর অবস্থা খুব খারাপ। সিরাজ, রসুল,দিনকে রাতকে দিন করে হসপিটালেই পড়ে আছে।
একটু সুস্থ হলে ছেলেকে দেখার জন্য বার পীড়াপীড়ি করে। সঙ্গে সঙ্গে ফোনের কানেকশন। বাবার কাতর উক্তি"একটিবার আয় খোকা। তোকে কাছাকাছি অনেকদিন দেখিনি। আমার দেখার খুব শখ। একটিবার বাবার কথা শোন।"
ফোনের ওপ্রান্তে ছেলের কণ্ঠস্বর "আমার সময় এখন হচ্ছে না। সুস্থ হয়ে নাও। আমি ঠিক সময় যাব । "
ফোনটা সিরাজের হাতে দিয়ে হাঁ করে আনমনা হয়ে তাকিয়ে রইল। চোখের কোল থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে জলধারা গড়িয়ে পড়তে থাকে।
"আমরা তো তোমার সন্তানের মত। কোন চিন্তা করবেন না। " কথাগুলো বলে সিরাজ, রসুল সান্ত্বনা দেয়।
তারপর কোন কথা নেই। শুধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকা। শরীরের অস্বস্তি যন্ত্রনা বাড়তে থাকে। ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করে।এমনি করেই চার পাঁচদিন কেটে যাওয়ার পর। চোখের দুটি তারা আকাশের দিকে স্থির হয়।
সিরাজেরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। রসুলরা ছেলের কাছে ফোন করে। সিরাজের মুখে সব শুনে ছেলে দুঃখ প্রকাশ করে। আসতে বললে"আমার সময় হবে না। তোমরা একটু সৎকারের ব্যবস্থা করে দাও। যা টাকার দরকার আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
রসুলরা বলে" টাকা আমাদের দরকার নেই।"
মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে সিরাজ রসুলরা" বলো হরি, হরি বোল। বল হরি ,হরি বল" বলতে বলতে বাঁশের দোলায় কাঁধে শবদেহ নিয়ে চোখের জলে শ্মশানের দিকে হাঁটতে থাকে।
-----------------------------
My address
Chitta Ranjan Giri
C-03 Sreenagar paschimpara panchasayar road
Post -panchasayar
Kolkata 700094
West Bengal India