ছবিঋণ- ইন্টারনেট
কাটা হাত
সংঘমিত্রা সরকার কবিরাজ
ইউ বীচ। কালকেও রাতে কেন হেনরী এসেছিলো? তোকে না বলেছি হেনরীকে ঘরে ঢুকতে দিবি না আমি না থাকলে। খুব আশনাই তার সাথে না? মেরে তোর আমি পিঠের চামড়া তুলে নেবো।হাতের বেল্টটা গুটিয়ে নিতে নিতে গর্জে ওঠে জর্জ।
"তুমি পাগল হয়ে গেছো। যন্ত্রনায় ককিয়ে ওঠে অ্যানা। হেনরী তোমারই ছেলে।এটা তারও বাড়ি।সে থাকতে চাইলে আমি বারণ করবো কোন অধিকারে? এটা আমার বাড়ি নয়? আমি কে ? তোমার রক্ষিতা মাত্র।তবে আর নয়।এবার আমি সত্যিই তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাই। আমি এখন বুঝতে পারি হেনরীর কথায় ঠিক।তুমি তার মাকে অত্যাচার করে তিলে তিলে খুন করেছো। তোমার এই বুদ্ধিজীবী সাম্মানিক পোশাকের আড়ালে একটা কদর্য নোংরা নিষ্ঠুর মন আছে।তুমি ভালোবাসতে জানো না। ভালোবাসা পাবারও তুমি যোগ্য নও। আর হ্যাঁ - হেনরী কাল এমনি এমনি আসে নি ,ও ওর প্রয়োজনীয় সমস্ত সার্টিফিকেট নিতে এসেছিলো।ওর পাসপোর্ট ভিসা সব রেডি। আমেরিকা চলে যাচ্ছে। ওখানেই সে একটা জব পেয়েছে এবং সেই সাথে বাকী স্টাডি সে ওখানেই করবে। এবং সে বলে গেছে আমেরিকাতেই সেটল হবে।কখনো আর ফিরবে না। যাবার আগে আমাকেও বলে গেছে - তুমিও পালাও ,নইলে বাঁচবে না। হ্যাঁ হেনরী আমাকে ভালোবাসে, তবে বন্ধু হিসেবে। আমি তার ক্লাসমেট ছিলাম। কীভাবে যে আমি তোমার ফাঁদে পড়লাম! তুমি একটি পশু।
নভেম্বরের হিম শৈত সকাল। জন-প্রাণী নেই রাস্তায়। পুলিশের টহলদারী বোটের তীব্র সাইরেন বেজে উঠলো।মইকা নদীর জল জমে বরফ। বোটের গতি ব্যাহত হচ্ছে।কখনো কখনো বরফ কেটে বোট এগোতে হচ্ছে। এই রকম অবস্থায় একজন লোক বরফের মাঝে আটকে গেছে। লোকটা অবশ্যই চুর মাতাল ছিলো। সেন্ট পিটাসবার্গের পুলিশ অনেক কসরৎ করে বরফ কেটে বৃদ্ধ লোকটাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করলো। তবে উদ্ধারের সময় তার পিঠে রাখা রুকস্যাকে একটি কম বয়সী মেয়ের কাঁধ থেকে কেটে নেওয়া হাত দেখে পুলিশ কর্তাদের আক্কেলগুড়ুম।
মার্চের শুরু। বসন্তের মৃদু বাতাস ওম ছড়াচ্ছে।চারিদিকে উৎসব উৎসব গন্ধ। পুরো একসপ্তাহের জন্য মসলনিটা উৎসব পালন হচ্ছে শহর জুড়ে। এই উৎসবটিকে প্যানকেক উৎসবও বলে। মূলত এই উৎসবে শীতের বিদায় এবং বসন্তের উদ্যান উদযাপনকে স্বাগত জানানো হয়। এক সপ্তাহ জুড়ে সর্বত্র কার্নিভ্যালের বন্যা। এই কয়দিন সকলেই দুধ ডিম আর প্যানকেকে মজে থাকবে। তাছাড়া সামনেই " মস্কো গোল্ডেন মাস্ক " উৎসব আসছে। দুই মাস ব্যাপী এই উৎসব চলতে থাকবে।পুলিশের এই সময় অবস্থা একেবারে বারো- ছড়াদ। আরও দায়িত্ব বাড়ে সেইসাথে পরিশ্রম। ' মস্কো - গোল্ডেন -ম্যাক্স' উৎসবে গোটা শহরে শৈল্পিক ক্রিয়াকলাপ বাড়ে। শহরের সর্বত্র অপেরাগুলো বল -ড্যান্সের প্রদর্শনী করে। এই উৎসবটি নাটকের প্রাচীন শিল্পের উপাসনা।
উৎসব মানে তো সাধারণ মানুষের ফূর্তি। আর পুলিশের জীবন কয়লা। সাধারণ মানুষ তো এমনিতেই পুলিশকে সম্মান করে না। এতটুকু ত্রুটি - বিচ্যুতির হলেই বাপ - মা এক করে দেয়। তারপর উৎসব মানেই তো ঘরের - বাইরে বের হয়ে প্রাণ ভরে মাতলামো করার অপরিমিত লাইসেন্স পেয়ে যায় সব । পুলিশের মানেই বদমেজাজী - ঘুষখোর - আরো কত কি ? এতকিছু সামলে ঠান্ডা মাথায় কাজ সামলানো কি চাট্টিখানি কথা। আর - চোর গুন্ডা হলে তবুও এরকম । কিন্তু যখন শহরের প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী যখন অপরাধীর আসনে বসে থাকে তাকে ইন্টারোগেট করা চাট্টিখানি কথা নয়। ইন্সপেক্টর মিস্টার লেবেদফ কাল রাত থেকেই নিজেকে অনেকরকম ভাবে শিখিয়ে পড়িয়ে তৈরী করেছে। আজ তাকে কোর্টে প্রোডিউস করতে হবে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ , নেপোলিয়ন বিশেষজ্ঞ মিস্টার সকোলোভকে। গত নভেম্বরে পুলিশ তাকে অর্ধমৃত অবস্থায় মইকা নদীর বরফজল থেকে উদ্ধার করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। সে ব্যাটা নাকি তার ছাত্রী অনাস্তশিয়া ইয়েশেঙ্কোকে রক্ষিতা বানিয়ে রেখেছিলো। নামেই প্রেম - প্রেম না ছাই। আরে বাবা যাকে তুই ভালোবাসিস তাকে তুই দুম করে মাথা -গরম করে মেরে ফেললি। একটা হাঁটুর বয়সী মেয়ে যে কিনা তার ছেলের বন্ধু ছিলো তুই বুড়ো ভাম হয়ে তার সাথে রাত কাটালি ফূর্তি করলি - প্রথামাফিক বিয়ের রাস্তা দিয়েই গেলি না- যদি সম্পত্তির ভাগীদার হয় যদি সম্মানে ভাগ বসায়।যত্তসব বুড়ো শকুন কোথাকার।ছেলেটাও তো বাপকে ছেড়ে চলে গেছে। তবুও বুড়োটার বজ্জাতি যায় না।কিছুতেই স্বীকার করে নি খুনের কথা ।সমানে প্রভাব খাটিয়ে গেছে কিভাবে পুলিশের ফাঁদ কেটে বেড়ানো যায়। তবে গত দুদিন ব্যাটাকে একটু মনমরা লাগছে।আর যেন নিজেকে বাঁচানোর সেরকম চেষ্টা করছে না।সে যাই হোক, লেবেদফ ও কিছু কম যায় না। যথেষ্ট সাক্ষী - প্রমান যোগাড় করেছে।অনাস্তশিয়ার হাতের ট্যাটু আর আংটি দেখে আন্যার মা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো।মেয়েটা নাকি পড়াশুনাতে তুখোড় ছিলো সাথে খুব ভালো মনের ছিলো।সেইজন্যই মায়ার বশে বুড়োটার শয়তানীতে মজেছিলো - ভালোবাসা ভেবেছিলো। এছাড়া বুড়োর ছেলে হেনরীও সাক্ষ্য দিয়েছে তার বাবা ত্রুর ,বদমেজাজী এবং অ্যানা তার বন্ধু হওয়া স্বত্বেও হেনরীর সাথে কথা বললে নাকি অ্যানাকে মারধোর করতো এবং শেষ- অবধি হেনরীকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বাধ্য করে। তাছাড়া মিস্টার সোকোলোভের পিঠের রুকস্যাকটা যে তার নিজেরই একথা সেই দোকানের মালিক জানিয়েছে যে দোকান থেকে সোকোলোভ ব্যাগটা ঠিক খুনের পরদিন কিনেছিলেন। ঐ ব্যাটা ঘুঘুকে যদি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড না দেওয়াতে পারে তো লেবেডফের শান্তি হবে না। মিনিমাম বাইশ বছরের জেলের ঘানি টানিয়েই ছাড়বে তাকে। ব্যাটা বলে কিনা আমার ব্যাগে কারা কাটা হাত রেখে দিয়েছিলো - আমি জানি না।ব্যাটা তুমি ঘুঘু দেখেছো ফাঁদ দেখো নি। এবার তোমাকে ফাঁদ দেখাবো আমি - সকালের প্রাতরাশটা তাড়াতাড়ি সারতে সারতে লেবেদফ মনে মনে ভাবে।
কাল রাত থেকেই স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছেন সোকোলোভ । অ্যানাকে তিনি ভালোবাসতেন না একথা ঠিক নয়। স্নেহ যথেষ্টই করতেন। কিন্তু তার নিজের ভালোবাসাটা বোঝানোর ক্ষমতাটা যেন ছিলো না। অ্যানা ছেড়ে চলে গেলে তিনি কষ্ট পাবেন কিন্তু কষ্ট পেতে তিনি আর চান না। সেকথা অ্যানাকে তিনি ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারতেন না। হ্যাঁ বয়সের জন্যই হোক আর পদভারেই হোক একটু উন্নাসিক মানসিকতা তিনি পোষণ করেন একথা ঠিক।কেউ তার বিরুদ্ধে যাবে একথা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না।আন্যাকে তিনি মারতে চান নি।বরঞ্চ আন্যাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ভীত হয়েছিলেন। আন্যা তার যথেষ্ট খেয়াল যত্ন রাখতো তাছাড়া বয়সে তার চেয়ে অনেক কম হলেও কি হবে, বিছানাতে যথেষ্ট সাবলীল ছিলো সে।যে সুখ তিনি চিররুগ্না মেরীর কাছ থেকে পান নি।সেই সমস্ত সুখ আন্যা তাকে দিচ্ছিলো। হেনরী তার ছেলে হওয়া স্বত্বেও মায়ের প্রতি টান বেশি হওয়াই এই সম্পর্কটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। বিশেষত আন্যা ছিলো তার ক্লাসমেট।ছেলেটার সাথেও তার বড় দূরত্ব তৈরী হচ্ছিলো। কিন্তু নিজের সুখ চাওয়া কি ভুল।একটাই তো জীবন। কারোর কোনো ক্ষতি না করে যদি মানুষ একটু ভালোবেসে নিজের মতো বাকি জীবন কাটাতে চাই তবে সমাজের কি ? আন্যার জন্য তার সামাজিক সম্মানেও ছিটে লাগছিলো। তবুও আন্যাকে ভালোবেসে তিনি তো মেনে নিচ্ছিলেন। আর সেই শয়তানী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছিলো। নিজেকে অপদার্থ ব্যবহার হয়ে যাওয়া রদ্দিমাল লাগছিলো।রাগে - হিংস্রতায় তিনি আন্যার গলা টিপে ধরেছিলেন। কচি প্রাণ সেই শক্ত হাতের পাঞ্জা কতক্ষণ সহ্য করবে। কবুতরের মতো ছটফট করতে করতে আন্যা বলেছিলো আমাকেও বাঁচতে দিলে না তুমিও মরবে। আমি তোমার মরণ ডেকে আনবো।
ক্ষণিকের উন্মত্ততায় ঘটে যাওয়া অপরাধ তাকে তাৎক্ষণিক বিচলিত করেছিলো।কিন্তু একটা ভুলের মাশুল তিনি বাকী জীবন গুনতে চান নি। খুব ঠান্ডা মাথায় তিনি ইলেকট্রনিক করাত কিনে এনেছিলেন আর কিনেছিলেন একটা রুকস্যাক। আন্যার দেহটাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফ্রিজারে ভরে রেখেছিলেন।তারপর প্রতিদিন রাত্রে হাঁটতে যাওয়ার নামে মইকা নদীতে ভাসিয়ে দিতেন এক একটা টুকরো। শীতের রাত্রে জনপ্রাণী হীন নদীতীরে কেউ জানতেও পারতো না কিছু। কিন্তু প্রতিরাতে বেতালের মতো পিঠে চেপে যেতে যেতে সেই কাটা অংশ যেন গোটা আ্যনা হয়ে যেত। বাহুডোরে তার গলা জড়িয়ে ধরে কানে কানে ফিসফিস করে বলতো জর্জ আমি ছাড়া তুমি একা থাকতে পারবে না। তুমিও ডুব দাও শীতল মইকার জলে। কী অপরিসীম শান্তি দেখো। জলের কাছে গেলেই তিনি দেখতে পেতেন জলের মধ্যে থেকে আ্যনার প্রতিচ্ছবি তাকে দু-হাত বাড়িয়ে ডাকছে। সে ডাক নিশির ডাকের মতোই নেশাতুর মৃত্যূঘাতি । পাগল পাগল লাগতো সকোলোভের। কাজ - কর্ম সব চুলোয় গিয়েছিলো। আকন্ঠ নেশা করে সারাদিন মাতাল হয়ে চুর হয়ে থাকতেন। কাজের লোকেদের অসুস্থতার কারণ দিয়ে বিদেয় করে দিয়েছিলেন। তারাই এখন সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে তার অনিয়মের কথা কোর্টে স্বাক্ষী দিয়েছে।শেষদিন যে অংশটা তিনি ফেলতে গিয়েছিলেন সেটা ছিলো আ্যনার বাম হাত। সে হাতে তখন পরানো ছিলো তার দেওয়া অঙ্গীকারের আংটি । হিরে বসানো সে আংটি জ্বলজ্বল করছিলো তাদের প্রথম মিলনের রাতকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলো সে রাতে বেঁহুশের মতো মদ খেয়েছিলেন তিনি। সেদিন একটু বেশি রাতেই বাড়ি থেকেই বেরিয়েছিলেন। প্রায় রাত বারোটার পর, তিনি বেহেড মাতাল ছিলেন তবুও স্পষ্ট মনে আছে কাটা হাতটা নদীর জলে ফেলে দিতেই হাতটা যেন আবার উঠে এসে তার পা ধরে মারলো একটা হ্যাঁচকা টান।তিনি নদীর জলে পড়ে গেলেন। তিনি কোনোদিনই সাঁতার জানেন না। বরফ জলে ভেসে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু কি আশ্চর্য।জলগুলো হঠাৎ বরফ হতে শুরু করলো। তাকে চারিদিকে থেকে চেপে ধরছিলো। দমবন্ধ হয়ে আসছিলো তার। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে অবধি তিনি একটাই ডাক শুনতে পাচ্ছিলেন - আ্যনা তাকে ডাকছে। চলে এসো জর্জ -তোমার একা থাকতে কষ্ট হবে।তুমি আমার কাছে চলে এসো।
তিনি তো ভেবেছিলেন মরেই গেছেন বুঝি। কিন্তু রাতের টহলদারী পুলিশ ভোররাতে তাকে উদ্ধার করে। সেদিনের সেই রাত নাকি সে বছরের কেন গত বিশবছরের সব থেকে শৈত রাত ছিলো। মইকা নদীর জল অনেক বছর পর জমাট শক্ত বরফে পরিণত হয়েছিলো। এমনিতে প্রতিবছর শীতেই মইকা নদীর জলের উপরের স্তরে একটা পাতলা বরফের আস্তরণ পরে। সেরাতে নাকি নদী অদ্ভুত এক অদ্ভুত এক জমাট বরফে পরিণত হয়েছিলো।
---------------------------------------------------
সংঘমিত্রা সরকার কবিরাজ
ঠিকানা :মেন পোস্ট অফিসের পেছনে (সেহেরাপাড়া)
সিউড়ি ,বীরভূম,পিন:৭৩১১০১