ছোটগল্প ।। আপন ঘর।। অদিতি ঘটক
নতুন কেনা ফুলদানিতে একগোছা রজনীগন্ধা সাজাচ্ছে রমলা। এই ওরা এসে পড়বে। হইহল্লা করে দিনটা ভালোই কাটে।
রমলার বহু দিনের সখ একটা একান্ত নিজের ঘর। কিন্তু কিছুতেই তা হয়ে ওঠেনি। ছোটবেলায় ভাই বোনদের সাথে, বাবা মারা যাবার পর মা দুই বোন, এক ঘরে। পরে দাদার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়, ভাইয়ের শালী সবাই এসে ভাগ বসিয়েছে রমলার ঘরে।
তারও পরে ভাইপোদের ছেলে, মেয়েরা মানে রমলার নাতি, নাতনিরা রমলার ঘরের দখল নিত। এই 'গোধূলি'তে এসে একেবারে নিজস্ব আপন ঘর। যেখানে সে নিজের ইচ্ছেমত হাত পা মেলে স্বাধীন ভাবে থাকতে পারবে।
আজ প্রায় তিন বছর হতে চলল রমলা এখানকার বাসিন্দা। অন্যান্য লোকেদের সঙ্গেও বেশ ভাবসাব হয়ে গেছে। একসঙ্গে ঠাকুর দেখা, পিকনিক সবই হয় আর বেশ হইহুল্লোড় করেই হয়। যেন এখানে আবার রমলার নতুন জন্ম হয়েছে। সংসারের যাঁতাকলে পিষে যাওয়া যৌবন ষাটোর্ধ্ব বয়সে নতুন করে ফিরে এসেছে। তাই রমলা তার নতুন ঘরে গৃহপ্রবেশের দিনে নিজের জন্মদিন পালন করে। ভাইপো,ভাইপো বউরা বাচ্চাদের নিয়ে আসে। দেখা সাক্ষাৎ, গল্প গুজব খাওয়া দাওয়া করে দিনটা ভালই কাটে।রমলা আনন্দে ছটফট করছে এই বুঝি ওরা এল। বারান্দায় বেরিয়ে দেখতে পেল গোধূলির ম্যানেজার বারিক বাবু কাকে যেন বোর্ডারদের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। এখানে এটাই রীতি কেউ নতুন এলে তাকে কদিন নিজের মত থাকতে দিয়ে তারপর ডেকে ডেকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এক দু দিন পর কমিউনিটি হলে সবাই জড়ো হয়ে ওয়েলকাম জানানো হয়।
রমলার ঘর মেন গেটের এক পাশে। বারিক বাবুর অফিস ঠিক তার উল্টো দিকে তাই রমলা দেখতে পায় কারা এল কারা গেল। এনাকেও দেখেছে, দেখে একটা সন্দেহ উঁকি ঝুঁকি দেওয়া শুরু করেছে কিন্তু রমলা তা 'অবাস্তব' 'পাগলের প্রলাপ' ভেবে উড়িয়ে দিয়েছে। পুরোটা পেরেছে কি? বোধহয় না। বারিক বাবুর সঙ্গে লোকটাকে দেখে আবার বুকে হাতুড়ি পেটা শুরু হল। আগের মানুষটার সাথে এর মিল খুঁজতে হয়। বয়স কম করে সত্তরের উপর। মাথার সামনেটা ফাঁকা। মুখ চোখ ভীষন বিষণ্ন ,ভাঙাচোরা চেহারা। তবুও কোথায় যেন--
ভদ্রলোক যত এগিয়ে আসছেন রমলার সময়ের প্রলেপ পড়া স্মৃতিগুলো যেন তত জীবন্ত হয়ে সামনে এগিয়ে আসছে---বাবা যখন হঠাৎই বাস এক্সিডেন্টে মারা গেলেন তখন রমলার কি-বা বয়স সদ্য উনিশে পরা একটা মেয়ে। পুরো সংসারের ভার এসে পড়ল ছোট্ট রমলার ঘাড়ে। দাদা নিষিদ্ধ সংগঠনের সক্রিয় কর্মী। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার জঙ্গলে জীবন কাটে। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় নেই। দুই বোন, ছোট ভাই, বিধবা মায়ের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হল রমলাকে। বাবার এল. ডি. ক্লার্কের চাকরিটা জুতোর শুকতলা খুইয়ে রমলা বাগিয়েছিল। ওটাই ছিল পুরো পরিবারের অক্সিজেন। এরপর রমলার জীবন গতানুগতিক-- ভাইবোনের লেখাপড়া শেখানো, বোনেদের বিয়ে দেওয়া, ভাইকে চাকরি উপযোগী করা, দাদাকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে বিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এরই মধ্যে মা বেঁচে থাকতে ওর অফিসের দুটো চেয়ার পরে বসা বিনয় বাবু এসেছিলেন। ঢাকঢাক, গুড়গুড় না করে স্পট করেই বলেছিলেন, "মাসিমা রমলাকে আমি বিয়ে করতে চাই।" কিন্তু তার কদিন পরেই হাই সুগারের রোগী মার মৃত্যু রমলার জীবনকে রঙীন হতে দেয়নি। বিনয় বাবু ইউ .ডি. ক্লার্ক হয়ে বদলি হয়ে চলে গেলেন। তারপর এক বছরের মাথায় রমলা কানাঘুষো শুনেছিল বিনয় বাবু ওনার থেকে বয়সে প্রায় কুড়ি বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে করেছেন। এরপর রমলা আর বিনয় বাবুর কোনো খবর পায়নি, রাখতেও চায়নি।
আজ হঠাৎ এত বছর পর সেই মানুষটার সাথে এই মানুষটার মিলই সব গোলমাল করে দিচ্ছে।
এর মধ্যে বারিক বাবু ভদ্রলোককে নিয়ে উপস্থিত। পরিচয় করবার আগেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন, "এনাকে আমি চিনি। রমলা চলো তোমার ঘরে বসি।"
ঘটনার আকস্মিকতায় রমলা হকচকিয়ে গিয়ে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইল।
বারিকবাবু বললেন, "এই ঘরটি বাকি ছিল। আপনারা যখন পরস্পরকে চেনেন তখন আর অসুবিধা নেই। আপনারা গল্প করুন আমি বরং অফিসিয়াল কিছু কাজ সারি।
বিনয় বাবু রমলাকে তাড়া দিলেন, "কি হল ঘরে বসতে বলবে না, নাকি?" রমলা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে এল, বিনয় বাবু তার পেছন পেছন। রমলা খাটের উপর বসল আর বিনয় বাবু ঘরে রাখা একটা মাত্র চেয়ারে। পরিপাটি সাজানো দেখে জিগ্গেস করলেন, "ভুল সময়ে এসে পড়লাম নাকি? আসলে প্রথম থেকেই যাই করতে যাই সময়টা কেমন বিট্রে করে।" বিনয় বাবু ফুলদানিতে রজনীগন্ধার স্টিক গুলো দেখে বিমর্ষ ভাবে বললেন --"আজ তবে উঠি। আপনি হয়ত ব্যস্ত আছেন।"
এত বছরের ধূসর হয়ে যাওয়া প্রায় অপরিচিত (?) লোককে খুলে সব কথা বলতেই হল। সাথে অনুরোধও করতে হল একসঙ্গে খাওয়াদাওয়ার জন্য। দিনটা বেশ হইচই গল্প গুজব করেই কাটলো। ভাইপোরা হাতে করে মিষ্টি আর কেক এনেছিল। নাতি নাতনিরা প্রবল উৎসাহে সে সব সমস্ত বোর্ডেরদের ঘরে ঘরে ভাগ করে দিয়ে এল। যাদের ডায়াবেটিস তাদের জন্য আবার আলাদা ব্যবস্থা। এই চলে আসছে এই তিন বছর ধরে। রমলার বেশ ভালো লাগে। নিজের জীবনটা অর্থপূর্ণ মনে হয়। বিনয় বাবুও রমলার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে খুব সুন্দর মিশে গিয়ে গল্প গুজব করলেন। একবারও মনে হয়নি উনি এদের প্রথম দেখছেন। ওরাও কত সহজ সরল ভাবে সময় কাটালো।
রমলা এখন বিকেলে মাঝে মাঝে পার্কে হাঁটতে যায়। বিনয় বাবুও থাকেন। বলা যায় স্বাস্থ্য ভালো রাখা বাহানা মাত্র কারন রমলা এখন আগের থেকে অনেক ঝলমলে অনেক প্রাণবন্ত। আয়নায় নিজের চেহারার পরিবর্তনে নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়। মানুষটা যে তাকে এখনো মনে রেখেছে, ভুলে যায়নি। এটাই তার কাছে পরম প্রাপ্তি।
রমলা দেখে প্রায়শই বিনয়বাবু কিছু কথা বলতে গিয়ে চুপ করে যান। রমলা আর দগদগে অতীতের কথা জোর করে শুনতে চায় না। একদিন বিনয়বাবু বললেন, "রমলা তুমি তো আমাকে আমার অতীত সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস কর না।"রমলা মাথা নিচু করে থাকে, কি বলবে ভেবে পায় না। এই বয়সে অতীত খুঁড়ে বেদনা পেতে আর ভালো লাগে না। তার থেকে এই ছোটখাটো পাওয়াকে অনেক বেশি জীবন্ত মনে হয়। এই সব মুহূর্ত হারাতে ভয় লাগে। আজ যেন বিনয় বাবুর উপর কিছু ভর করেছে রমলা ওনার মধ্যে একটা বিচলন লক্ষ্য করছে। যে কোনো বিষয় বা কোনো কথাতে মনোযোগ দিতে পারেছেন না। কিছু এলোমেলো কথার পর বিনয়বাবু সোজা প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন- "এ কথা তোমাকে না বললে আমি মন থেকে শান্তি পাচ্ছি না। জানো, আজ আমি কেন এখানে? আমাকে দেখে অবাক হয়েছো নিশ্চয়।" রমলা কোনোওমতে কষ্টের দলাটা গলার কাছে আটকে বলল, "আপনি তো বিয়ে করেছিলেন?"
বিনয়বাবু ব্যঙ্গ করে বললেন, "বিয়ে ! সেই প্রহসনকে এই নামেই ডাকা হয় বটে! শয্যাশায়ী মায়ের দেখাশোনার জন্য এক মহিলাকে আয়া হিসেবে রেখেছিলাম। আমাদের এক পরিচিতির মাধ্যমে। সেই মহিলার উদ্দেশ্য ছিল আলাদা। তা আমি কি করে জানব ! সে যা নয় তাই রটালো। সাক্ষী দেবার তো কেউ নেই। মা, ছেলের সংসার। আমি অফিস থেকে ফিরে আসার পর শয্যাশায়ী মা, আমি আর সেই আয়া। অফিসে অডিট চলার সময় রাতে ঘুমের অসুবিধা হলে ট্রেন ধরতে পারব না। অফিস যেতে লেট হয়ে যাবে তাইজন্য রাতেও সেই মহিলাকে এক আধবার থাকতে বলেছি। মহিলা সেই সুযোগ নিলেন। কুৎসা রটিয়ে রাষ্ট্র করার হুমকি দিলেন। পুলিশের ভয় দেখালেন। এই লোকলজ্জার হাত থেকে বাঁচতেই বাধ্য হয়েছিলাম। বিয়ে আমি একবারই করতে চেয়েছিলাম। যাহোক এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ডিভোর্স এর মামলা। বিয়ের পরে শুনেছিলাম মহিলার স্বামী, ছেলে সব আছে। তারা সবাই মিলে প্লান করে আমায় ফাঁসিয়েছে। পুলিশে যেতে পারতাম। ইচ্ছে হয়নি। মামলাটা আমি জিতলেও বাড়িটা তার দখলে গেছে। ভাড়া বাড়িতেই জীবন কাটল। এখন একা থাকতে ভয় করে তাই এখানে এসেছি।"
এর পরের গল্প খুব সংক্ষিপ্ত। কিছুদিন পর রমলার ঘর, খাট আবার ভাগ হয়ে গেল তবে রমলার জীবনে তা আনন্দ নিয়ে এল। হোক না গোধূলিতেই। গোধূলি মানে তো শুধু অস্তরাগ নয়। কনে দেখা আলোও বটে।
----------------------------------
অদিতি ঘটক
চুঁচুড়া
হুগলি।