ভোর পাঁচটা বাজে। চারিদিক নির্জন। গাছেরা নীরব, নিশ্চল। আর পাঁচটা দিনের মতো আজকের দিনটা নয়। আজ পঁচাত্তরতম স্বাধীনতা দিবস। সুভাষ প্রত্যেক বছরের ন্যায় এবারও স্বাধীনতা দিবস পালন করবে। তবে অন্য বছরের থেকে গত দু'বছরে পার্থক্য হল, প্রত্যেক বছর যে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা দিবস পালন করত , তা মহামারীর কারণে আর হচ্ছে না। সামান্য কয়েকজন কাছের লোক নিয়ে সকাল আটটায় পতাকা তোলে সুভাষ। 'জয় হিন্দ' ধ্বনিতে পতাকা তোলা হয়। গান করে সুভাষ-এর সহধর্মীনি প্রীতিলতা। "ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।" বক্তৃতা রাখে সুভাষ, রবিন, নন্দিতা ও হৈমন্তী। স্বাধীনতার এই সুন্দর দিন যেমন ভাবে পালন করার কথা করোনা সেই পথে বাঁধ সেধেছে। মানুষের আগের মত স্বাধীনতা রুদ্ধ হয়ে গেছে।
আমি সুভাষের বাংলার মাস্টার মশাই জীবন গাঙ্গুলী। সুভাষ আজ "শোভাবাজার জয় বাংলা কলেজ"-এর বাংলার অধ্যাপক। এক সময় এরা সকলেই আমার কাছে বাংলা পড়তো। সুভাষ-এর সহধর্মীনি প্রীতিলতা আমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একজন ছিল। এরা প্রত্যেকেই আমাকে খুব সম্মান করে। এখনও দেখা হলে পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করা, ভালো-মন্দ খোঁজখবর নেয়। এককথায় নিজের ছেলে মেয়ের চেয়েও বেশি। সামান্য টিউশন পরিয়ে জীবন অতিবাহিত হয় আমার। কিন্তু গত দু'বছর ধরে যেভাবে জীবন কাটছে, তা বলার মত নয়। কোন মাসে সামান্য উপার্জন হয়েছে, কোন মাসে একেবারে হয়নি। বাইরে বেরিয়ে যে কোনো কাজ করবো, তারও উপায় নেই। লকডাউন ও করোনা মানুষের মাজা ভেঙে দিয়ে গেছে। চোখের সামনে, টিভিতে দেখেছি, কত মানুষ কাজ হারিয়েছে। নতুন করে কে কাজ দেবে আমায়? আর পেটে বিদ্যা থাকায় সব ধরনের কাজও আমরা করতে পারবো না। বাড়ি থেকে বেরোনো তো একেবারেই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের মত মানুষের দুঃখ কেউ বোঝেনা।
সকাল দশটা নাগাদ সুভাষ প্রীতিলতাকে নিয়ে আমার বাড়িতে আসে। আমায় নমস্কার করে ভালো-মন্দ খবর নেয় তারা। কেমন আছে জানতে চাইলে সুভাষ বলে --- "মাস্টারমশাই আগের মত সেই স্বাধীন জীবন আর নেই। মানুষের জন্য একসময় আপনি কত কি করেছেন। কিন্তু এই বিপদের দিনে আপনি একেবারে একা। ভাবলে খুব কষ্ট পাই আমরা। আসবো ভাবলেও সবসময় বাড়ি থেকে বেরোতে পারি না। দীর্ঘদিন কলেজ বন্ধ। আর ভাল লাগে না চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে। কবে যে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবো ! কবে যে আবার সব আগের মত হবে ! কলেজ যাব, সমাজসেবামূলক কাজ গুলি সবাই মিলে করতে পারব। ঘরে বসে নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসে।" এরপর প্রীতিলতা আমার হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বলে -- "মাস্টারমশাই এই টাকাটা আপনি রাখেন, আপনি এই দুর্দিনে খুব কষ্টে আছেন শুনে ভালো লাগলো না। আপনি সংসারে খরচ করবেন।" আমি টাকাটা নিতে অস্বীকার করলাম। বারবার ফিরিয়ে দিলাম। কিন্তু সুভাষ বলল--- "আপনি না নিলে আমরা দুজনে খুব কষ্ট পাব। আপনার ঋণ আমরা কোনদিন শোধ করতে পারব না।" তাদের বহু বলায় টাকাটা আমি নিলাম। তাদের দুজনকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করলাম। বললাম-- "তোমরা সুখী হও। তোমাদের ত্যাগ, সমাজসেবা, মানুষের জন্য ভাবনা-চিন্তা একদিন তোমাদের অনেক বড় জায়গায় নিয়ে যাবে।" এরপর আমাকে বিদায় জানিয়ে তারা বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
আমার মতো অধম এ পৃথিবীতে কমই আছে। বউ-বাচ্চা থাকতেও না থাকার মতো। পড়াশোনার প্রতি আমার অতিরিক্ত ভালোবাসা ও একটা সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কারণে তারা আমার সঙ্গে থাকে না। ছেলে রাইটার্সে চাকরি করে, মেয়ের বিয়ে হয়েছে পুলিশে চাকরি করা একজন পাত্রের সঙ্গে। আমার মেয়েও নার্স । সবাই যখন এই পরিস্থিতিতে নিজেরা গৃহবন্দি, তখন মেয়ে-জামাই-ছেলে তিনজনেরই কাজের অন্ত নেই। তবে তাদের এই স্বাধীনতায় আনন্দ নেই। প্রতিটি মুহূর্তে চোখে-মুখে আতঙ্ক। মাকে নিয়ে আমি নিজের বাড়িতেই থাকি। তাদের অনেক বার ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করেছি। কিন্তু তারা ফেরেনি। মাঝে মাঝে মনে হয় 'এ পৃথিবীতে কে কার!' আমি চলে গেলেও তারা হয়তো কাজটুকুও করবে না। আসলে রাগ- অহংকার বিষয়টি আমি জীবনে কখনো করলাম না। তাই অহংকারী মানুষের থেকে দূরে থাকারই চেষ্টা করি। তারা কেউই আমার খোঁজ রাখে না। এই মহামারিতে বেঁচে আছি, না নেই-- তাও হয়তো জানে না।
আর যে কটা বছর বেঁচে আছি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে কাটিয়ে দেবো ভেবেছি। সুভাষদের মত মানুষকে ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে পেয়ে আমি গর্বিত। তাদের টাকা থাকতেও টাকার অহংকার নেই, মানুষকে মানুষ বলে জ্ঞান করে। ভাগ্য আমার সঙ্গ দেয়নি জীবনে। যতবার এগোনোর চেষ্টা করেছি, ততই পিছিয়ে পড়েছি। লক্ষ্য রেখেও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছি বারংবার। আমি বরাবরই একটু স্বাধীনচেতা। কিন্তু আমার পরিবার সেটা পছন্দ করত না। 'তাদের মত করে আমার চলতে হবে' -- তারা চেয়েছিল। কিন্তু আমি পারিনি তাদের মতো করে চলতে। টাকা হয়তো তাদের থেকে আমি কম আয় করি, কিন্তু আমিই তাদের জন্ম দিয়েছি। আমার স্বাধীনতায় তাদের হস্তক্ষেপ করাটা আমি মেনে নিতে পারিনি। তাছাড়া আমার মাকে নিয়েও তাদের সমস্যা ছিল।
আমি চিরদিন সকলকে নিজেদের স্বাধীন চিন্তা-ভাবনা করতে শিখিয়েছি। পরাধীনতার জ্বালা কেমন তাও বলেছি। আমার আদর্শে বড় হওয়া ছেলে-মেয়েগুলো আমায় দেখে কি শিখবে ! -- যদি আমি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতেই ভুলে যাই। ছেলে বউয়ের দাসে পরিণত হই। তবে এই আকালের দিনে স্বাধীনভাবে বাঁচার চেষ্টা করলেও সবকিছুই কিছুটা থমকে গেছে। নিঃশ্বাস ছাড়া যেমন বাঁচা সম্ভব নয়, স্বাধীনচেতা মানুষ হয়ে ঘরবন্দি থেকে বাঁচাও একপ্রকার মৃত্যুরই নামান্তর।
পরদিন সকালবেলা সুভাষের দেওয়া টাকা থেকে তিন হাজার টাকা আমি কাজ চলে যাওয়া ছয়জন গ্রামবাসীকে দিয়ে আসি। আমি তাদের বলি-- "সুভাষ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় নামের একজন অধ্যাপক এই টাকাগুলো তোমাদের দেওয়ার জন্য আমার কাছে দিয়ে গেছেন। তোমরা ওকে আশীর্বাদ করো, সে যেন এভাবেই অসময়ের পরম বন্ধু হয়ে চিরকাল তার লক্ষ্য পূরণ করে যেতে পারে।" বাড়ি ফিরে আসার সময় মনে মনে বলেছিলাম-- "সুভাষের দেওয়া টাকা কেবল আমার নয়, অসহায় কিছু মানুষের সেবায় লাগাতে পেরে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি। অসময়ে পরও আপনের চেয়ে অধিক হয়ে ওঠে।"
---------------------
নাম - মিঠুন মুখার্জী
ঠিকানা: c/o - গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম - নবজীবন পল্লী
পোস্ট + থানা - গোবরডাঙ্গা
জেলা - উত্তর ২৪ পরগনা