ব্যাগটা সবে নামিয়েছি, গিন্নি দৌড়ে এল, সুদুর রান্নাঘর থেকে, নাইলনের মোটা বাজারের ব্যাগ দেখেই উনি বুঝে গেছেন যতসব রদ্দিমাল মানে সবজি আমি মহামুল্যে কিনে এনেছি।
রেগে লাল, মাথার চুল এলোমেলো করে চিৎকার — এসব কি এনেছো যাচ্ছেতাই?
সবে বাজার থেকে এলাম, করোনার আবহে মুখের মাস্কটাও পর্যন্ত খুলতে পারিনি, হাত পা ধোওয়া দুরে থাক, কিছু না দেখেই মাথা আমার খারাপ করে দেওয়ার পালা। আর আমি সত্যিই বোকা প্রায়শই মুখ খুলে ফেলি আর সেই একই উৎপত্তি শুরু হয়ে যায় কচ্ছপের গল্পের মতোই। তাই বলেই ফেললাম —
— আরে চেঁচামেচি করছো কেন? আগে তো থলি থেকে সব বার করে দেখো। সমস্ত মাল বেছে বেছে এনেছি।
— দেখো মাথা গরম করো না আমার বুঝলে? আমি একবার দেখলেই বুঝতে পারি। আর সব বেশি বেশি দাম দিয়ে এনেছো এই সব ফেলে দেওয়া সব্জিগুলো?
— আরে না না, সব দামী এবং টাটকা!
— ঠিক আছে। ঠিক আছে! যা সব এনেছো – ওগুলো দিয়ে তুমিই রান্না করবে, আমি ছুঁয়েও দেখবো না এই বলে দিলাম। যত্তোসব!
আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগ উল্টে দিলাম। আনাজ গুলো গড়াগড়ি খেয়ে দিগ বেদিক বেমালুম হয়ে গেল। দু একটা হাতে তুলে বৌয়ের উদ্দেশ্যে নাড়ালাম — দেখো ! বললাম না ? কত টাটাকা দেখো।
গিন্নি ওসবের ধার দিয়েও গেল না। পালং শাকের আঁটিটা হাতে তুলে নিয়ে কি চেঁচানি — ছ্যাঁ! ছ্যা এটা কি? এটা ফেলে দিলে গরুতেও তো খাবে না!
আমি বেগতিক দেখে কেটে পড়লাম। একেবারে সোজা ছাদে গিয়ে ঠাঁই নিলাম। কিনা কান খাঁড়া করে শুনতে লাগলাম গিন্নির চিল্লানি — কোনো কাজটা যদি পারে। সব কিছুতেই বড় বড় ভাষণ!
কাজের বেলায় অকর্মার ঢেঁকি !
লজ্জায় কান লাল হয়ে গেল। কর্মজীবনে যে আমি কিনা ম্যানেজার হয়ে সকলকে ধমকেছি সেই আমিই এখন বউয়ের হাতে জব্দ হয়ে ল্যাজ গুটিয়ে নিজেকে লুকাচ্ছি! ছিঃ ছিঃ! ভগবানের এ কেমন বিচার? না ভগবান- ফগমান কিছু নেই!
আশেপাশের বাড়ির প্রতিবেশী বৌদিরা সব শুনছে আর কি ভাবছে কে জানে? ছিঃ ছিঃ!
হ্যাঁ ঠিক তাই ! যা ভাবা তাই হল – পাশের ছাদ থেকে যুবতী, লেখা বৌদির সে কি মুচকি হাসি!
তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে নিলাম। লজ্জায়। আরো একবার এরকম হয়েছিল -সেবারো চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম লজ্জায়, তবে সেবার আমার মনে হয়েছিল ও বোধহয় আমায় চোখ মেরেছিল। আবার আমার ভুলও হতে পারে কারণ আমার নিজের চোখের একটু কমজোর আছে। যতদূর জানি বৌটির বাচ্ছা হচ্ছে না!
সেসব কথা থাক এখন আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার উপদ্রব হল। ছিঃ ছিঃ!
পিছন ঘুরে দেখি, আমার অর্ধাংগিনী যিনি আমার জন্মধার্ত্রী মায়ের থেকেও বড় ক্ষমতাবতী, যিনি আমার দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছেন (?) তিনি রণংদেহী মূর্তিতে আমাকেই অবলোকন করছেন। এ আর এক বিপদে পড়লাম।লেখা বৌদি কাপড়ের আঁচল এদিক ওদিক করে বউকে খচিয়ে বিদায় নিল।
— ওহঃ তাই বলি আপদটা গেল কোথায়? ছাদে এসে লুকোচুরি খেলছেন উনি? কাপড় সরানোর খেলা?
— হা হা এসব কি ভাবো তুমি? এই বয়সে আমি? আর এইসব নোংরামি? ছিঃ ছিঃ!
— আর ছিঃ ছিঃ করতে হবে না? আমি কচিখুকি নই? সব বুঝি। তাই বলি ভীমরতি কেন হল? কোন কজে মন নেই কেন? উনি এখন ছুঁকড়ির সাথে কাপড় নিয়ে লুকোচুরি খেলছেন যে!
গিন্নি চিৎকার করলেই বিপদ! তাড়াতাড়ি নিচে নামতে লাগলাম। পিছনে গিন্নিও দেখলাম নামছে। যাক একটু শান্তি পেলুম।
ওমা! একি হল? দোতলায় নেমেই গিন্নি দরাম করে দরজা বন্ধ করে দিল। লক্ষণ খারাপ লাগলো, সুইসাইড করবে নাকি?
ভয়ে প্রান উড়ে গেল। কি করি এখন? কান খাঁড়া করে দরজার দিকে চেয়ে থাকলাম। কোন শব্দ নেই। দমবন্ধ করা অবস্থা। আর অপেক্ষা না করে দরজায় করাঘাত করলাম — আরে কি হল?
এ যে কি অবস্থা! কাউকে ডাকাও যাবে না, আবার চুপ করে বসে থাকলেও চলবে না যদি কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলে?
পরক্ষণেই মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা করলাম এ সেই মেয়ে নয়, এর জাত আলাদা – সাপের চেয়েও তেজী আবার ছোঁবল বসাতেও ফণীমনসা!
ঠিক তাই আমার বুকের ধড়ফড়ানি বাড়িয়ে মিনিট দশেক অপচয় করে উনি দরাম করে দরজা এমন ভাবে খুললেন যে সামনে দাঁড়িয়ে থাকার হেতু আমার নাসিকায় এসে করাঘাত করলো – আর আমি নাক চেপে সরে কাতরাতে লাগলাম।
বউ গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকলো – কি ভাগ্য আমার!ও চিৎকার করে জানালো — আমি কিছু পারবো না লেখা বৌদির কাছে গিয়েই খাওগে —–ইঙ্গিতটা বেশ! যে বোঝার সে বুঝবে।
এদিন দানাপানি জুটলো না। লুকিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে এক মুঠো ভিজে ছোলা গেঁড়িয়ে সিঁড়িতে বসে
চিবোলাম।
বউ আবার বাজারে বেড়িয়ে গেল। আবার আনা বাজারগুলো থলে উল্টে মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে থাকলো – কারণ ওগুলো বউয়ের না -পসন্দ!
বিকালে বন্ধু বিকাশ সস্ত্রীক এসে আবহাওয়াটাকে একটু হালকা করে দিল। গিন্নি বেশ জমকালো টিফিনের সাথে চা দিল। বিকাশের বউ একেবারে হাসিয়ে হাসিয়ে জমিয়ে দিল। আমার গিন্নি আবার বিকাশকে পছন্দ করে। ভালোই জমে গেল ওরা দুজনে। ওর হাসিখুশি বউ রিঙ্কি আমার সঙ্গে খুব মজা করলো -আমার কি ভালোই না লাগে ওকে!
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল। ওরা চলে যেতেই গুমোট হয়ে গেল সব। রণমূর্তিতে ফিরে এল গিন্নি, চেঁচিয়ে রাতের নিস্তব্ধতা কে ভেঙ্গে দিল — খুব যে বাহাদুর! রিঙ্কিকেও ছাড়লে না? ছিঃ ছিঃ লজ্জা করে না, মেয়ে দেখলেই হামলে পড়ো। ভাবো আমি কিছু বুঝি না? অসভ্য ছোটোলোক কোথাকার! তোমার বংশের রোগ এটা। ইজ্জত যায় না ধুলে বুঝলে?
তোমার গুষ্টি এই রোগে আক্রান্ত। তুমি কি করে এর বাইরে থাকবে?
সারারাত পাশে শুয়ে ফোঁসফাঁস করতে লাগলো,
অনেক আফসোস করলো আমার সংগে বিয়ে হয়েছে বলে। ওর সব বন্ধুরা নাকি খুব ভালো স্বামী পেয়েছে। ওর কপালটাই নাকি খারাপ।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই গিন্নির আলাপচারিতা কানে এল। পাশের বাড়ির মাসিমা মানে নারী সমিতির লীডার কে বলে চলেছে — না মাসিমা আপনি ঠিকই বলেছেন, এই গরুগুলোকে কাজ পারে না বলে ছেড়ে দিলেই এরা সুবিধা নেবে। এখন মনে হচ্ছে এই জন্যই বুঝিবা ও সবসময় ভুলভাল কাজ করে যাতে আমি ওকে দিয়ে আর না কাজ করাই।
মাসিমা হ্যাঁ হ্যাঁ বলে লাফিয়ে উঠলেন — তুমি এবার ওদের জাতকে ঠিক ধরে ফেলেছো।
পুরুষ জাতির গুষ্টির সর্বস্রান্ত করে মাসিমা বিদায় নিলেন।
গিন্নি সোজা বেডরুমে ঢুকে আমার গায়ের লেপটা এক টানে সরিয়ে দিলেন আর ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো — আর তোমাকে আমি মেয়েদের নিয়ে খেলতে সুযোগ দেব না। তোমাকে দিয়েই সব কাজ করাবো। একদম ঠিকমতো কাজ করে যাবে আর ভুল করলেই বিপদ তোমার শিয়রে আমি শনি হয়ে দাঁড়াবো।
আমি শীতে কেঁপে উঠলাম , কাঁচুমাচু মুখে ক্যাবলার মত চেয়ে রইলাম।
বউ সুযোগ দিল না — যাও যাও বাজারে যাও আর ভালো মনে ভালো ভালো সবজি নিয়ে আসো। যদি আজ আবার ভুলভাল করো, তাহলে তোমার একদিন কি আমারই একদিন!
আর হ্যাঁ আরো একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো রাস্তাঘাটে একদম মাথা নিচু করে থাকবে অন্য কোন পেত্নীর দিকে যেন চোখ তুলেও না দ্যাখো।
মনে থাকবে? ?
আমি ভয়ে বাধ্যসন্তানের মত ঘাড় কাত করে দিলাম।
-----------------------------------
অমাদীপ_প্রদীপদে
প্রদীপ কুমার দে
বিরাটী আবাসন
এল আই জি -৯
এম বি রোড
নিমতা
কোলকাতা।