গল্প।। প্রথম আলাপ।। সেখ মেহেবুব রহমান
সজোরে ধাক্কায় ক্যামেরাটা পরে যাবার উপক্রম। ভাগ্যিস! ফিতেটা গলায় গতিয়ে নিয়েছিলাম, না'হলে ব্রিক লেনের সব স্মৃতিটুকু শুধু মনে গেঁথে দেশে ফিরতে হতো। পিছন ফিরে লোকটার দিকে তাকালাম, কিন্তু ভুলটা আমারই। ছবি তোলার নেশায় কখন যে মাঝ রাস্তায় নেমে পড়েছিলাম খেয়াল করিনি। কলকাতায় হলে তো এতক্ষণে...
দিন দশেকের জন্য গবেষণার কাজে লন্ডন গিয়েছিলাম। প্রথমবার দেশের বাইরে, তারপর আবার লন্ডন! এখনো মাঝে মাঝে ভাবলে, শরীরের লোম খাঁড়া হয়ে ওঠে।
বিদেশ যাত্রার সখ সবারই থাকে। তাই সুযোগ আসলে মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠা বাস্তবিক। তবে সত্যি বলতে মন যে কিছুটা লোভীও হয়ে ওঠে। এখানে আসার পূর্বে কতজনকে ইচ্ছাকৃতভাবে একথা শুনিয়েছিলাম! স্রেফ আত্মতুষ্টির জন্য। যদিও সেখানে যাবার পর উপলব্ধ হয়, কাদা মাটির গন্ধের কাছে সবই ফিকে। লন্ডনে যাবার পর থেকেই প্রতিনিয়ত বাড়ির জন্য মন উদ্বেলিত হয়ে উঠত। বাড়ির ঘুম আর মায়ের হাতের রান্না বেশি মিস করতাম। তবে এই কৃত্তিন নিঃসঙ্গতায় এক বিশেষ প্রাপ্তি ছিল। চারিদিকের অচেনা পরিবেশ, অজানা সভ্যতা, অন্যধারার মানুষজন, তাদের বিচিত্র আচার, এক না দেখা সৌন্দর্যকে আরোহণ করতে উৎসাহিত করত সর্বদা। জানতে ইচ্ছা হত, কেন তারা উন্নত, গুণী মানুষের সমৃদ্ধ এই বাংলার খামতি কোথায়? কেন আমরা তাদের থেকে পিছিয়ে? অচিরেই বিজ্ঞানের আরোহণ ছেড়ে মানবসভ্যতার গবেষণায় নিযুক্ত হয়ে পড়েছিলাম।
কাজের চাপ কিছুটা কমতেই ভাবলাম একটু চারিদিক ঘুরে নিলে কেমন হয়। বাঙালি খাবারের খুব ইচ্ছা হচ্ছিল তাই ব্রিক লেনে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। লন্ডনের এই অঞ্চলে প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা চোখে পড়ার মতন। যদিও এখন তাঁরা এই দেশের নাগরিক। বিংশ শতাব্দীর অবধি ব্রিক লেন আইরিশ ও ইহুদি জনগোষ্ঠীর মানুষের আধিক্য বেশি ছিল। বর্তমানে বাঙালিদের। বিশেষত বাংলাদেশের সিলেটি এলাকার মানুষের বসবাস বেশি। তবে এপার বাংলা হোক কিংবা ওপার, বাঙালি তো বাঙালিই। বাংলা বাদে তো অন্য কোনো ভাষায় কথা বলবে না। মন খুলে একটু কথা বলা যাবে। বিদেশ বিভুঁয়ে নিজের প্রিয় ভাষায় কথা বলতে পারার চেয়ে পরম সুখ কিছুই হয় না।
ব্রিক লেনের বাজার দেশ বিদেশের পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। মূলত রবিবাসরীয় বাজার। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই বাজারের প্রথম সূত্রপাত। তখন এই অঞ্চলে ইহুদিদের বসবাস বেশ বেশি ছিল। ওদের কাছে শনিবার হল বিশ্রাম বার, যেমন আমাদের ভারতীয়দের কাছে রবিবার। তাই শনিবার দোকানপাট বন্ধ থাকাতো, আর কেনাকাটার সব চাপ রবিবারে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যেত। স্বাভাবিক ভাবেই রবিবারে মানুষের ভিড়, ব্যস্ততা ক্রমেই দর্শনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। আজকের দিনে ব্রিক লেনে এর এই ভিড় সেই অতীত ইতিহাসের সাক্ষ্য বাহন করে নিয়ে চলেছে।
ব্যস্তবাগিশি বাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও হৃদয় স্পর্শ করেনি। আসলে ভিড় আমার খুব একটা পছন্দ হয় না। ছোটো থেকেই ভিড় এড়িয়ে চলেছি। ওখানেই বা তার ব্যাতিক্রম কেন হবে? রেস্টুরেন্ট পেট পুজো করে, দ্রুত ব্রিক লেন ছাড়ার প্ল্যানিং করলাম। কিন্তু এই শহর আমার জন্য সব কিছু অন্যভাবে সাজিয়ে রেখেছিল, ভাবতে পারিনি। রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে গন্তব্যে ফেরার উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় রাস্তার দুপাশের স্ট্রীট পেন্টিং গুলো নজরে আসতে আমার গতিরুদ্ধ হল। আসার সময়, গাড়িতে আসায় খেয়াল করিনি। ফেরার পথে চোখে আসতেই, অদ্ভুতভাবে কোলাহল উপেক্ষা করে তাদের আহ্বানে সাড়া দিলাম। কি অসাধারণ চিত্রকলা! দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় শিল্পীর মনের ভাবনা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। রয়েছে গভীর ভাবার্থ যুক্ত তুলির টান। ক্যামেরা তুলে সেগুলো ক্যাপচার না করে পারলাম না। এক মনে রাশি রাশি চিত্র ক্যামেরাবন্দী করতে গিয়ে কত গলি যে পেরিয়ে গিয়েছিলাম, আজও ভেবে উঠতে পারিনি।
বিভিন্ন আঙ্গেল থেকে কেমন লাগে, অন্য কোনো অর্থ বেড়িয়ে আসে কিনা, এইসব করতে গিয়েই নিজের অজান্তে অবশেষে মাঝ রাস্তায় উপনীত হয়। তারপর এই জোড়ালো সংঘর্ষ। বিরক্ত হলাম, কিন্তু ভুল আমারই। অতএব কোনো শব্দ ব্যায় না করে পাশের চিত্রকলায় মনোনিবেশ করলাম।
এইভাবে আরও কিছু পথ আনমনে এগিয়ে যেতে হঠাৎই এক মিষ্টি নারী কণ্ঠ থেকে বিকশিত হওয়া ইংরেজি গান কানে ভেসে আসতে হুঁশ ফিরল। ব্রিক লেনের রাস্তায় এত প্রতিভার সাক্ষ্য থাকব ভাবতে পারিনি। ভিড়ের ভয়ে দ্রুত চলে গেলে অনেক কিছু মিস করে যেতাম। ক্যামেরাটা নামিয়ে পিছন ফিরলাম। দেখি রাস্তার ওপারে একদল বছর বাইশ তেইশ এর ছেলে মেয়ে এই অভূতপূর্ব পথ সঙ্গীতের উপস্থাপনা করছে। ওদের কেন্দ্র করে বেশ ভিড় জমেছে। তাই রাস্তা না পেড়িয়ে এদিকে দাঁড়িয়ে রইলাম।
বিদেশের রাস্তায় নিজনিজ প্রতিভা নিয়ে হাজির হওয়ার কথা শুনেছিলাম, সারাদিন সেগুলোই চাক্ষুষ করছিলাম। গানটি, প্রখ্যাত বিদেশি গায়ক রালফ এমসি টেল এর গাওয়া 'স্ট্রিট অফ লন্ডন'। ইংলিশ লিরিকের গান শুনতে খুব একটা অভ্যস্ত ছিলাম না। স্ট্রিট অফ লন্ডন এর আগে কখনো শুনিনি। কিছু বুঝতে পারছিলাম, কিছুটা নয়। কিন্তু এই আধবোঝা লিরিক গুলো মনকে অস্থির করে দিয়েছিল, বাধ্য করেছিল পরে গানটি সমন্ধে জানতে। পরে গুগল সার্চ করি, অনেক বিদেশি বন্ধুদের থেকেও জানার চেষ্টা করেছিলাম।
রালফ এমসি টেল ১৯৬৯ সালে প্রথম এটি রেকর্ড করেন। পরে যদিও রি-রেকর্ড হয়েছে অনেকবার। গানের মাধ্যমে গৃহহীন, পিছিয়ে পড়া, নিঃসঙ্গ মানুষের রোজকের সমস্যাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সময় পাল্টেছে, কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। আজও অভুক্ত, অসহায় মানুষের দল, গৃহহীন অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় রাত কাটায়। শুধু স্ট্রিট বদলায়, কিন্তু চিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়না। অতীতেও হয়নি, আগামীতেও হয়তো...
গানটি ওখানে গাওয়ার পিছনে আরও একটা কারণ অবশ্য ছিল। তাঁর সাথে সাক্ষাতের পর সেকথা জানতে পারি।
গান শেষ হওয়ায় কিছু আগে, ভিড় অগ্রাহ্য করে ওদের প্রদর্শনীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভালোভাবে গ্রুপের প্রতিটি সদস্যকে অবজারভাড করতে আরম্ভ করলাম। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ইনস্ট্রুমেন্ট কি অপার দক্ষতার সাথে বাজাচ্ছে। ওদের ডেডিকেশন দেখে হিংসা হয়েছিল। লোভ চেপে রাখতে পারিনি, পরে সেকথা জানিয়েছিলাম। যদিও তরুণীর প্রতি আমার আকর্ষণ অন্যদের থেকে বেশি ছিল। উনি আধুনিকা, দেখতে বেশ ভালো, অন্তত আমার চোখে, তারপর এইরূপ কণ্ঠস্বর, যে কোনো অবিবাহিত ছেলের মনে দোলা দিতে এটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু এত বিশেষণের পরেও, উনি আমার কাছে সেই মুহূর্তে অনন্যা ছিলেনআসলে বিদেশি পোশাকে নিজেকে সাজিয়ে তুললেও, কপালের একখানি ছোট লালটিপ আমায় বারবার এই বাংলার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। হলুদ শাড়ি, লাল ব্লাউজ, কপালে লালটিপ এইসবই বাঙালিয়ানার নিদর্শন। প্রথমের সবকিছু অনুপস্থিত থাকলেও, লালটিপ আমার চোখ এড়িয়ে যায়নি। বরং কণ্ঠস্বরের মতই আকর্ষণ করেছে। ক্যামেরা তুলে মনন স্পর্শী নারীর একাধিক ছবি তাঁর অজান্তেই তুলে নিলাম। অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়, এই বিদেশ যাত্রার আকস্মিক উপহার হিসাবে।
এতকিছুর পরেও একটা খটকা আমার মাথায় বেশ নাড়া দিচ্ছিল। না, আমি এটা ভাবিনি যে, তরুণী বাঙালি না হয়ে পৃথিবীর অন্য কোনো এলাকার বাসিন্দা। লাল টিপ, মুখে মিষ্টি হাসি দিয়ে, হৃদয় দোলানোর ক্ষমতা শুধু বাঙালি নারীরই আছে। অতএব এই ভাবনার প্রশ্ন ওঠেনা। বরং একধাপ বেশি ভেবে, একটু হতাশ হচ্ছিলাম। বাঙালি হয়ে বাংলার গান কেন গাইছে না! অনেকে হয়তো বুঝবে না ঠিকই। কিন্তু বিদেশের মাটিতে, আমাদের ভাষার মমত্ব এর থেকে ভালো বহিঃপ্রকাশ হতে পারে না। স্থির করলাম গান শেষ হলে সাক্ষাতের সময় একথা জানাব। অভিযোগ নয়, অনুরোধের স্বরূপ হিসাবে।
আরও কয়েকটি অভূতপূর্ব সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে পথ অনুষ্ঠান শেষ হল। গান চলাকালীন অনেকেই সাধ্য মতো যে অর্থ দিয়েছে, দেখলাম একজন এসে সেগুলো গুণে, ব্যাগবন্দী করলেন । বাকি'রা মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট গুলো ব্যাগ বন্দী করতে রইলেন। গান শেষ হওয়ায় ভিড় কমতে শুরু করল। অদূরে দাঁড়িয়ে আমি এসবই প্রত্যক্ষ করছিলাম, সাথে ভাবছিলাম, কথা বলা কি ঠিক হবে? যদি বলি, কিভাবে শুরু করব, ধন্যবাদ দিয়ে নাকি অন্য কোনোভাবে।
বেশকিছুক্ষণ ওনার দিকে তাকিয়ে থাকতে হঠাৎ দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। উনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, আমি ওনাকে দীর্ঘক্ষণ দেখছি। তবে সত্যিই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন কিনা, আজও জানতে পারিনি। দৃষ্টিবদ্ধ হতেই, মাইক্রোফোনের তারটি রোল করতে করতে আমার দিকে দ্রুত এগিয়ে এলেন। প্রথমে ঐরূপ চাওনি, তারপর এইভাবে কাছে চলে আসতে, আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। সব কিছু তাড়াতাড়ি হওয়াতে ঠিক কি বলা উচিত ভেবে উঠতে না পেরে, জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে পরিস্থিতি সামাল দিতে উদ্যত হলাম। ওনার এইরূপ আচরণে আমি যে বিব্রত হয়ে পড়েছি, বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। কোমল হাসি দিয়ে ইংরেজিতে বলল, "ডু ইউ ওয়ান্ট টু সেয় সামথিং?"
আমি সভাবসিদ্ধ বাঙালি ভঙ্গিতে, মুখে ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বললাম, " না মানে। তেমন কিছু না। ইউ সাং ভেরি নাইসলী। আই ইন্সপ্রাইড..."
জড়ানো ইংরেজিতে, ওই মুহূর্তে এর বেশি কিছু বলা সম্ভব ছিল না। তবে উনি শেষ দু'লাইন তারিফের থেকে অপ্রস্তুত গলায় বেড় হওয়া শুদ্ধ বাংলা শুনে বেশি আনন্দিত হলেন। উৎসাহী মনে আমায় জিঞ্জাসা করলেন, " আপনি বাঙালি!"
ওনার দুচোখের খুশি, মুখে হঠাৎ পাওয়া উপহারের হাসি দেখে আমি আপ্লুত হয়ে উঠলাম। উনি যে বাঙালি আগেই বুঝেছিলাম, অপ্রস্তুত থাকলেও কথা বলতে মনস্থ ছিলাম। কিন্তু তাঁর আহ্বান আমার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে ভাবিনি। আসলে প্রিয় ভাষা, সংস্কৃতি ছেড়ে দীর্ঘদিন দূরে থাকলে, মনের মধ্যে এক অপ্রকাশিত আবেগ পঞ্জিভূত হয়। আর তার বহিঃপ্রকাশ এইভাবে, বাঁধাহীন উচ্ছ্বাসের মাধ্যমে হয়। তাঁর উদ্দীপনা এতটাই বেশি ছিল, আমি বাঙালি, সেকথা আলাদা করে বলার প্রয়োজন হল না। মনের কিন্তু ভাব আচমকা উবে গিয়ে, বিদেশের মাটিতে বাংলার মাঠের খোলা হাওয়া আমার স্নায়ু বরাবর বয়ে গেল।
আমি বাংলাতেই মেয়েটির নাম জিঞ্জাসা করলাম। হেসে বললেন, " আমি বর্ণালী। বর্ণালী মৈত্র"।
আমি তাঁর নামের বাহবা দিয়ে বললাম, "দারুন নাম'তো। কে রেখেছে? আমাদের রসায়নে এই বর্ণালী কিন্তু পরতে পরতে লাগে।
উনি মজা করে বললেন, "গান শুনে আপনি নামের প্রশংসা করছেন!"
আমি মৃদু হেসে বললাম, "না না, আপনার কণ্ঠস্বর, আপনার নামের মতই মিষ্টি, মনন স্পর্শী, হৃদয়ে দোলা দেয়, ভাবতে বাধ্য করে।"
"বাবা! কি কঠিন বাংলা বলেন আপনি"
" মনের ভাব প্রকাশ করতে মাঝে মাঝে কঠিন বাংলা, কথার মাঝে আনতে হয়, বুঝলেন"
"অনেকদিন পর একজন স্বভাষী মানুষ পেলাম। বাংলা বলতে ইচ্ছা হলো, তবে এত কঠিন নয়"
আমি হাসিমুখে তাঁর কথার সম্মতি জানালাম। আসলে ভাষা যায় হোক, মানুষ স্বাচ্ছন্দে কথা বলতে চায় সব সময়। কখনো পারে, কখনো পারে না। উনি এবার আমার পরিচয় জিঞ্জাসা করে বললেন, "আপনার নামটা বললেন না'তো, এখানেই থাকেন নাকি?"
নিজের নাম দ্রুত বলে, ওনাকে এখানে আসার কারণ সংক্ষেপে বললাম। আমার বাড়ি ব্যান্ডেল শুনতে বেশ উৎসাহ নিয়ে বললেন, "আপনি তো আমার মামার বাড়ির লোক। বহুদিন যায়নি জানেন। লাস্ট গেছিলাম এখানে আসার আগে, মনে প্রায় তিন বছর হবেই"
আমি অবাক হয়ে বললাম, "আপনি তিন বছর এখানে!"
"হ্যাঁ, অবাক হচ্ছেন?"
"আসলে দশ দিন বাড়ি ছেড়ে আছি, তাতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত, আর আপনি তিন বছর!"
"বাড়ি ছেড়ে থাকতে কার ভালো লাগে বলুন, কিন্তু স্বপ্ন ছিল বিদেশ গিয়ে পড়াশোনা করবো। বাবার টাকা আছে চলে এলাম। সবার এই ভাগ্য থাকেনা বলুন?"
কোথায় কি পড়াশোনা করছে, সে প্রশ্ন মনে এলেও, তাঁর উচ্চারিত শেষ দু লাইনে এক গভীর শ্লেষ অনুধাবন করলাম। টাকার জোড়ে পড়ছে, একথা পাড়া প্রতিবেশী ব্যাঙ্গ করে বলে। কিন্তু নিজেই নিজেকে বিদ্রুপ করছেন! মনে হল হয়তো কোনো আঘাত থেকে একথা বলছেন। জিঞ্জাসা করা কি উচিত হবে, এই ভাবতে কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। আমার নিস্তব্ধতায় তিনিও দেখি চুপ করে দাঁড়িয়ে চলমান গাড়ির গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। মানবজীবন তো এইরকমই গতিময়। পাশে কি হচ্ছে কিছুই তোয়াক্কা না করে আপন গতিতে ছুটে চলেছে।
শেষে জিঞ্জাসা করেই ফেললাম। যদিও তিনি মনমরা ভাবের কারণ প্রকাশ না করে বললেন,"ছাড়ুন সেকথা। একটু ওয়েট করুন, মাইক্রোফোনটা রেখে আসি"।
এড়িয়ে যাবার জন্য একথা বললেন, নাকি এটা স্বাভাবিক একটা ঘটনা, বুঝতে পারলাম না। এটুকু বুঝলাম কারণ আছে, একজন অপরিচিত ব্যাক্তির কাছে বলা যাবে না। আমিও তো সব কথা ওনাকে বলছি না। তাহলে উনিই বা বলবেন কেন? বরং এই প্রসঙ্গ ত্যাগ করা উচিত বলে মনে হল। তাই আর বেশি কিছু না ভেবে দাঁড়িয়ে রইলাম।
ওনাদের গ্রুপটা বেশ ভালো। সবার মধ্যে অদ্ভুত বন্ধন আছে। সবাই ভিন্ন দেশের, ভিন্ন ভাষীর, তারপরেও আন্তরিকতা, বোঝাপড়া অসামান্য। ক্যামেরাবন্দী করলাম পুনরায়। সবাইকে একসাথে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা যেত, কিন্তু তাতে প্রাণ থাকতো না। তাই সেই অনুরোধ করলাম না।
মিনিট দুয়ের মধ্যে ফিরে এসে বললেন, "আপনার ফটোগ্রাফীর সখ আছে বলুন, তখন ছবি তুলছিলেন, আবার এখনও। ভাবছেন বুঝতে পারিনি বুঝি"।
আমি লজ্জিত হয়ে পড়লাম। আমার অনুমান ছিল উনি হয়তো বুঝতে পারবেন না। কিন্তু ওনার স্মার্টনেসের কাছে আমার ইচ্ছাকৃত চালাকি ধরে পড়ে গেল। লাজুক হয়েই বললাম, "আমার ছোটো থেকেই ফটোগ্রাফীর সখ। তাতো আর হয়ে উঠলো না। তাই এইভাবে..."।
"বুঝলাম"
"আপনার গান ভালো লাগলো। তাই গানের কিছু দৃশ্য তুলে নিলাম। অন্য কোনো মতলব নেই কিন্তু"
"শুধু আমার গান! আমায় ভালো লাগেনি?"
কথা বলতে বলতেই উনি হাসতে শুরু করলেন। আমিও বেশ চিৎকার করে হাসতে থাকলাম। রাস্তার পাশ দিয়ে কয়েকজন বিদেশিনী আমাদের কান্ড দেখে নিজদের মধ্যে কিছু একটা বলা কওয়া করছিল। আসলে দুই বাঙালি এক কাছে থাকলে এমনটা যে হবেই, তা হয়তো ওরা জানেনা। তাই কৌতূহলী হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়েছিল। দুজনেই এসব কিছুকে পাত্তা না দিয়ে বকে চললাম।
আমিও যে ওনাকে বাঙালি ভেবেই কথা বলতে এগিয়ে এসেছিলাম সেকথা বলতেই, কৌতূহলী হয়ে বললেন," কি করে বুঝলেন? আমার গেটআপ তো, এক্সপ্রেস করছে না"।
আমি বললাম, "গেটআপ বিদেশিনীর মতো হলেও, কপালের ঐ লালটিপ আপনার অন্তরের বাঙালিয়ানার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে দিয়েছে"।
"বাবা! আপনার তো বিশাল চোখ দেখছি"
"বাইরে একা এসেছি, চোখ কান তো খোলা রাখতেই হবে"
"লালটিপ সত্যিই বাঙালিয়ানা প্রকাশ করে বলুন?"
"একশো বার। এরাই তো আমাদের ঐতিহ্যের ইন্ডিকেশন"
"আমার মা'ও তাই বলে"
মায়ের কথা আসতেই দেখলাম ওর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মায়ের থেকে দূরে থাকার কষ্ট সবারই হয়। বললাম, "মাকে মিস করছেন বলুন। কবে ফিরবেন দেশে?"
"দু মাস পরে"
"বাহ্! তাহলে তো হয়েই এল। এইরকম শুকনো মুখ করে থাকবেন না প্লীজ"
"ওই আনন্দেই দিন কাটাচ্ছি। রোজ ক্যালকুলেট করি আর কটা দিন বাকি"
"এইভাবে ঠিক একদিন এসে যাবে, দেখবেন"
সামান্য হেসে বললেন, "পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ। অনেকদিন পর এই ব্যাপারে কারো সাথে কথা বলে হালকা লাগছে"।
আমি বললাম, "এতে ধন্যবাদের কিছুই নেই। আপনি আপনার মনের জোড়ে এখানে এসেছেন। এতদিন আছেন। সবটাই আপনার কৃতিত্ব"।
"বেশ বেশ, বুঝেছি। আচ্ছা আপনি কবে ফিরছেন?"
"তিন দিনের মধ্যেই। দেশে ফিরে দেখা হবেই"
"এটাই বলতে যাচ্ছিলাম। আপনার কন্ট্যাক্ট নাম্বার?"
হাতে থাকা মোবাইলটা অন করে আমার নাম্বার বলার জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করলেন। আমিও দেরি না করে, এক নিঃশ্বাসে নিজের কন্ট্যাক্ট নম্বর, পূর্ণাঙ্গ অ্যাড্রেস দিয়ে দিলাম, সাথে ওনারটাও নিয়ে নিলাম। নাম্বার আদান প্রদান শেষ হতেই উনি আমাকে কফি পানের আমন্ত্রণ জানলেন। আমি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললাম, "এক ঘন্টা আগেই পেট পূজো সেরেছি। খিদে নেই বুঝলেন। সত্যি বলতে কফি তেমন ভালো লাগে না। আপনি চলুন না"।
"না না, আমার ইচ্ছা নেই তেমন। আপনি গেলে যেতাম"
"অফার রিফিউজ করে ভুল করলাম মনে হচ্ছে"
"আরে না না। ইটস ওকে। আপনার সাথে দেখা হল এটাই অনেক"
"আমিও খুশি, বাড়ির এনভায়রনমেন্ট মিস করছিলাম। এখন ভালো লাগছে"
সামান্য সময়ের ব্যবধানে এত সুন্দর পরিচিতি হয়ে উঠবে ভাবিনি। ওনার সাথে কথা বলতে আমি কমফোর্ট ফিল করছিলাম। এবার মনে হল প্রথমে উদয় হওয়া মনের অভিযোগটা করেই ফেলি। কোনরকম ইতঃস্তত ছাড়াই ওনাকে বললাম, "একটা অভিযোগ আছে। যদি কিছু মনে না করেন বলতে পারি"।
হঠাৎ এহেন প্রশ্নে বিস্মিত হয়ে বললেন, "অভিযোগ! আমার কোনো কোথায় খারপ লেগেছে ? প্লীজ বলুন"।
"ধুস, তা নয়"
"তাহলে!"
"আপনি একটা গানও বাংলায় কেন গাইলেন না! এত সুন্দর গলায় রবীন্দ্রসংগীত কোন উচ্চতায় পৌঁছতে পারে আপনি আন্দাজ করতে পারছেন"
মৃদু হেসে বললেন, "বিদেশের মাটিতে বাংলা গানের মর্ম কেউ বুঝবে?"
আমি বললাম, "তা অবশ্য ঠিক, কিন্তু গানের মাধ্যমে বাংলার সংস্কৃতি দারুণভাবে প্রকাশিত হয়"।
"এটা ভুল বলেননি"
"তবে যে গানই হোক, যদি জীবনের কথা বলে, মর্মাথটাই পাল্টে যায়"
"একদম। জীবনের কথাগুলোই তো গানে বাঁধা হয়"
"আপনি নিশ্চয় রবীন্দ্রসংগীতও পারদর্শী"
মৃদু হেসে বললেন, "কবিগুরু হাতে গড়া বিশ্বভারতীর মেয়ে হয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত না জানা অন্যায়। আমি বেশ পাড়ি। সুযোগ হলে নিশ্চয় শোনাবো"।
আমি উৎসাহী হয়ে বললাম, "নিশ্চয়। এখন হলেও প্রবলেম নেই"।
উনি বললেন, "আজ না, অন্য দিন হবে"
আমাদের কথোপকথনের মাঝেই, ওনার গ্রুপের একজন ডাকতেই, পিছন ফিরে তাকিয়ে ইশারায় কিছু একটা বলে পুনরায় আমার দিকে তাকালেন। আমি ওনার গ্রুপের সদ্যসেদের ব্যাপারে জানতে চেয়ে বললাম, "আপনাদের মধ্যে বন্ডিংটা দারুণ। ইশারায় সব বুঝিয়ে দিলেন। ওনার এখানকার, নাকি আমাদের মতই বাইরের?"
উনি বললেন, "দুজন ব্রাজিলিয়ান আর একজন কানাডার। তবে ওরা এখানে আমার থেকে বেশি দিন আছে। গানের মাধ্যমেই আলাপ। এখন একটা ব্যান্ডের মত"।
"খুবই ভালো ব্যাপার। অবসর কাটবে, মনটাও ফ্রী থাকবে"
"ভালো খারাপ বলতে পারবো না। তবে মনের এক সুপ্ত ইচ্ছাকে রূপ দিতে চাই"
"এইভাবে বলছেন কেন?"
"না এমনি"
"আরে বলুন প্লীজ। আমায় বিশ্বস্ত মনে হচ্ছে না?"
শেষ কথাটি শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, "বিশ্বাস অবিশ্বাস নয়। কিভাবে বোঝায় আপনাকে"।
আমি বললাম, "যেভাবে এক চেনা বন্ধুকে কিছু বলে থাকেন, সেইভাবেই..."
উনি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে, গভীর আবেগপ্রবণ হয়ে বলে চললেন, "আসলে এখানে আসার আগে এক কাছের বান্ধবীকে হারিয়েছিলাম। আমাদের দুজনেরই ইচ্ছা ছিল বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করার। সেই মত কলেজ কমপ্লিট করে বিদেশ যাবার প্ল্যানিং করছিলাম। আমার আসতে কোনো বাঁধা ছিল না। বাবার টাকা আছে। ইচ্ছাগুলো শুধু বাস্তবায়নের অপেক্ষা। প্রবলেমটা আমার বান্ধবীর এসেছিল। ওদের ফ্যামিলি ইনকাম সেরকম ছিল না। ও যখন এখানে আসতে চাইল, ওর পরিবার সুকৌশলে বিয়ে ঠিক করে দেয়। আমি ওর পরিবারের মানুষদের বুঝিয়ে ছিলাম। ওনার শোনেনি। আমি বাবাকে বলে ওর আসার ব্যবস্থা করে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার জেদী বান্ধবী আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। আর দেখুন সেই জেদী মনোভাব আজ ওকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি এখানে আসার আগে একদিনের জন্য মামার বাড়ি যায়। সেই রাতেই ও সুসাইড করে"।
গলার স্বর জড়িয়ে আসতে, উনি থামলেন। আমি বললাম, "আপনার বান্ধবী সুইসাইড করে হার মেনে নিল?"
"জেদী ছিল বড্ড। সেদিন আমার কথা শুনলে। আজ সব অন্যরকম হতো"
"অন্যরকমই নয়। অনেক ভালো কিছু হতে পারত"
উনি এরপর যা বললেন, তাতে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো সেই জন্যই আজও আমি তার দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছি। জানিনা কবে দেখা হবে।
আমার দিকে তাকিয়ে উনি বললেন, "অনেক দিন অবধি সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কাজ করতাম, শান্তি পেতাম না। এখানে আসার পর, বাড়ির থেকেও বেশি আমার ওর জন্য কষ্ট হত। আপনার সাথে কথা বলতে গিয়ে আমার ওর কথায় মনে পড়ছিল"।
ওনার যন্ত্রণা উপলদ্ধি করতে পারছিলাম। সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, "এই তিন বছরে একাকীত্ব উপলোব্ধি করতে পারছি। সাময়িক আলাপ হলেও আমাকে আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবতে পারেন। আপনার ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে পারলে ভালো লাগবে"।
উনি বললেন, "আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়ার মতো ভাষা আমার কাছে নেই। বন্ধু পেয়েছি এখানে, কিন্তু এই আন্তরিকতা পাই নি। জানেন, এখানে আসার পর মনের একাকীত্ব দূর করতে গান বেছে নিই। এইভাবে আপন করে নেওয়ার ভাবনা যদিও তখন মনে আসেনি। আপনার মতোই একদিন এই ব্রিক লেনে রাস্তায় আমার বর্তমান সহকর্মীদের উপস্থাপনা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ি। পরে কথা বলতে ওরা আমায় আহ্বান করে। আর আজ এখানে"।
আমি বললাম, "আপনার মনের অন্তরালে এত অনুভূতি, ভালোবাসা, যন্ত্রণা লুকিয়ে রয়েছে ভাবতে পারিনি"।
উনি হাসলেন, কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। উত্তরের অপেক্ষায় এক দৃষ্টিতে ওনার দিকে চেয়ে রইলাম। একটু বিরতি নিয়ে বললেন, "সব সময় ভাবতাম আমার বান্ধবীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে কিছু একটা করব। কি করা উচিত বুঝতে পারতাম না। এখন গান সেই ইচ্ছা পূরণ করে। স্ট্রীট পারফর্ম বা স্টেজ শো করে যে সামান্য অর্থই পাই, বাবাকে পাঠিয়ে দিয়। বাবা ওখানে এক অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেয়। এখানে আসার খরচ প্রচুর। এখন সেটা বহন করার ক্ষমতা আমার নেই। তাই এইভাবেই। তবে আমি এতেই তৃপ্ত"।
আমি হতবাক হয়ে শুনছিলাম। এই বয়সে সবাই যেখানে নিজের নিয়েই ব্যাস্ত, মনের তৃপ্তির জন্যে কারও এত আত্মত্যাগ, ক্ল্পনা করা যায় না। দেশে থেকেও, প্রতি নিয়ত আমার অনেকই দেশেরই ক্ষতি করে চলেছি। কিন্তু একদম বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে দেশের জন্য তাঁর অপ্রকাশিত অবদান আমায় বিস্মিত করেছিল। বাঙালির এইরূপ এখন লুপ্ত হতে বসেছে। ওনার মত মানসিকতার মানুষের আজ বড়ো প্রয়োজন। শিক্ষায় সুস্থ সমাজ গড়ে, গঠিত হয় এই উদার মানসিকতার।
দুচোখে বিস্ময় নিয়ে বললাম, "বর্নালীতে সাত রঙ থাকে। তাদের ছটায় এই পার্থিব পরিবেশ রঙিন হয়ে ওঠে, গঠিত হয় জীবনের রামধনু। আপনি সেই সব অসহায় মানুষের জীবনের সাতরঙা আলো"।
"ধন্যবাদ, তবে এত সুন্দর উপমার যোগ্য কিনা, জানি না"
"আপনার ব্যাতিক্রমী ভাবনায়, অনন্যা করে তুলেছে"
"আচ্ছা আচ্ছা, আর সাহিত্যিক ভাব নয় প্লীজ"
কথাটা শুনে মজা পেলাম। বললাম, "বেশ বেশ। চলিত বাংলায় বলব এবার। তবে একটু হাসুন। আর মুখ ভার নয়"।
মৃদু হাসলেন, যদিও কিছু বলার আগেই উনি আবার ওনার সহকর্মীদের কাছে ফিরে গেলেন। ওনারা এতক্ষণ আমাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বিশেষ কিছু আলোচনা করছিল। বোধহয় এরপর কোথাও পারফর্ম আছে, সেসব নিয়েই কিছু হবে। মিনিট তিন পর ফিরে এসে উনি বললেন, "সরি একটু ওয়েট করতে হল। আসলে আজ একটা স্টেজ শো আছে। গাড়িতে নিতে আসার কথা এখনও এল না। তাই নিয়েই একটু..."
আমি ওনাকে থামিয়ে বললাম, "খারাপ লাগার প্রশ্নই ওঠে না। আপনি ইচ্ছা করলে আপনার বন্ধুদের সাথে কথা বলতে পারেন। আমি পাশেই আছি"।
"না না, ওরা ব্যাপারটা বুঝেছে। গাড়ি এসে যাবে। আমরা কথা বলি..."
আমি আপত্তি করলাম না। উনি এতে খুশিই হলেন। মিনিট খানেক আরও ভিন্ন কথাবার্তার পর উনি পরবর্তী অনুষ্ঠান দেখার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা ছাড়া উপায় ছিল না। বললাম, "আপনাকে আরও একবার নিরাশ করে বলছি, আজ হবে না। প্লীজ রাগ করবেন না। এখানের সেমিনারের রিপোর্ট দেশে পাঠাতে হবে। সেই সব নিয়ে স্যারের সাথে বসতে হবে"।
আমার অসহায়তা বুঝলেও, সরাসরি না করাতে, একটু আঘাত পেলেন মনে হল। কিন্তু আমি নিরূপায় ছিলাম। যদিও সেকথা প্রকাশ না করে বললেন, "নিশ্চয়, যার জন্য এত পরিশ্রম সেটাকে আগে প্রায়োরিটি দিতেই হবে। তবে পরে শুনতে হবেই। নাহলে রাগ করব"।
আমি বললাম, "একথা আলাদা করে বলতে হবে না। আপনি দেশে ফিরলে প্রথম গান আমাকেই শোনাবেন"
হেসে বললেন, "আমি শোনানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকব"।
আরেক প্রস্থ গল্পের আসর বসিয়েছি, হঠাৎই ওনাদের গাড়ি আসতে, তাতে ছেদ পড়ল। দ্রুত বিদায় জানানোর ক্ষণ উপস্থিত হওয়ায় বিমর্ষ হয়ে পড়লাম। ইচ্ছা হচ্ছিল আরও কিছু সময় কাটাতে। কিন্তু সময় যে প্রবাহমান। কিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয়। আসলে মানব জীবনই ক্ষণস্থায়ী। মনে মনে উপলদ্ধি করলাম স্বল্প সময়ের এই আত্মস্পর্শি আলাপচারিতা হৃদয়ে মেখে নিয়ে পরের সাক্ষাতের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
অন্তরের কষ্ট লুকিয়ে হাসিমুখে বিদায় জানাতে উদ্যত হলাম। ওনার মুখের দিকে তাকাতে, বুঝলাম তিনিও বিদায় জানাতে ইচ্ছুক নন। শুকনো মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "আর কিছুক্ষণ গল্প হলে ভালো হতো বলুন। কবে যে আবার দেখা হবে"।
"সত্যি বলতে, আমারও ইচ্ছা হচ্ছে না। সময় কত তাড়াতাড়ি চলে যায় তাই না"
"ঠিকই বলেছেন। এইতো সবে পরিচয় হল"
"আজ এখানে না এলে, অনেক কিছুই মিস করতাম। এক অনন্য অনুভূতির সাক্ষী নিয়ে দেশে ফিরব"
"আজকের অনুভূতি আমি বারবার ফিরে পেতে চাই। সময় যেন আমাদের আবার দেখা করায়"
"নিশ্চয় হবে। ফোন, হোয়াটস অ্যাপ তো রয়েছেই। প্রয়োজনে ফোন করবেন"
উনি বললেন, "সমান সামনি দেখা হওয়ার অনুভূতি অন্যরকম। সোশ্যাল মিডিয়া দূরত্ব দূর করে ঠিকই, কিন্তু মন কাছে অনে না। অনুভূতি জাগায় না"।
আমি সম্মতি জানালাম। তারপর দুজনে ধীরে ধীরে সেই নির্দিষ্ট গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। ওনার সব সহকর্মী গাড়িতে উঠে পড়েছিল। আমাদের সখ্যতা তারাও উপভোগ করছিল, হয়তো সেইজন্য ওনাকে গাড়িতে উঠতে তাড়া দেয়নি। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বিদায় জানানোর আগে মিষ্টি গলায় বললেন, "আমার ছবি গুলো তো পাঠালেন না। হোয়াট অ্যাপে পাঠিয়ে দেবেন"
আমি নাকচ করে বললাম, "সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নয়। দুজনের মধ্যে দুরত্ব যেদিন আবার এত কম হবে, সেদিন পাবেন। আশা করি অপেক্ষা করবেন"।
হেসে বললেন, " নিশ্চয়। তখন পাওয়ার ইচ্ছা আরও বেড়ে যাবে। খুব দ্রুত সেদিন আসুক, এটাই চাইব মনে মনে"।
"জলদি আসবে। দেখবেন.."
"আসি, দেশে ফিরে জানাবেন"
"নিশ্চয়, সাবধানে যাবেন"
কথা শেষের আগেই গাড়ি স্টার্ট হলো। গাড়িতে উঠে জানল দিয়ে মুখ বের করে উনি আমায় হাত নেড়ে বিদায় জানাতে রইলেন। ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে সেই নারীমুখ অদৃশ্য হয়ে গেল। যদিও তার প্রতিচ্ছবি আজও আমার মনে উজ্জ্বল। আমি ওনার চলে যাবার পরেও বেশ কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। ফিরতে মন চায় নি। দেশে ফিরেও বহুদিন সেই ক্ষণিকের সাক্ষাতের কথা ভেবে দিন কাটিয়েছি। কিন্তু কেনো জানিনা, কারও কাছে সেকথা প্রকাশ করতে পারি নি।
তাঁর আদর্শে আমি অনুপ্রাণিত, ভাবনাচিন্তায় আমি মুগ্ধ। তাঁর কণ্ঠে গান শুনতে উদগ্রীব, চাক্ষুষ করতে ব্যাকুল। হয়তো কোনো একদিন আবার সামনা সামনি হব, কথা হবে কাছ থেকে। এখন শুধু সেই দিনের অপেক্ষায়...
--------------------------
ছবিঋণ- ইন্টারনেট