চুপিচুপি পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল প্রমথেশ। চাপাস্বরে মাকে ডাকল। নিরুপাদেবী উঠে ঢাকা দেওয়া শাক ভাত নিয়ে এল। খেতে খেতে মায়ের সাথে দু'দন্ড কথা বলল। এটা রোজকার অভ্যাস প্রমথেশের। সেও এই ক'টা মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। বড় শান্তি পায়। সারাদিনের কষ্ট, শ্রান্তি যেন কেটে যায় একেবারে। মা'ও ক্যামন যেন বদলে যাচ্ছে দিন দিন। এই অস্থির সময়ে চারদিকে তুমুল গন্ডগোল। এক চরম অবিশ্বাস ও অরাজকতা কাজ করছে সর্বত্র। একমাত্র ছেলেকে অনেক বলেও কিছু লাভ হয়নি। আসলে কোন মা'ই চায় ছেলেকে অশান্তির আগুনে জ্বলতে দেখতে! কলেজে যাওয়ার পর থেকেই দেশমাতৃকাকে বন্ধন থেকে মুক্ত করার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়। ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণপণে। একে একে স্বদেশের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। এখন তার দেশই ধ্যানজ্ঞান। দিব্যি ভাল ছাত্র ছিল। অঙ্ক কষত নিমেষে। হেলায় সে সব ছেড়ে দিয়েছে। ডিগ্রির তোয়াক্কা পর্যন্ত করে নি। এখন অবশ্য আর মনখারাপ করেন না তিনি। বরং গর্বই হয় তার ছেলের জন্য।
নিরুপাদেবী মাসছয়েক আগে স্বামীকে হারিয়েছেন। সবেধন নীলমণি বলতে প্রমথেশ। আজ এই পরিস্থিতিতে এটাও জানা যে, যে কোন অনভিপ্রেত ঘটে যেতে পারে যে কোন সময়েই। শুধু তাই সবসময় ঈশ্বরের কাছে প্রমথেশের সুস্থতা ও সুরক্ষার প্রার্থনা করে। আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন তিনি। খেয়ে ওঠে প্রমথেশ। খাওয়া আর কি, কোনক্রমে বেঁচে থাকা। একে সামান্য পেনশনে চলে দু'জনের সংসার। তার ওপর ফিরিঙ্গিদের জারি করা কার্ফু জীবনকে নরক করে তুলেছে।
###
পাশের ঘরে তক্তপোশের উপর শুয়ে আছে প্রমথেশ। ক্লান্ত শরীর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
প্রমথেশ আর রুকসানা মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইছে.....'কদম কদম বাড়ায়ে চল.......'।
হাতে স্বাধীনকল্পিত দেশের পতাকা। হাওয়ায় উড়ছে পতপত করে।
রুকসানাকে ধীরে ধীরে পছন্দ করতে শুরু করেছিল প্রমথেশ। কিছু স্বপ্নও বুনতে শুরু করছিল দু'জনে। একটু একটু করে।
এই রক্তচোষা ফিরিঙ্গিরা দুর্বুদ্ধিতেও এগিয়ে। সর্বত্র মিছরির ছুরির মতো চালিয়ে দেয় বিভাজনের নীতি। আর তা যদি হয় ধর্মের ভিত্তিতে, তাহলে তো আর কথাই নেই। সুদূরপ্রসারী ও দ্রুতগামী হয়ে ওঠে তার ফল। আর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
অবিশ্বাস জন্ম নিতে শুরু করল মানুষে মানুষে। রুকসানার সাথে দেখা, কথা বলাও বন্ধ হয়ে যায়। বাড়ি থেকে সাত তাড়াতাড়ি নিকা করিয়ে দেয় রুকসানার। রুকসানার মুখটা সময়ে অসময়ে ভেসে ওঠে প্রমথেশের সামনে।
### হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় প্রমথেশের। বোমা পড়ছে, পুলিশের বুটের শব্দ। রাতের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে যায় মুহূর্তে।
প্রমথেশ আর বিচলিত হয় না। এ জিনিস এখন রোজের ঘটনা, গা সওয়া হয়ে গেছে।
পাতলা পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে আবার ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করে প্রমথেশ।
ঘুম কি আর আসে....তার চোখে যে এক দুরূহ লক্ষ্য। এক কঠিন স্বপ্ন দেখছে সে। তবে চোখভর্তি তার বিশ্বাস। আর বুকভরা সাহস।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট
.................................................