বয়স যখন চোদ্দ-পনেরো, তখন অরুনিতার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল সহেলীর। একই স্কুলে একই শ্রেণীতে পড়তো তারা। ধীরে ধীরে দুজনের বন্ধুত্ব এতই গাঢ় হয়ে উঠেছিল যে, একজন অন্যজনকে না দেখে থাকতে পারতো না। তারপরে স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে কলেজ, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে---সব জায়গায় তারা একই সঙ্গে পড়তো। রেজাল্টও দুজনের প্রায় কাছাকাছি। বান্ধবীরা নানান ব্যঙ্গ করত তাদেরকে নিয়ে। অরুনিতার ছেলেদের প্রতি আকর্ষণটা তেমন ছিল না বললেই চলে। সহেলীর সবই মেয়েবন্ধু ছিল। তবে অরুনিতার মতো কারোর সঙ্গে তার সম্পর্ক এতো গাঢ় ছিল না। 'গে' বলেও তাদের দুজনকে অনেকেই ক্ষ্যাপাতো। তাদের প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগলেও কিন্তু দীর্ঘ দিনের সম্পর্কে এই কথাটা যেন গা সওয়া হয়ে যায়। এরপর কেটে গেছে প্রায় পাঁচ বৎসর।
অরুনিতা বর্তমানে একটি হাই স্কুলের শিক্ষিকা ও সহেলী কলেজে পড়ায়। কেউই বিয়ে করেনি। দুজনেরই বিয়ের বয়স হয়েছে অনেকদিন। অরুনিতার বাড়িতে নিজের বলতে বাবা-মা ও একটা ভাই আছে ,যে গত বছরে ডাক্তারিতে সুযোগ পেয়েছে। আর সহেলীর নিজের বলতে শুধু মা আছেন। অরুনিতার বাবা-মা বিয়ে করার জন্য অনেক বলেছেন অরুনিতাকে, কিন্তু সে রাজী হয়নি। আর সহেলী মাকে ছেড়ে থাকতে হবে তাই চিন্তা করে বিয়ে করেনি।
অরুনিতা ও সহেলী সিদ্ধান্ত নেয় তারা বিয়ে না করে সারা জীবন একসাথে কাটিয়ে দেবে। ছেলে-মেয়ের বিয়ের সম্পর্কে এরা কেবল বিশ্বাসী নয়, এরা মনে করে মানসিক শান্তিই বড় কথা। সে শান্তি যদি দুটি মেয়ে কিংবা দুটি ছেলে একসঙ্গে থেকে পাওয়া যায়, তবে এভাবে সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করা যায়। সমাজ হয়তো অনেক কিছুই বলবে, তবে সব কথায় কান দিলে চলবে না। কামনা-বাসনা মানুষ মাত্রেই থাকে, তবে সেটি এক একজনের কাছে এক এক রকম।
কলেজ জীবনে পবন নামের একটি সহপাঠী অরুনিতাকে পছন্দ করত। তার পিছনে দীর্ঘদিন পড়েছিল। সে প্রেম নিবেদন করেছিল, কিন্তু অরুনিতা রাজী হয় নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নেহাল নামের একজন বন্ধু তাকে প্রেম নিবেদন করে হাত দুটো ধরে কেঁদে ফেলেছিল। অরুনিতাকে বলেছিল --- 'তাকে না পেলে সে আত্মহত্যা করবে'। কিন্তু তার কথায়ও সাড়া দেয়নি সে। সহেলীকে এ পর্যন্ত পাঁচ জনের বেশি প্রেম নিবেদন করেছে। তার মধ্যে একজন ডাক্তার ও দুইজন উকিল। কিন্তু সহেলী তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। তার মনে হয়েছে সে অরুনিতাকে ছাড়া কাউকে জীবনসঙ্গী করলে শান্তি পাবে না। তাই হয়তো কারোর প্রেমের প্রস্তাবকে মানে নি।
তাদের দুজনের এই একসঙ্গে থাকা তাদের বাড়ির লোকেরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেননি। অনেক রকম কথা শুনতে হয়েছে বাড়ির বাবা-মা ও আত্মীয়দের কাছে। ভবিষ্যৎ যে খুব ভালো হবে না, এমন কথাও বলেছেন তাঁরা। কিন্তু তাদের আত্মিক সম্পর্কের কাছে এ কথাগুলি নগণ্য হয়ে গেছে। দেখে মনে হয় তাদের দুজনকে যেন একে অপরের জন্যই ভগবান সৃষ্টি করেছেন। তারা দুজন মিলে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের দুজনের সম্পর্কে এই কথা বন্ধ করার একমাত্র উপায় সমাজসেবামূলক কাজ। তাই তারা দুজন দুটি আশ্রম তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। একটি হবে 'বৃদ্ধাশ্রম' ও অন্যটি সমকামীদের জন্য 'সমকামী আশ্রম'। যাদের সন্তানরা দেখেন না, ষাট বছরের বেশি বয়স, তাদের এই বৃদ্ধাশ্রমে রাখা হবে। আর যারা সমকামী হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে চান, অথচ সমাজ তাদের মেনে নেয় না, তারা এই সমকামী আশ্রমে জীবন অতিবাহিত করতে পারবেন। তবে বয়স ত্রিশ বছরের উপরে হতে হবে। তাদের কাছে একটাই শর্ত --- সমাজসেবামূলক কাজে নিজেদেরকে নিযুক্ত হতে হবে।
বৃদ্ধাশ্রমে পঞ্চাশ জন মতো বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে তারা আশ্রয় দেয়। তাদের নিজেদের বিভিন্ন শখ পূরণের জন্য অরুনিতা ও সহেলী মিলে খুব ভালো একটা পন্থা অবলম্বন করে। আচার-জেলি-জ্যাম তৈরীর সাত দিনের একটি ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করে। এখান থেকে ট্রেনিং নিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অরুনিতার এক বন্ধু দানিশের কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ পাবেন। একশো বোতল আচার ভরলে চল্লিশ টাকা দেওয়া হবে, পাঁচশ বোতলে লেবেল আঁটকালে চল্লিশ টাকা দেওয়া হবে বলে দানিশ ঠিক করলেন। তাছাড়া যারা কাঁচামাল নিয়ে আশ্রমে বসে আচার-জ্যাম-জেলি তৈরি করে পুরো কাজটাই সম্পূর্ণ করে দেবে, তাদের আর একরকম রেট বেঁধে দেন দানিশ। এর ফলে প্রায় সকল বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কাজের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় একাকিত্বের যন্ত্রণা বা চিন্তা কিছুটা দূর হয় এবং নিজেদের আয় থেকে সব চাওয়া-পাওয়াও মেটাতে পারেন। অরুনিতারা বৃদ্ধাশ্রমের নাম দেয় "আনন্দপুরী বৃদ্ধাশ্রম"। অন্যদিকে সমকামীদের জন্য যে আশ্রমটি তারা তৈরি করেছে, সেখানে দশ জোড়া সমকামী মানুষ আশ্রয় নেন। তার মধ্যে পাঁচ জোড়া মেয়ে সমকামী ও পাঁচ জোড়া পুরুষ সমকামী। প্রত্যেক জোড়া সমকামীদের জন্য আলাদা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাদেরও এই কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ করে দেয় অরুনিতা। দুটি আশ্রমকে দেখাশোনা করার জন্য চারজন সিকিউরিটি গার্ড, রাধুনী, কেয়ারটেকার নিয়োগ করে তারা।
এই দুটি আশ্রমকে চালানোর জন্য তারা অনেক নামিদামি মানুষের দ্বারস্থ হয়েছে, আর্থিক সহযোগিতা মোটামুটি ভালই আসতে থাকে তাদের। বছরের একদিন অসহায় গরীব মানুষদের তারা দুজন বস্ত্র বিতরণের ব্যবস্থা করে। ১৫ ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের দিন এই অনুষ্ঠানটি হয়। প্রচুর মানুষ তাদের দুজনকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেন। তাদের এই কাজে অন্যান্য সমকামীরা সহযোগিতা করেন। বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এই অনুষ্ঠানে জামা- কাপড় বিতরণ করা হয়। অরুনিতা ও সহেলীর সকলে ধন্য ধন্য করে।
অরুনিতা ও সহেলী দীর্ঘদিন একসঙ্গে থেকে সমাজসেবামূলক কাজ করে মানুষের আশীর্বাদ লাভ করলেও জীবনে একটা ঘাটতি তাদের থেকেই যায় --- সন্তানের মুখ থেকে মা ডাক। অনেক ভেবেচিন্তে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে তারা দত্তক নিয়ে তাদের জীবনের সেই অভাব পূরণ করবে। একদিন রবিবার দেখে কলকাতার এক অনাথ আশ্রম থেকে দু বছরের একটি ছেলে ও পাঁচ বছরের একটি মেয়েকে দত্তক নেয় তারা। এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে এই দত্তক নেয় তারা। একটি শুভ দিন দেখে তাদের নামকরণ করে। ছেলেটির নাম দেয় আশীষ ও মেয়েটির নাম দেয় সন্মুখপ্রিয়া। তাদের মুখ থেকে মা ডাক শুনে দুজনেই যেন মাতৃসুখ অনুভব করে। তারা অনেক চিন্তা করে কয়েক দিন ধরে। অরুনিতা সহেলীকে বলে --- "তাদের মতো যদি প্রত্যেক সমকামী সদস্যরা একটি বা দুটি করে সন্তান সামর্থ্য মতো দত্তক নেন তাহলে অনেক সন্তান তাদের বাবা-মা পাবে। জীবনে চোর-বদমাশ হওয়া থেকে বেঁচে যাবে। জীবন গড়ে যাবে তাদের। এরপর সমকামী আশ্রমে নিয়ম করে দেয়, প্রত্যেক মেয়ে সমকামীকে একজন করে সন্তান দত্তক নিতে হবে। পুরুষ সমকামীরাও চাইলে দত্তক নিতে পারেন। এর ফলে সমকামী আশ্রমে আরো অনেক শিশুদের জায়গা হল। প্রত্যেকেই পিতৃ ও মাতৃসুখ পেলেন তাদের সমকামী জীবনে। অনাথ নাম ঘুচে গিয়ে তারা পেল অভিভাবক- অভিভাবিকা।
গর্ভে ধারণ না করেও যে মা হওয়া যায়, মা ডাকে হৃদয় তৃপ্ত হয়ে যায় অরুনিতা ও সহেলী সে নজির গড়ে। তারা তো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নয়, স্বাভাবিক নারী। একজন পুরুষ ও একজন নারীর সম্পর্কে একটি সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখতে পারে, কিন্তু সব শিশু জন্মাবার পরে পরিচয় পায় না। তাহলে সে জন্মের অর্থ কি? দুজন পুরুষ কিংবা দুজন নারী যদি একে অপরকে নিয়ে জীবনে সুখ শান্তি পায়, একসঙ্গে জীবন অতিবাহিত করতে চায়, এখানে তো দোষের কিছু নেই। জন্ম না দিলেও দত্তক নিয়েও সন্তান সুখ লাভ করা সম্ভব।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট
---------------------------------------
মিঠুন মুখার্জী
নবজীবন পল্লী
পোস্ট + থানা - গোবরডাঙ্গা
জেলা - উত্তর ২৪ পরগনা