গোপন তুষারগর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া উচ্ছল, দুরন্ত, তন্বী ঝোরাগুলো টুং টাং শ্যাওলা-জমা পাথরগুলোর মাথায় পা ফেলে ফেলে কেমন লাফিয়ে লাফিয়ে চলে । স্বচ্ছ জলের মাথায় সাদামুকুটের রূপ দেখতে, তাদের খিলখিল হাসি শুনতে বিপাশার বড্ড ভালো লাগে । খুব জানতে ইচ্ছে করে, পাহাড়ের কোল থেকে নেমে এই ঝোরাগুলো কোথায় যায় ! নিশ্চয়ই এদেরও একদিন না একদিন সমতলেই নামতে হয় । তারপর কী হয়! গতি হারিয়ে ফেলে কী? গতি হারিয়ে হারিয়ে একটা মজা ডোবা হয়ে যায়! নাকি বড়ো নদীতে গিয়ে মেশে! বিলুপ্ত হয়ে যায় স্বতন্ত্র অস্তিত্ব! কী হয়! ঠিক কী হয় এদের !
"আবার ঐ পুরোনো ছবি নিয়ে বসেছো?"
সুমিতের শ্লেষমাখানো কঠিন আওয়াজে চটক ভাঙে বিপাশার । পাহাড় থেকে সোজা সমতলের মাটিতে আছড়ে পড়ে । গতবছরের পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার ছবির অ্যালবামটা সরিয়ে রাখে।
"হুঁ "
" তা কী আর করবে? এমন ফাঁদে পড়েছো যে এবারে বেড়াতে যেতেই পারলে না! যাই বলো, এই করোনা বাবাজি এবারটার মতো বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাকে। নইলে মহারানির মান রাখতে বছরে একবার তো বেরোতেই হতো, তাই না !"
"তা বটে! মহারানির মানই বটে!" আলতো করে বলে বিপাশা ।
কথাটা উপেক্ষা করে যায় সুমিত-
" তা পুরোনো ছবি নিয়ে কী করছো? ও হোঃ, ছবি থেকে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট হবে । পাহাড়ের ছবি, ঝর্ণার ছবি - আর তার সাথে কাব্যি করা ক্যাপশন-
সুন্দরী ঝর্ণা,
তুমি মোর আয়না,
ফিরে যদি নাও আসি,
আমাকে ভুলোনা ।
আহা ! ওহো ! তারপর সেই পোস্টে হাজার লাইক, শয়ে শয়ে কমেন্ট- কী ভাবনা আপনার দিদি! জিও দিদি! দিদি, তুমি কী ভালো লেখো গো! ব্যাস্, আর কী চাই! দিদির আঙুল ফুলে কলাগাছ । দিদিও মহান সাহিত্যিক । সাহিত্যিক বিপাশা দত্ত । ফেসবুক জোড়া নাম। হাজার দুই ফলোয়ার। অথচ দরকারের বেলায় কেউ নেই । তখন কে আছে? না, এই শর্মা, এই সুমিত দত্তই সব খিদমত খাটবে কী বলো !"
চশমার ফাঁক দিয়ে টকটকে লাল চোখে তাকিয়ে থাকা সুমিতকে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় বিপাশা। কী হলো? কী এমন হলো যে এতো রাগ, এতো ব্যঙ্গ, এতো বিদ্রুপ! কীসের কী অপরাধ করেছে সে? হ্যাঁ, ফেসবুকে ছবি দেয় সে । টুকটাক এটা ওটা লিখে ক্যাপশন দেয়, একটা দুটো কবিতা পোস্ট করে । ভালো-মন্দ সব কমেন্টই আসে । আসলে ফেসবুক আজকাল তার কাছে খোলা জানালার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে । বাইরের সাথে সম্পর্কের একটা মাধ্যম যেন । নিজের ভাবনা, ভালো লাগা- খারাপ লাগা প্রকাশের একটা মাধ্যম । ব্যাস্, আর তো কিছু নয় । তাহলে আচমকা এমন আক্রমণ কেন ? কিছু ঘটেওনি নি তো এই কদিনে । তাহলে? খুব জানতে ইচ্ছে করে বিপাশার কিন্তু মুখে কিছু বলে না । আসলে মাঝে মাঝেই এমন অনাকাঙিক্ষত অপমান করে থাকে সুমিত । প্রথম প্রথম জবাব দিত সে, চিৎকারও করতো কখনো কখনো । এখন আর করে না । কারণ সে দেখেছে উত্তরে সে কিছু বললেই আরো উত্তেজিত হয়ে উঠবে সুমিত । তারপর ভয়ানক চিৎকার চেঁচামেচি করবে । তারপর এইসবের মাঝে ছুটে আসবেন শাশুড়ি মা । সব দোষ শেষ অবধি বিপাশার ঘাড়ে ন্যস্ত করে, তাকে দিয়ে না করা অপরাধের দায় স্বীকার করিয়ে তবে দুজনে শান্তি পাবে । এতে সব থেকে খারাপ প্রভাব পড়ে তাদের মেয়েটার উপর । বাচ্চাটা মুখে কিছু বলতে পারে না কিন্তু মায়ের হেনস্থা দেখে মাকে জড়িয়ে কাঁদে । বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে তাই কোনো বাক্যালাপ করে না বিপাশা । একদম চুপ করে থাকে আর অবাক হয়ে সুমিতকে দেখে ।
এই সুমিতই কিন্তু একদিন বিপাশাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। বিপাশার রূপ ছিল চোখটানা, এখনও অবশ্য আছে । ছিপছিপে চেহারা, শ্যামলা রঙ, রেশমের মতো চুল আর সবথেকে সুন্দর হলো টানাটানা চোখ আর কাটাকাটা নাক-মুখ । তার রূপে কলেজ জীবনে মুগ্ধ হতো অনেকেই । সুমিত কিন্তু বারবার বলেছিল - রূপ নয়, বিপাশার গুণের প্রেমেই পড়েছিল সে । নরম স্বভাবের বিপাশার সাহিত্যপ্রীতি, একটু আধটু লেখার অভ্যাসের জন্যই নাকি বিপাশাকে ভালো লেগেছিল সুমিতের । মফস্বলের দুই প্রান্তে বাড়ি ছিল দুজনার। স্কুলে পড়াকালীন মুখ চেনাচেনিও ছিল না । তখন তাদের এলাকায় কলেজ ছিল না । ট্রেনে করে কলকাতায় আসতে হতো । মফস্বলের স্টেশনেই আলাপ হয়েছিল দুজনের । ফার্স্ট ইয়ারের বিপাশা আর থার্ড ইয়ারের সুমিতের কিছু কমন ইন্টারেস্ট কাছাকাছি এনে দিয়েছিল দুজনকে । দুজনেই বইপ্রেমি, নাটক- সিনেমাপ্রেমি তাই ঘন্টার পর ঘন্টা কথা চালাতে অসুবিধা হতো না । বিপাশা তখন থেকেই কবিতা লিখতো একটু আধটু । সুমিত লিখতো না কিন্তু উৎসাহ দিতো, সৃজনশীল সমালোচনা করতো । বিপাশার মনে হতো সুমিতের সাথে কথা বলে সে সমৃদ্ধ হয়, মননের উন্নতি হয় তার । সুমিত যখন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় তখন তাই হ্যাঁ বলতে এক মুহূর্তও ভাবেনি বিপাশা । প্রেমকে পরিণতি দিতে দিন-রাত এক করে ব্যাঙ্কে চাকরি লাগিয়ে ফেলেছিল সুমিত । বিপাশারও ইচ্ছা ছিল নিজের একটা ক্যারিয়ার তৈরি করার। কিন্তু সুমিত চায়নি, বলেছিল-
" নীড়টা বাঁধবো দুজনে । আমি খড়-কুটো আনবো আর তুমি পোক্ত করে বাসাটা তৈরি করবে, কেমন! দেখো এতে ঘরটা মজবুত হবে । আমাদের বাহুল্যের প্রয়োজন নেই ।"
মেনে নিয়েছিল বিপাশা । মেনে নিয়েছিল যে সে ঘর-বার দুটো সামলাতে পারবে না । তার বই পড়া, তার কবিতা লেখা সব বন্ধ হয়ে যাবে । কিন্তু আসলে সেগুলো বন্ধই হয়ে গেল । ঘরটা সামলাতে গিয়ে নয়, অন্যদের মন রাখতে গিয়ে । ঘর সামলে, সন্তান সামলেও ওগুলো করা যায় কিন্তু অন্যদের অনিচ্ছার চাপ নিয়ে কখনো সৃজনশীলতা বজায় রাখা যায় না ,আমার আমিটা কখন যেন হারিয়ে যায় । সে এখন আর কবিতা লেখে না, গানও শোনে না , সাহিত্য যেটুকু পড়ে তা ফেসবুকে । সুমিত রোজ খোঁটা দেয়-
" কী করো সারাদিন?"
সে নিজেরই বুঝে পায় না সত্যি সারাদিন সে কী করে!
অন্যদিকে সুমিত কিন্তু বেশ আছে । নিজের কাজ সামলে বই পড়ে, নাটক দেখে, সিনেমা দেখে। অথচ বিপাশার হাতে বই দেখলেই ঠাট্টা করে । বারবার করে বুঝিয়ে দিতে চায়- সংসারকে মাথায় করে রাখতে গেলে ওসব বই-টই পড়ার দিকে মন দিতে নেই । নিজের পড়া নয়, মেয়েকে পড়ানোই তার আসল কাজ । তবু অবসর তো থাকে! সেই অবসরেও শাশুড়ির পাশে বসে টিভি দেখার নামে তাঁকে সঙ্গ দেওয়াটাও একটা কর্তব্য । আসলে সে মানুষটাই কেউ নয়, কিছু নয় ।
এমনই অস্তিত্বহীনভাবে জীবনটা কাটাচ্ছিল বিপাশা । ভোঁতা হয়ে গেছিলো বোধবুদ্ধি কিন্তু মেয়ে একটু বড়ো হতে, এই স্কুল- টিউশন শুরু হতে কিছুটা টাইম এলো হাতে । প্রথম প্রথম মেয়ের স্কুলের বাইরে অপেক্ষারত মায়েদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে করতে কলেজ জীবনের পরে আবার একটা বন্ধুবৃত্ত তৈরি হলো তার । আড্ডা দিয়ে মন ভালো করার একটা জায়গা পাওয়া গেল । তাদের হাত ধরেই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে, ফেসবুকে আসা । ফেসবুকে সাহিত্য গ্রুপগুলোতে ঢুকে একটু আধটু লেখা শুরু করা, প্রশংসা পাওয়া ।
বিবাহজনিত মগ্নতা একটু কাটবার পর থেকেই বিপাশা দেখেছে সুমিত একদম পছন্দ করে না বিপাশার কেউ প্রশংসা করুক । কেউ তার রূপের প্রশংসা করলেও সুমিত তাচ্ছিল্য করে আর এখন তার লেখার প্রশংসাও সুমিতের দুচোখের বিষ । পাবলিকলি তো কিছু বলতে পারে না, সামনা সামনিই চালায় বাক্যবাণ । মাঝে মাঝে বড্ড ক্লান্ত লাগে বিপাশার । ভাবে সুখের চেয়ে শান্তি ভালো । তবু কোথায় যেন একটা বাধা আসে । এই যে নিজেকে আবার নতুন আয়নায় দেখা, সমমনস্ক বন্ধু পাওয়া, মনের খোরাক পাওয়া এইসব ছেড়ে দেওয়া যায় একনিমেষেই । কিন্তু ছাড়বে কেন? সুমিত আসলে তার পৃথক অস্তিত্বটা স্বীকার করতে চায় না । সে সুমিত-পত্নী, তার কন্যার মা- এটাই সব। আসলে সুমিত হাতের পুতুল করে রাখতে চায় তাকে । সামান্য বিচ্যুতিতেই তাই রাগে ফেটে পড়ে সে । পড়ুক, এখন আর অতো ভাবে না বিপাশা ।
বিপাশাকে মনের সুখে অপমান করার পর থেকে অনেকক্ষণ হলো ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে মোবাইল ফোনে কী যেন লিখছে সুমিত । সাহিত্য গ্রুপগুলোতে বেশিরভাগ সমালোচনামূলক লেখা লিখে থাকে সুমিত । মোদ্দা কথা, লেখার খুঁত খুঁজে বের করে করে নিজেকে খুব বিজ্ঞ প্রমাণ করে । অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিল বিপাশা সুমিতের পোস্টিং-এর। ঠিকই, ফেসবুকীয় সাহিত্যের সমালোচনা করে বিশাল একটা পোস্ট নামিয়েছে সুমিত । একটা ফেক অ্যাকাউন্ট খুলেছে বিপাশা । ঐ অ্যাকাউন্ট থেকে অ্যাক্টিভ হয়ে লেখাটা উপর উপর পড়ে অ্যাঙ্গরি রিয়্যাকশন দিয়ে সর্বপ্রথম ছোট একটা কমেন্ট করে সে- " পরশ্রীকাতরতা "।
বিপাশা জানে এরপর বেশিরভাগ কমেন্টই পড়বে তার কমেন্টের অনুরূপ । কয়েকঘন্টা পর লেখাটা তুলে নেবে সুমিত, তার ফেক অ্যাকাউন্টটা ব্লক করবে । আবার একটা নতুন অ্যাকাউন্ট খুলবে বিপাশা, বেনামে । গ্রুপে জয়েন করবে আর বারবার সুমিতের লেখায় নেগেটিভ কমেন্ট করবে । যতবার ব্লক করবে ততবারই নতুন অ্যাকাউন্ট খুলবে বিপাশা ।
বিপাশাও একদিন ঝোরাই ছিল, আজ হয়তো একটা বদ্ধ ডোবা হয়ে গেছে কিংবা একটা কুয়ো । কুয়োর জলে যেমন আকাশের ছায়া পড়ে তেমন অতলে জমা থাকে চাপচাপ অন্ধকার । দায়টা একা কুয়োর নয় । যারা ঝোরাগুলোকে জোর করে কুয়োর মধ্যে বন্দী করে ফেলে, দায়টা তাদেরও।
-------------------------------
জয়তী ব্যানার্জি মুখার্জি ।