Click the image to explore all Offers

গল্প ।। তৃপ্তি ।। আইজাক সাহা








আবার প্রায় গাঁ ঘেষে দাঁড়িয়েছে ছেলেটা। মনে হয় কেটারিংএর ছেলে।  সকাল থেকে কেবল ফিরে ফিরেই তাকাচ্ছে পলির দিকে। মাঝেমধ্যে উধাও হয়ে যাচ্ছে আবার যখনই পলিরা বাজনা বাজাতে শুরু করছে এসে হাজির হচ্ছে। পলির দিকে একপলকে তাকিয়ে থাকছে। এই চাউনির অর্থ পলি বোঝে। এরকম অভিজ্ঞতা তার আগেও হয়েছে। পলির চেহারা, শরীরের গঠন তাকিয়ে দেখবার মতই।  সে যখন বিশেষত বিয়ের অনুষ্ঠানে বাজায়, সেজেগুজে,ঢাক কাঁধে নিয়ে সুরের তালে তালে নাচে তখন উপস্থিত মানুষগুলো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু সে সব চাউনি ঐটুকুই। এটা অন্যরকম। এই চাউনির অর্থ সে বোঝে। বুকের ভেতর অবধি সেঁধিয়ে যায়। 
প্রায় তিনবছর হল পলি  ঢাক বাজাচ্ছে। সে আর দিদি। এর আগে অন্য ঠিকা লোক দিয়ে চালিয়ে নিত বাবা। কিন্তু ঐ ঘটনার পর বাবা দুজনকেই দলে নিয়ে আসে। তারপর থেকে মায়ারাণী ব্যাণ্ড পার্টির চাহিদা খুব। বিয়ের মরশুমে প্রতি লগনসাতেই ওদের বুকিং থাকে। অনেক আগে থেকেই বুক করতে হয়।  মায়ারাণী ব্যাণ্ডপার্টি। কালি পলির মা মায়ারাণীর নামে। যেমন এই বিয়ে বাড়িতে এসেছে গত পরশু রাতে। গতকাল ছিল অধিবাস। আজ রাতে বিয়ে সেরে কাল বিকেলে  বউ চলে যাবার পর পলিরাও চলে যাবে বাণীপুর। সেখানে আর একটি বিয়েবাড়ি। এইবারের লগনসায় কোনও ডেটই ফাঁকা নেই ওদের। গতকাল অধিবাসের সময় ছেলেটিকে দেখেনি পলি। আজ সকাল থেকেই দেখছে। সকালে যখন লুচি তরকারী  খেতে বসেছিল তখনই ছেলেটিকে দেখে সে। লুচির ঝুড়ি নিয়ে পলির কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল, "লুচি দিই আর একটা'?  না করেছিল পলি। তখনই প্রথম খেয়াল করেছিল, কী অদ্ভুত দৃষ্টিতে পলিকে দেখছিল ছেলেটা। খোকনদা এইরকম তাকাতো।
বুকের ভেতর অবধি চলে যেত সেই চাউনি। পলির শরীরে কেমন শিরশিরানি উঠতো। পাশের গ্রামে এক অন্নপ্রাশনের বাড়ি বাজাতে গিয়েছিল বাবা। দিদিও।  খোকনদা তখনও দলে আসেনি। খোকনদা পাশের কার্ত্তিক জেঠুর বাড়ি যেমন কাজ করতে আসছিল তেমনই এসেছিল। হঠাৎই দুপুরে পলিদের দাওয়ায় চলে আসে।, "এই শোনো না,তোমার সাথে একটা কথা আছে। তুমি না খুব ভাল। তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে।'  তারপর হঠাৎই পলির হাতটা চেপে ধরেছিল খোকনদা। এক অদ্ভুত ভাললাগা ছুঁয়ে গিয়েছল তাকে। সেই শুরু। তারপর কতবার পলির হাত ধরেছে। হঠাৎ হঠাৎ,ফাঁকা পেলেই জড়িয়ে চুমু দিয়েছে। কিশোরী পলি লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছে। কিন্তু খুশিতে ভরেও উঠেছে। মাঝেমধ্যে অবরে সবরে ফাঁক পেলে ফুলতলা বাজারে গেছে দুজনে। এটা সেটা কিনে দিয়েছে খোকনদা। লিপস্টিক,নেলপালিশ। বলেছে,"তোমাকে বিয়ে করে অনেক কিছু কিনে দেব।' একবার একটা পিঙ্ক রঙের চুড়িদার কিনে দিয়েছিল জোর করে। বারবার না করা সত্ত্বেও।  সেই চুড়িদার নিয়েই তো ঝামেলার শুরু।

খোকনদা পলিদের দলে আসার আগে কাঠের মিস্ত্রি অনিল দাসের শাকরেদ ছিল। পলিদের পাশের উঠোনের কার্ত্তিক জেঠুর বাড়ি কাঠের কাজ করতে আসা খোকনদাকে প্রথম দেখে পলি। পলিদের ব্যাণ্ডে ক্ল্যারিওনেট বাজায় দুলালদা। বাবা আর দুলালদা একদিন নতুন গানের সুর তুলছিল। সেই সময় গুটিগুটি পায়ে কাজ ছেড়ে এসে হাজির হয়ে ছিল সে। তারপর কিছুদিনের মধ্যেই মায়ারাণী ব্যাণ্ডের আর একজন ক্ল্যারিওনেট বাজনদার জুটেছিল।  খোকনদা। আগেই জানতো বাজাতে। রানাঘাটে নাকি থাকতো আগে। সেখানেই শিখেছিল।  দারুণ বাজাতো সে। যে কোন নতুন গান তুলে নিতে পারতো অনায়াসে। আর বাজানোর সময় এমন অঙ্গভঙ্গি করতো যে পার্টি খুশি হত খুব। কিছুদিনের মধ্যেই বাবার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল খোকনদা। বাড়িতেও আসতো মাঝে মধ্যে। কখনো গান তুলতে,কখনো শুধু গল্প করতে। পলি বুঝতো বাবার কাছে নয় খোকনদা পলির জন্যই আসে বাড়িতে। খোকনদা এলে পলিরও ভাল লাগত খুব।
ট্রাঙ্কের ভেতর চুড়িদারের পিস খুঁজে পেলে দিদির প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হল পলিকে। " কবে কিনলি?  টাকা পেলি কই? কে দিয়েছে তোকে'।  পলিকে জেরার পর জেরা। পলিদের ঘরে দিদিই সব। সেই কবে পলির যখন ন বছর, মা মারা যাবার পর থেকেই দিদিই সংসারের কর্ত্রী। একবেলার সবজির দোকান আর বাজনা ছাড়া বাবার নিজের জগত নেই। চুপচাপ,শান্ত মানুষ।  কারও সাথে বিবাদ নেই। সকলের বাজনজেঠা।  বন্ধু বলতে একমাত্র ওই দুলালদা। চুড়িদারের পিস হাতে দিদি তখন  নাছোড়বান্দা।  তার গলার স্বর ক্রমশ উঁচুতে উঠছে। "কে দিয়েছে বল।  উত্তর দে।' জেদ চেপে গিয়েছিল পলির। "খোকনদা দিয়েছে।' "কেন খোকন দিয়েছে,  কেন?' "খোকনদা ওর বউকে দিয়েছে। বউকে দেবে না তো কাকে দেবে?   তোকে দেবে?' "কে বউ?  বউকে দেবে মানে?' "বউকে মানে বউকে। আমাকে।' পলি বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। "খোকনদা আমাকে বিয়ে করবে বলেছে।' একথা বলার পর আর এক মুহূর্ত দেরি হয়নি দিদির। পলির চুলের মুঠি কষে ধরে খুব জোরে চড় কষিয়েছিল। পরদিনই বাবা ডেকে পাঠিয়েছিল খোকনদাকে। 
সে বিকেলের কথা আজও ভুলতে পারে নি পলি। পলি ভাবতেই পারে নি যে খোকনদা ওইরকম কথা বলবে। পলি আশ্চর্য হয়ে গেছিল প্রথমে, তারপর তারপর তার বুকের ভেতরটা উথালপাতাল করে উঠেছিল।  বুক ঠেলে বেরিয়ে আসছিল কান্না। অত্যন্ত নীরবে তার চোখ বেয়ে অঝোরে জল বেরিয়ে এসেছিল। দিদি সেসময় অদ্ভুতভাবে কোন কথা বলে নি। পলির মাথাটা ওর বুকে টেনে নিয়েছিল। মাত্র গতকালই যে অমন হিংস্রভাবে পলিকে চুলের মুঠি ধরে পরপর চড় কষিয়ে ছিল আজ সে পরম মমতায় পলির চুলে হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। সেই অদ্ভুত অনুভূতি তার ভেতরে এক হিংস্রতার জন্ম দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সে ছুটে গিয়ে খোকনদাকে টেনে হিঁচড়ে দাঁড় করায়। তাকে আঁচড়ে কামড়ে ফালাফালা করে দেয়। প্রশ্ন করে,তুমি বল নি, আমায় বিয়া করতে চাও?  সে যদি না করে, মিথ্যে বলে এমন অবলীলায়, যেমটা সে বলছিল বাবাকে; "জেঠা, পলিরে আমি তো বিয়ার কথা কই নাই। পলিই আমারে বিয়া করতে চায়। তবে হ্যা, পলিরে আমার অপছন্দ নয়। অরে বিয়া করতেই পারি। তয় আমারে একটা মোটর ভ্যান আর রঙীণ টিভি দেওন লাগব। হ, পলি একটু গায়ে পড়া মাইয়া। এইটা ওইটা চায়।  আমি মাঝে মইধ্যে দিছিও। কইছে বাবায় আপত্তি করব না খোকনদা,তুমি বিয়া করবা আমারে? জিগান পলিরে।  তাই আফনে আপত্তি না করলে বিয়া করতে পারি। তবে হ্যা, বাজনা বাজানোর রোজের টাকা কিন্তু দেওন লাগব। জামাই বইল্যা না দিতে পারবা না' - তাহলে সে চীৎকার করে সব সত্যি কথা বলে।   মনে হয় তাকে বলে,"আমি বলেছি খোকনদা?  তুমিই কি কও নাই?  যেদিন ফাঁকা বাড়িতে তুমি আমারে জড়াইয়া ধরছিলা, আমার জামার ভেতর দিয়া তোমার হাত ঢুকাইতে গেছিলা আমার বুকের মধ্যি,আমি ঝটকাইয়া তোমার হাত সরাইয়া দিছিলাম। কইছিলাম যে এইসব আমার ভাল লাগে না। তুমি কি কইছিলা?  কও নাই যে পলি এরম কর ক্যান, দাও না এট্টু। আমি তো তোমারে বিয়া করুম? আমি কি কইছিলাম যে তোমারে বিয়া করতে চাই?  না কি তুমিই কইছিলা?'   কিন্তু সে পারে নি। কান্নার অবিরল স্রোতের ভেতর তার ইচ্ছেগুলি ক্রোধের জন্ম দেয়। আর সমস্ত ঘৃণা আর ক্রোধ তার বুকের ভেতরে জমা হয়ে গেল।  যা ক্রমে পাথর হয়েছে এখন। তার শরীরের ভেতর যেন আগুন জ্বলছিল। কান দুটো লাল হয়ে উঠছিল। মুখের ভেতরটা শুকিয়ে আসছিল।  কিন্তু সেসব ক্রোধের প্রকাশ সে করতে পারল না।  কেবল দিদির নির্ভরতার বুকের ভেতর মুখ গুঁজে দিদিকে আরো জাপ্টে ধরতে ধরতে শুনল বাবা বলছিল, "আইচ্ছা তুমি আসো এখন। আমি না কইলে তুমি আর আমাগো বাড়ি আসবা না।'
ছেলেটি প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। এইমাত্র পলিরা বাজিয়ে উঠলো। একটু দূরে চাতালের ওপর বাবা, গোপালদা আর অন্যরা বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। দিদিও ওখানেই। বাপি আর দুলালদা নেই। এদিক ওদিক গেছে বোধহয়। বিয়ে বাড়ি বাজাতে এসে পলি দেখেছে এক এক বাড়িতে এক এক রকম নিয়ম। যেমন এইমাত্র এই প্রায় দুপুরে একটা জল ভরতি পেতলের কলসিতে আমসরা চাপিয়ে জনা দশেক মহিলা আর বাচ্চাকাচ্চা এই টগর গাছের কাছে গোবর লেপা জায়গায় এনে রেখেছিল। মহিলারা কিছু করলেই নিজেদের মধ্যে বলে ওঠে, কই গো জোকার দাও।  অমনি সকলে উলু দিয়ে ওঠে। এই উলুধ্বনি মানেই বাজনদারেরা তাদের যন্ত্র নিয়ে রেডি হবে নিমেষে। সিন্থেসাইজারে সুর উঠতেই বেজে উঠবে ক্ল্যারিওনেট,ঢাক,তাসা আর অন্য সব  যন্ত্র। শুরু হবে হয় হৃদমাঝারে রাখব ছেড়ে দেব না বা মালা বদল হবে এ রাতে ধরণের চিরাচরিত বিয়েবাড়ির সুর। কখনো সখনো "ডোলি সাজাকে রাখনা' বা "মিলন হবে কত দিনে'ও।
মায়ারাণী ব্যাণ্ডে এখন তিনজন ঢাকী।  বাবা সুধন্য মণ্ডল আর কালি ও পলি দুই বোন। প্রত্যেক বিয়েবাড়িতে ওদের তিনজনের দুটো সেট ড্রেস থাকে। এখন যেমন ওরা দুই বোন পরেছে হলুদ শাড়ি। লাল ব্লাউজ।  বাবা পরেছে হলুদ ফুলহাতা গেঞ্জি। আর লাল পাজামা। অন্যরা অন্যসময় সাধারণ ড্রেস পরে।  কিন্তু রাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে ওদের সকলের স্পেশাল ড্রেস।  পুরুষরা সকলেই অফ হোয়াইট প্যাণ্ট আর জড়ি দেওয়া জামা। বাবা ছাড়া সকলের মাথায় টুপি। বাবার ড্রেস পুরুষদের মধ্যে আলাদা। অফ হোয়াইট রঙের  শেরওয়ানি।  তাতে জড়ির কারুকাজ আর চুড়িদার পাজামা। মাথা থেকে ঝুলবে জড়ি আর পুঁতি বসানো ফেট্টি। রাতে বাবার অন্য মূর্তি। মাঝখানে বাবা আর দুপাশে কালি ও পলি। এই তিনজনকে গোল করে ঘিরে বাকি সব। সে সময় বাবার ঢাক বাজাতে বাজাতে কী নাচ! কালি পলিও সেই সুরের তালে তালে নেচে নেচে ঢাক বাজায়। এক এক সময়ের জন্য এক একটা গান। কখন কোন গান সময় বুঝে বাজাতে হবে তা বাপি আর দুলালদাকে বুঝিয়ে দেওয়া আছে। এই যেমন আজ সকালে খাওয়ার পর এ বাড়ির জামাই যখন, "কই হে বাজনদার, একটু কষে বাজাও দেখি'- বলে চেয়ার টেনে বসল তারপর প্রায় চল্লিশ মিনিট বাজাতে হল।  তার মধ্যে বেশিটাই ছিল হিন্দি গানের সুর। যাতে নাচটাচ হল খুব। "দো বুঁদ মুঝে ভি পিলাদে শরাবী'  বা "নাচ মেরি বুলবুল' থেকে শুরু করে হাল আমলের হিট হিন্দি গানও।  বাপিদা চট করে নতুন গানের সুর তুলে নিতে পারে। দুলালদা পরে পলিদের বাড়িতে এসে সেই সুর তুলে নেয়। ক্ল্যারিওনেটটা দুলালদা ভাল বাজায়। আর বাজাতো খোকনদা। খোকনদা যখন ছিল তখন দুটো ক্ল্যারিওনেট বাজতো দলে।  এখন শুধু দুলালদাই বাজায়। বাবা সব যন্ত্র বাজাতে পারে। এই ব্যাণ্ড তৈরি করার আগে বাবা কলকাতার মেহবুব ব্যাণ্ডে বাজাতো। সে অবশ্য অনেককাল আগের কথা। এই যে মায়ারাণী ব্যাণ্ডের এত নামডাক তা অনেকটা বাবার জন্যেই। কাজের সময় বাবা খুব সিরিয়াস। বিয়ের আসরে বাবার বাজনা আর নাচ দেখতে ভীড় জমে যায়। বিশেষ করে বাবা যখন টুনি লাইট লাগানো কলসটা মাথায় নিয়ে নাচে তখন উপস্থিত মানুষেরা অবাক হয়ে দেখে। বাবা তখন আর বাজায় না। ওরা দুবোনই ঢাক বাজায়। আর কী অসাধারণ নাচ নাচতে থাকে সুধন্য মণ্ডল। এই কলস নিয়ে নাচতে নাচতেই বাবা বেছে বেছে লোকের সামনে গিয়ে নাচবে। দিলদরাজ লোক হলে দু"একশ বকশিস মিলে যায় কখনও।

ছেলেটা একেবারে চেয়ার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। পলি বোঝে এসব। ও পলিকে বুঝে নিতে চাইছে। একটু আস্কারা পেলে আরো ঘেঁষে আসবে। পলির হয়েছে এই এক জ্বালা। মায়ের চেহারা পেয়েছে ও। সুন্দর ও লাবণ্যে ভরা। শরীরও তাই। পলিকে দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। ঢাক নিয়ে যখন পা ফেলে পলি নাচে তখন চারদিকের চোখগুলি পলিকেই দেখে,পলি তা জানে। সেসব দেখায় ভাললাগা আছে, মুগ্ধতা আছে। কিন্তু এই চাউনির অর্থ অন্যরকম। এ যেন চোখের ভেতর দিয়ে কোন গভীরে চলে যেতে চায়! এখন ছেলেটা এই টগর গাছের নীচে চেয়ারের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পলির দিকে চেয়ে আছে। প্রায় পলির কাছেই।  এখান থেকে বাবাদের দিকটা দেখা যাচ্ছে না আর পলি একাই বসে আছে দেখে  ছেলেটা এত কাছে আসার সুযোগ নিয়েছে। ছেলেটা যে গায়ে পড়া স্বভাবের তা আজ দুপুরের নাচের সময় বুঝেছে। জামাইয়ের অনুরোধে যখন বাজাচ্ছিল তখন নাচের তালে তালে একেবারে পলির গায়ের ওপর এসে পড়েছিল। কেন অমন করেছিল পলি বোঝে। কিন্তু পার্টির বাড়ি এসে এসব কায়দা করে সামলাতে হয়। ছেলেটা কি এ বাড়ির কেউ?  না কি ও যা ভাবছে তাই?  কেটারিংএর ছেলে। কি করবে পলি?  উঠে যাবে?  দিদিদের ওখানে চলে যাবে?  কিন্তু ওখানে গরম। এখানে বেশ হাওয়া পাচ্ছে। ভাবতে ভাবতেই ছেলেটি পলির কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে উঠল। "এই শোনো, একটা কথা বলব?' পলি রা করে না। চুপ করে বসে থাকে। টের পেল তার কান গরম হয়ে উঠছে। মুখের ভেতরটাও কেমন শুকনো হয়ে যাচ্ছে। খোকনদার কথা মনে এলে যেমন হয় তেমনই। কাঁধের কাছটায় ছেলেটি স্পর্শ করছে।পলি টের পাচ্ছে। কি করবে এখন ও? ছেলেটি পার্টির বাড়ির হলে কিছু বলা যাবে না। কায়দা করে সরে যেতে হবে এখান থেকে। আবার কানের কাছে মুখ নিয়ে এল ছেলেটি। "এই শোন না। একটা কথা বলব?' বলতে বলতেই কাঁধটায় আঙুল দিয়ে চাপ দিয়েছে। রাগ হল পলির।  কি চায় ছেলেটি?  "তোমাকে না আমার খুব ভাল লেগেছে। আমার নাম পলাশ।  সবাই আমাকে খোকন বলে ডাকে। শোন না, তোমাকে না খুব সুন্দর দেখতে। তুমি খুব ভাল। আমি টুয়েলভ পাশ করে গোবিন্দনারায়ন কলেজে পড়ছি।... এই মানিকদার কেটারিংএ ঢুকেছি কাজ শেখার জন্য। আসলে আমিই একটা কেটারিং খুলব।....তোমায় না খুব সুন্দর দেখতে। আমার তোমাকে খুব ভাল লেগেছে... তোমাদের বাড়ি তো চাঁদপাড়া থেকে যেতে হয়... আমি সব খোঁজ নিয়েছি.. আমি ছয়ঘরিয়ায় থাকি। নিজেদের বাড়ি। বাবার বড় মুদির দোকান,জমিজমাও আছে... তুমি যখন বাজাও না হেব্বি লাগে... সেক্সি.. প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মত.. হেব্বি।  আমি তো ফিদা হয়ে গেছি।' এইসময় ছেলেটির স্বরের অভিব্যক্তি ঘন শোনায়। ফ্যাসফ্যাসে। হঠাৎই  ছেলেটি তীব্রভাবে পলির ঘাড় ও কাঁধ সংলগ্ন শরীরের স্থানটি দুহাত দিয়ে ধরে। "এই শোনো, তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। আমাকে বিয়ে করবে? আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই। বিয়ে কিছুদিন পর নিজের ব্যবসা খুলি তারপর করব। তার আগে তোমার সাথে প্রেম করব। করবে?' 
উঠে দাঁড়াল পলি। এতক্ষণ ছেলেটি পেছন থেকে অবিরাম নীচু গলায় বকবক করছিল।  পলি যত শুনছিল তত তার কান গরম হয়ে উঠছিল। বিশেষত ছেলেটির ডাকনাম খোকন জানার পর থেকে শরীর কেঁপে উঠছিল। সেই গ্লানি আর লজ্জার বিকেলটা ফিরে আসছিল যেন। সামনের ঘরের চৌকির ওপর বাবা,সুধন্য মণ্ডল, সালথিয়া গ্রামের সবার প্রিয় বাজনজেঠা সুধন্য মণ্ডলের অধোবদন, দূরের পাটক্ষেতের পেছনে পশ্চিম আকাশের ঘন লাল যেন ফর্সা সুধন্য মণ্ডলের মুখের ওপর এসে পড়ছিল আর পেছনের ঘরে দিদির বুকের ভেতর মুখ গুঁজে ক্রমশ রাগে আর কান্নার মিশ্ররাগে তার কান দুটো থেকে আগুনের হল্কা বেরোচ্ছিল। এখন আবার দুই কান দিয়ে আগুনের হল্কা বেরোনোর অনুভব। "আমি তো বিয়া করুম কই নাই জেঠা!  পলিই কইছিল। বাবায় কিছু কইব না, আমি বাবারে রাজি করামু। তুমি আমারে বিয়া করবা?  আমার পলিরে অপছন্দ না। একটু গায়ে পড়া স্বভাবের।  খালি এইডা ওইডা চায়। বাচ্চা মানুষ তো তাই।  তবে ওই যে আমারে একটা মোটর ভ্যান কিনা দিতে হইব।' 
এবার সে ঘুরে দাঁড়ালো।  ছেলেটির মুখের দিকে তাকাল সরাসরি। কী আশ্চর্য !  খোকনদার মতই মাথায় ঝাঁকড়া কোকড়ানো চুল। কিন্তু ছেলেটির ফর্সা, লম্বাটে মুখ।  একই রকম কামাতুর চাহনি। ছেলেটি আস্কারা পেল কি না কে জানে, পলির হাত দুটো চেপে ধরল। ওই বাগানটায় চল না।  যাবে?  সেই খোকনদা! সেই কামার্ত দৃষ্টি!  নিমেষে মাথা গরম হয়ে গেল পলির। কপালের দুপাশ দপদপ করছে। কানদুটো দিয়ে আগুনের হল্কা বেরোচ্ছে। সাড়ে তিনবছর আগের খোকনদাকেই সামনে দেখল যেন। ঢাকের কাঠি দুটি হাতে রাখা ছিল। দ্রুত ছেলেটির হাত ছাড়িয়ে নিল সে। কাঠিদুটি পাশের চেয়ারে চালান করে।  তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাঁ হাতে ছেলেটির চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকায়। আরো দ্রুততায় ফর্সা গালটা সপাটে চড় বসায়। পরপর কয়েকটা। সেই চড়ের শব্দ পলির বুকের মধ্যকার অতলে যেন গুমগুম বাজে। যেন কবেকার জমাট অন্ধকারের,গ্লানির,লজ্জার,অপমানের পাথর ভেঙে পড়ছে যেন।
কাঁধে ঢাক তুলে দৃপ্ত পায়ে পেছন ফিরল পলি। এখন আর কানদুটো উত্তপ্ত লাগছে না তার। হাওয়া দিচ্ছে হঠাৎ।  শরীর বেয়ে এক অদ্ভুত তৃপ্তি তাকে ধুইয়ে দিচ্ছে।
 
                              ---------------------------------------------------


আইজাক সাহা
হাবরা
উত্তর চব্বিশ পরগনা 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.